‘চারদিন না খেয়ে ছোট একটা নৌকায় ভাসার পর চিৎকার করে সাগরে লাফিয়ে পড়ি’
সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার দক্ষিণ খুরমা ইউনিয়নের মুনিরজ্ঞাতি গ্রামের চক্রবনপাড়া এলাকার তরুণ শিপন আহমেদ এই কথাগুলো বলছিলেন। শিপন পেশায় ছিলেন সিএনজি অটোরিকশা চালক। পরিবারের আর্থিক সংকটের কারণে প্রাথমিকেই থেমে যায় লেখাপড়া। কয়েক বছর বেকার থাকার পর স্বজনদের সহযোগিতায় একটি ফোরস্ট্রোক সিএনজি অটোরিকশা কিনে গোবিন্দগঞ্জ-বোকারভাঙ্গা-সিলেট-সুনামগঞ্জ রুটে চালিয়ে ভালোই আয়-রোজগার করছিলেন শিপন। সিএনজি চালিয়ে প্রতিমাসে তিনি গড়ে ১৫ হাজার টাকা আয় করতেন।
হঠাৎ একদিন রাতে পাশের মায়েরকোল গ্রামের লিবিয়া প্রবাসী দালাল লুৎফুর রহমান তাকে ফোন দিয়ে কথা বলে, ইতালি যাওয়ার স্বপ্ন দেখায়। কিন্তু দালালের সঙ্গে কথা ছিল ইতালি যাওয়ার পর আর্থিক লেনদেন করা হবে। তবে সে কথা রাখেনি দালাল। শিপন বলেন, ‘অভাবের সংসারে সুখ সমৃদ্ধি আসবে এই আশায় দালালের কথা বিশ্বাস করে কিছু কৃষিজমি নিকট আত্মীয়দের কাছে বন্দক রেখে, তিনটি গরু বিক্রি করে, স্বজন ও ভাইদের কাছ থেকে তিন লাখ টাকা ধার করে মোট পাঁচ লাখ টাকা জোগাড় করে দালালের প্রতিনিধির হাতে তুলে দেই। ফেব্রুয়ারিতে যাত্রা শুরু করি।’
তিনি জানান, ‘লিবিয়ার বেনগাজিতে একটি ক্যাম্পে খুব নির্যাতন করা হয়েছে আমাদের ওপর। এক দালাল মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে আমাকে বলে, বাংলাদেশ থেকে সাড়ে ৪ লাখ টাকা দ্রুত নিয়ে আসো, না হয় হত্যা করা হবে। পরে বাড়িতে বাবাকে ফোন দিয়ে সবকিছু জানাই। বাবা আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে ঋণ করে সাড়ে চার লাখ টাকা তাদের কথামতো লিবিয়ায় থাকা পাশের গ্রাম মায়েরকোলের লুৎফুরের বাবা জমির আলীর হাতে তুলে দেন। টাকা দেওয়ার পর বেনগাজি থেকে দালালরা আমাদের নিয়ে যায় ত্রিপোলি। সেখানে নিয়ে যাওয়ার সময়ও অনেক মারধর করে। একপর্যায়ে বললো, আরও দুই লাখ টাকা দিতে হবে, না হয় তোদের ইতালি যাওয়ার গেইমের ঘরে নিয়ে যাবো না। পরে আমার কাছে থাকা কিছু টাকা এবং লিবিয়ায় থাকা আমার এক বন্ধুর কাছ থেকে ঋণ নিয়ে বাংলাদেশি টাকায় দুই লাখ টাকা দেই তাদের।’
শিপন বলেন, ‘এপ্রিল মাসে সবাইকে নিয়ে গেইমের ঘরে ঢোকায়। জেলখানার মতো ছোট্ট একটি ঘর। ৬৪ জনকে ওখানে ঢোকায়। কোনও দিন একবার খাওয়া দিতো, কোনও দিন দিতো না। সিলেটি ১৪ জন ওখানে ছিলাম আমরা। তখন রমজান মাস ছিল। রোজা তো রাখতেই পারিনি, একপর্যায়ে সবাইকে ভূমধ্যসাগর পাড়ে নিয়ে যায়। কথা ছিল আমাদের বড় জাহাজে তুলে দেবে। কিন্তু তুলে দেয় কয়েকটি প্লাস্টিকের বোটে। ৭৩ জন ছিলাম ওই বোটে।’
