জনপ্রতিনিধিদের ‘আশীর্বাদ’ ছাড়া ত্রাণ মিলছে না
যখন সরকার দলমত নির্বিশেষে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে ত্রাণ দিতে শতভাগ আন্তরিক সে সময়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা অভিনব কায়দায় ত্রাণ দিচ্ছেন গুটি কয়েক মাসুষদের। এতে সিংহভাগ মানুষ পাচ্ছে না ত্রাণ নামের সোনার হরিণ। তবে মন্ত্রী, কর্মকর্তাসহ ঊর্ধ্বতন সবারই একই মন্তব্য- বন্যার্তরা প্রয়োজন মতো ত্রাণ পাচ্ছেন। মানুষ শান্তিতে আছেন। কিন্তু বাস্তবে বানভাসীদের কেউ ত্রাণ পেয়েছেন আর কেউ ত্রাণের জন্য অপেক্ষায় আছেন। অধিকাংশ বানভাসি ত্রাণের দেখা পাচ্ছেন না।
মেম্বার কিংবা চেয়ারম্যানরা শুধু তাদের নিজেদের অনুসারী মানুষকে ত্রাণ দিচ্ছেন। নিজেদের বলয়ের বাইরের মানুষের ত্রাণ দিতে তারা রাজি নন। এর ফলে প্রকৃত বানভাসীরা ত্রাণ পাচ্ছেন না।
বন্যা এলাকায় অনেকেই অনেকভাবে ত্রাণ দিচ্ছেন। কিন্তু কে কিভাবে কোন অবস্থায় ত্রাণ দিচ্ছেন তা কেউ জানেন না। মূলত গাড়ি যোগাযোগ রয়েছে শুধু এমন এলাকাগুলোতেই পাঞ্জাবি-পায়জামা লাগিয়ে কিছু ব্যক্তি ত্রাণ দিচ্ছেন। আর সেই ত্রাণ দেয়ার ছবি তুলে গণমাধ্যম কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করা হচ্ছে। অর্থাৎ ত্রাণের নামে চলে ফটোসেশনও। এ জন্য হাজার হাজার মানুষ এখনো ত্রাণের অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন।
বন্যাকবলিত এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বন্যার্তদের মাঝে ত্রাণ বিতরণের আনুষ্ঠানিকতা দেখা গেলেও অসহায় মানুষের খাবারের কষ্ট খুব একটা লাঘব হচ্ছে না। হাকালুকি পাড়ে এবারের বন্যায় অসংখ্য মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন।
২৮ মার্চ থেকে গত মঙ্গলবার পর্যন্ত মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসন বন্যার্তদের জন্য ৯৫০ টন চাল পেয়েছে। জেলা প্রশাসনের হিসাব অনুযায়ী সব চালই বন্যার্তদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। এর বাইরে গম, শুকনো খাবারও দেয়া হচ্ছে। কিন্তু বন্যার্তরা বলছেন, তারা ঠিকমতো ত্রাণ পাননি। এই পাওয়া না পাওয়ার হিসেব বা কারণ কোনোটাই স্থানীয় প্রশাসন থেকে ব্যাখা দেয়া হচ্ছে না। অথচ সরকার ত্রাণ দিয়েই যাচ্ছে। আর জেলা প্রশাসনও বলছে, আরো ত্রাণ আসবে। তবু বানভাসিরা ত্রাণের জন্য হাহাকার করছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মেম্বার-চেয়ারম্যানরা যখন ত্রাণ দেয়ার জন্য তালিকা করেন তখনই মূলত দুর্নীতি হয়। তালিকায় কিভাবে দুর্নীতি হয় জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জুড়ীর এক ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বলেন, প্রত্যেক চেয়ারম্যান যে রাজনৈতিক দল থেকে নির্বাচিত হন- সেই চেয়ারম্যান শুধু তার অনুসারীদেরই ত্রাণ দেন। প্রকৃত বানভাসী যদি ওই চেয়ারম্যানের অনুসারী না হন তাহলে তিনি ত্রাণ পাবেন না। আর চেয়ারম্যান তালিকা না দিলে স্থানীয় প্রশাসনও প্রকৃত বানভাসির তালিকা করতে পারে না। এমন খপ্পরে পড়ে অধিকাংশ বানভাসী ত্রাণ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।
