টাংগুয়ায় পর্যটকদের গান শোনাচ্ছে শিশুরা
ইঞ্জিন চালিত নৌকা কিংবা স্পীডবোটের আওয়াজ শুনলেই সমবেত কন্ঠে গান গাইতে গাইতে গ্রাম থেকে ওয়াচ টাওয়ারের দিকে দৌড়ায় টাঙ্গুয়াপারের ৩ গ্রামের অর্ধশতাধিক ছাত্রছাত্রী। ওয়াচ টাওয়ারে স্পীডবোট থামতে না থামতেই অর্ধশতাধিক শিশুর কন্ঠ বেয়ে টাঙ্গুয়ার নীল জলে সুর মিশে বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের গান, ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম, মধু হই হই আঁরে বিশ হাওয়াইলা, আমরা সবাই হাওরবাসী হাওর ছাড়া বুঝি না।’ এভাবেই গান গেয়ে টাঙ্গুয়া হাওরে আসা পর্যটকদের আনন্দ দিয়ে সামান্য ক’টা টাকা রোজগারের আশায় বিদ্যালয়ে না গিয়ে স্কুলগামী শিশুরা এখন দিনব্যপী অপেক্ষায় থাকে পর্যটকদের অপেক্ষায়। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সপ্তাহে সাত দিনই ওরা গান গেয়ে আনন্দ দেয় পর্যটকদের আর বিনিময়ে পায় সামন্য ক’টা টাকা। এই লোভে পরে দিনের পর দিন স্কুল বিমূখী হচ্ছে শত শত শিশু।হাওরে গান গাইতে আসা সকল শিশুরাই জয়পুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। গত ৬ মাস পূর্বেও এই শিশুরা নিয়মিত বিদ্যালয়ে যেত এখন আর বিদ্যালয়ে যায় না। লেখাপড়ার চেয়ে এখন তাদের কাছে মূখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে বিস্কুট, চকলেট আর সামান্য ক’টা টাকা। টাঙ্গুয়া হাওরে শিশুদের গান শুনতে শুনতে কথা হয় ৪র্থ শ্রেনীর শিক্ষার্থী লালচান, জবা জুয়েল ও ৩য় শ্রেণির শিক্ষার্থী আকাশ এর সাথে। তারা জানায়, তারা সবাই জয়পুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। গত ৬ মাস ধরে তারা সবাই দলবদ্ধভাবে হাওরে আসা পর্যটকদের গান শুনিয়ে আনন্দ দেয় এবং পর্যটকরা বিনিময়ে তাদের কিছু টাকা দেন। প্রাপ্ত টাকা সবাই ভাগাভাগি করে নিয়ে যায়। বিদ্যালয়ে না গিয়ে গান গাইতে আসছ জানতে চাইলে দলনেতা এ প্রতিবেদককে একটু পাশ কাটিয়ে দূরে চলে যায়। রামসার সাইট খ্যাত টাঙ্গুয়া হাওর গত কবছর ধরে উল্লেখযোগ্যভাবে পরিচয় পায় পর্যটকদের কাছে। হাওরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে প্রতিদিন শত শত পর্যটক আসেন টাঙ্গুয়া হাওরে।
টাঙ্গুয়া হাওরপার ওয়াচ টাওয়ার সংলগ্ন গ্রাম জয়পুর, গোলাবাড়ি,আলমপুর । এই ৩ গ্রামে শিশু- কিশোর রয়েছে ৩ শতাধিকের মত। গ্রামের অধিকাংশ শিশু প্রতিদিন বিদ্যালয়ে আসা যাওয়া করতো। গত ৬ মাস ধরে হঠাৎ করেই বিদ্যালয়ে শিশুদের উপস্থিতি কমে যায়। প্রথম দিকে হাওরে দু’একজন শিশু ছোট নৌকা নিয়ে পর্যটকদের হিজল করচ বাগানের ভেতর ঘুরে দেখাতো এবং গান গাইতো। বর্তমানে শতাধিক শিশু কিশোর রয়েছে এই পেশায়। অনেকে শিশু গান গেয়ে শুনাচ্ছে আবার অনেকে শিশু পর্যটকদের নিয়ে ছোট নৌকায় করে হাওর ঘুরাচ্ছে। আর এভাবেই দিন দিন বিদ্যালয় বিমূখ হয়ে পড়ছে শত শত স্কুল শিশু। গ্রামের অধিকাংশ পরিবার হতদরিদ্র। বিদ্যালয়ে না গিয়ে তাদের সন্তানরা রোজগার করছে এ বিষয়টা তারা স্বাভাবিক ভাবেই দেখছেন। আর এ থেকেই দিন দিন এ কোমলমতি শিশু কিশোররা লেখাপড়া বাদ দিয়ে জড়িয়ে পড়ছে এ ব্যবসায়। আলমপুর গ্রামের ছাত্র অভিভাবক সাইকুল ও নজরুল আলমের সাথে এ বিষয়ে কথা হলে তারা বলেন, ‘নদী পার হয়ে আমাদের গ্রামের শিশুদের বিদ্যালয়ে যেতে হয় । সেই সাথে বিদ্যালয় গ্রাম থেকে একটু দুরে হওয়ায় শিশুরা প্রতিদিন বিদ্যালয়ে যেতে চায়না।’ জয়পুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রধান শিক্ষক হাদিউজ্জামান বলেন, তিনি বিদ্যালয়ের ছাত্র অভিভাবকদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের বুঝিয়ে আসেন কিন্তু অভিভাবকরা কেন জানি বিষয়টি আমলেই নিচ্ছেন না। পর্যটক ফারুক আহমেদ বলেন, এক সময় সাজেক যাওয়ার পথে দেখতাম শত শত শিশু রাস্তায় দাড়িয়ে পর্যটকদের অভ্যর্থনা জানাতো সামান্য চকলেট, বিস্কুটের আশায় এবার টাঙ্গুয়া হাওরে এসে দেখলাম স্কুলগামী শিশুরা স্কুলে না গিয়ে হাওরে এসে পর্যটকদের বিনোদন দিতে গান গায়। হাওরে ঘুরতে এসে শিশুদের গান শুনে সামান্য ক’টা টাকা দিয়ে যারা এ স্কুলগামী শিশুদের উৎসাহ দেন তারা কাজটা ঠিক করছেন না। তাহিরপুর উপজেলা সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা বিপ্লব সরকার বলেন, জয়পুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্র্থীরা বিদ্যালয়ে না এসে হাওরে গান গাইতে যায় আমি নিজেও হাওরে তাদের গান শুনেছি । আমরা নিয়মিত চেষ্টা করছি শিশুদের বিদ্যালয়মূখী করতে।