দুঃসহ অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘দালালদের পরিকল্পনা ছিল আমরা যেন সাগরের মাঝখানে ডুবে যাই। প্রত্যেকটা দিন আমরা চিৎকার করে কাঁদতাম। কিন্তু এই কান্না শোনার মতো কেউ ছিল না। দুই সপ্তাহ বলতে গেলে আমরা কিছুই খাইনি। চিন্তা করতাম আর কোনও দিন হয়তো মায়ের কাছে ফিরে আসতে পারবো না। বড় ভুল করেছি সেটাও ভাবতাম। ওই সময়ে আল্লাহর কাছে বিচার চাইতাম, আল্লাহ যেন ওই দালালদের বিচার করেন।’ তিনি জানান, চারদিন সাগরে ভাসার পর তিউনিসিয়ার একটি জাহাজ দেখে বাঁচাও বাঁচাও চিৎকার দিয়ে ১৫ জন হিমশীতল পানিতে লাফিয়ে পড়েন। পরে ওই জাহাজ থেকে রশি ফেলে তাদের জাহাজে তোলা হয়। অন্যদেরও উদ্ধার করে বোটে রাখে তিউনিসিয়ার ওই জাহাজকর্মীরা। তারাই পরে বাংলাদেশ হাইকমিশনে যোগাযোগ করে আমাদের অবস্থার কথা জানায়।
শিপনের মা মিনারা বেগম বলেন, ‘আমার সব বিক্রি কইরা, জমি বন্ধক দিয়া ছেলেরে বিদেশে পাঠাইছিলাম। কিন্তু দালালরা আমার ছেলেরে মারার চেষ্টা করছে। এতো টাকা নিয়া গেছে, আমারে ঠকাইসে, আমি এর বিচার চাই।’ শিপনের বাবা হেলাল মিয়া বলেন ‘গত মার্চ মাসে শিপনকে লিবিয়া নেওয়ার কথা বলে টাকা নেয় দালাল লুৎফুর রহমান ও তার বাবা জমির আলী। পরে শিপনকে লিবিয়া নিয়ে আটকে রেখে তার কাছ থেকে দুই লাখ টাকা নেওয়া হয়। পরে ইতালি নেওয়ার কথা বলে গত ২১ মে আরও তিন লাখ টাকা চেয়ে নেয় লুৎফুরের বাবা জমির আলী। টাকা নেওয়ার পর লুৎফুর আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। এরপর থেকে ছেলের কোনও খোঁজ পাইনি। পরে টিভিতে খবরে জানলাম আমার ছেলে উদ্ধার হয়েছে।’
‘সবকিছু বিক্রি করে টাকা তুলে দিয়েছিলাম দালালের হাতে। ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে যাত্রা শুরু করে দুবাই, মিসর হয়ে লিবিয়ার বেনগাজি শহরে পৌঁছাই। বেনগাজির একটি ক্যাম্পে আটকে রেখে আমাদের ওপর চলে অবর্ণনীয় শারীরিক নির্যাতন। কয়েক দফায় টাকা দেওয়ার পর বেনগাজি থেকে ত্রিপোলি হয়ে ভূমধ্যসাগরে একটা ছোট নৌকায় তুলে দেয়। ওঠার পরই নৌকার তেল শেষ হয়ে যায়। চারদিন ওখানেই না খেয়ে সাগরের উত্তাল ঢেউয়ে ভেসেছিলাম আমরা। পরে তিউনেসিয়ার একটি জাহাজ দেখে বাঁচাও বাঁচাও চিৎকার দিয়ে ১৫ জন আমরা সাগরের হিমশীতল পানিতে লাফিয়ে পড়ি। কিছুক্ষণ পর ওই জাহাজ থেকে রশি সাগরে ছাড়লে আমরা কোনোভাবে জাহাজে উঠি। পরে তিউনিসিয়া থেকে আমাদের দেশে পাঠানো হয়।’