আর মেম্বারদের দুর্নীতি বিষয়ে চেয়ারম্যান বলেন, মেম্বার নির্বাচিত হওয়ার পর ওই মেম্বার হিসাব করে বের করেন কোনো কোনো গ্রামের ভোটাররা তাকে ভোট দেয়নি। ওই হিসাব বের করার পর নির্বাচিত মেম্বার যে গ্রামের লোকজন ভোট দেন না সেই গ্রামের মানুষের সরকারি কোনো সাহায্য দেন না। এর ফলে নির্বাচিত মেম্বারের অনুসারী না হলে কোনো সাহায্য পান না দুর্গতরা। এর বাইরে চেয়ারম্যান যদি বিরোধী দলের রাজনীতিক হন তাহলে তার বরাদ্দে আসা ত্রাণের একটি বড় অংশ সরকারদলীয় রাজনীতিকদের ‘ঘুষ’ দিতে হয়। এ ‘ঘুষ’ না দিলে বিরোধী রাজনীতিক সংশ্লিষ্ট চেয়ারম্যানকে বিপদে পড়তে হয়। এ বিপদ এড়াতে বিরোধী রাজনীতিক চেয়ারম্যান ত্রাণের বড় অংশ সরকারি দলের স্থানীয় রাজনীতিকদের হাতে তুলে দেন। এর পরে আর দুর্গতদের হাতে তুলে দেয়ার
এদিকে কুলাউড়া উপজেলায় ১৩টি ইউনিয়নের মধ্যে ২টি ইউনিয়নের শতভাগ এলাকা বন্যাকবলিত। এর মধ্যে ভুকশিমইল ইউনিয়নে বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ জন্য এই ইউনিয়নে ত্রাণও বেশি দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। কিন্তু ইউনিয়ন চেয়ারম্যান বলেছেন, তিনি পর্যাপ্ত ত্রাণ সহযোগিতা পাননি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভুকশিমইল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আজিজুর রহমান মনির বিএনপির প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে জয়লাভ করেন। বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এখানে ৩২ টন চাল এবং ৬ টন গম দেয়া হয়। এ উপজেলার কোনো ইউনিয়নে এটিই সর্বোচ্চ বরাদ্দ বলে জানা গেছে। ইউনিয়ন চেয়ারম্যান এসব বরাদ্দ নিয়ে তার অনুসারীদের মধ্যে বিতরণ করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
কুলাউড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার চৌধুরী মোহাম্মদ গোলাম রাব্বী বলেন, ভুকশিমইল ইউনিয়ন চেয়ারম্যান কেন বললেন- পর্যাপ্ত ত্রাণ পাননি, এমন অভিযোগের প্রেক্ষিতে তাকে শোকজ করা হয়েছে। শোকজের জবাব পাওয়ার পর পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে নির্বাহী কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
জানতে চাইলে কুলাউড়া উপজেলা চেয়ারম্যান আ স ম কামরুল ইসলাম বলেন, কুলাউড়া উপজেলার ভুকশিমইল ইউনিয়নে বন্যার্তদের জন্য সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। তবু কিভাবে ভুকশিমইল ইউনিয়ন চেয়ারম্যান বলেন, তিনি ঠিকমতো বরাদ্দ পাননি। এটা বলে তিনি কী জানান দিতে চান? ভুকশিমইল ইউনিয়ন চেয়ারম্যানের এমন মন্তব্যের জেরে শোকজ করেছেন ইউএনও।
এ বিষয়ে জুড়ী উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান কিশোর রায় চৌধুরী মনি বলেন, বন্যাকবলিত এলাকায় সরকার যথেষ্ট পরিমাণে ত্রাণ দিচ্ছে। কিন্তু বণ্টনের সময় সমন্বয়ের অভাবে এ ত্রাণ সবার কাছে পৌঁছাচ্ছে না। এতে কেউ দুবার ত্রাণ পাচ্ছেন আবার কেউ একবারও পাচ্ছেন না। তবে মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসক তোফায়েল ইসলাম ত্রাণ বিতরণের বিষয়ে বলেন, সমন্বয়হীনতার কথা আমার জানা নেই। আমরা ত্রাণ দিচ্ছি। কিন্তু ত্রাণ নিয়ে যদি অপকর্ম হয় তাহলে অবশ্যই খতিয়ে দেখা হবে।