নিপু বড়ুয়া ও কামরুল ইসলাম।।

দেশীয় নাটকের ঐতিহ্য হারিয়ে গেছে।টিভি নাটকের দর্শক কমে গেছে। এরকম কথাই বেশ কয়েকবছর ধরে শোনা যাচ্ছে। দেশের নাটক বাদ দিয়ে বিদেশী সিরিয়ালমুখী হয়েছেন দর্শকরা। একটা সময় বাংলাদেশ টেলিভিশনের প্রচার হওয়া ‘কোথাও কেউ নেই’, ‘সকাল সন্ধ্যা’. ‘সংশপ্তক’, ‘আজ রবিবার’-এর মতো নাটকগুলোর জনপ্রিয়তা এতই ছিলো যে, দেশের সীমানা ছাড়িয়ে কলকাতার দর্শকের কাছে দারুণ প্রশংসিত হয়েছিল। দেশীয় টিভি নাটকের জনপ্রিয়তা ছিল আকাশছোঁয়া। বর্তমানে এসব কথা রূপকথার মতো হলেও এটাই সত্যি। বাংলাদেশের দর্শক দেশের নাটক বাদ দিয়ে কলকাতার সিরিয়াল নিয়ে পড়েই থাকে এখন। শুধু তাই নয়, সেসব এখন তাদের জীবনের একটা অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে কেন দেশীয় নাটকের জনপ্রিয়তা হারালো? এক্ষেত্রে তারকা শিল্পী ও নির্মাতারা নাটকের বাজেট নিয়ে কথা বলেছেন।

সরজমিনে দেখা গেছে, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দর্শকরা জানিয়েছেন, দেশীয় নাটক না দেখার পেছনে অন্যতম কারণ হলো গল্প সংকট। একঘেয়েমি গল্পই দর্শকদের দেখানো হচ্ছে। কোনো ভিন্নতা নেই। খণ্ড নাটকের ক্ষেত্রে দেখা যায়, ঘুরেফিরে প্রেম-বিরহ অথবা গৎবাঁধা কমেডি গল্প। অন্যদিকে ধারাবাহিক নাটক ক্ষেত্রেও পারিবারিক-দ্বন্দ্ব আর নয়তো কমেডির নামে ভাঁড়ামি থাকে গল্পের উপজীব্য। অন্যদিকে কিছু নাটকের গল্প মনের মতো হলেও অতিমাত্রায় বিজ্ঞাপনের চাপে দর্শক দেখতে পারেন না। কিন্তু কলকাতার চ্যানেলগুলোর সিরিয়ালের প্রচার সময় অতিরিক্ত বিজ্ঞাপনের চাপ নেই। যে কারণে দেশীয় দর্শকের একটা বড় অংশ ঝুঁকে পড়ছে কলকাতার চ্যানেলের দিকে। এদিকে নাটক সংশ্লিষ্টরদের বক্তব্য, শিল্পী-নির্মাতারা চ্যানেলের কাছে বন্দি। আবার চ্যানেল এজেন্সির কাছে বন্দি। স্বাধীনভাবে কেউ কাজ করতে পারেন না। চ্যানেল কিংবা এজেন্সি ঠিক করে দিচ্ছে নাটকে কারা অভিনয় করবে। মূলত এসব কারণেই নাটকের মান কমে গেছে। তাই দর্শক কলকাতার চ্যানেলমুখী হয়ে গেছেন।

আলাপকালে বরণ্যে অভিনেতা, নির্মাতা আবুল হায়াত বলেন, নাটকের দর্শক কমছে না, বরং কমানো হচ্ছে। এটার দায়ভার টিভি চ্যানেলের। নাটক প্রচার করে চ্যানেল, আবার বিজ্ঞাপনও তারাই প্রচার করে। সুতরাং, দর্শক যে বিজ্ঞাপনের অজুহাত দেখায়, সেটা তো চ্যানেলের কারণেই। নাটকের মান যদি ভালো না হয়, তাহলে সে নাটক চ্যানেলে প্রচার হয় কিভাবে? মানহীন নাটক কেন চ্যানেল প্রচার করে? এছাড়া বাজেটের ব্যাপার তো আছেই। বাজেট ছাড়া ভালো মানের নাটক তো হবে না। কেউ তো নিজের পকেটের টাকা খরচ করে নাটক বানাবে না। তেল কম দিয়ে মচমচে ভাজা পাওয়া সম্ভব না।

তিনি যোগ করে আরও বলেন, আমাদের দেশে অনেক ভালো ভালো নির্মাতা-নাট্যকার রয়েছে। কিন্তু, তাদেরকে পর্যাপ্ত সম্মানী দেওয়া হয় না। এসব সমস্যার সমাধানে সবার আগে চ্যানেলগুলোকে দায়িত্বশীল হতে হবে। নাটকের জন্য আগে পর্যাপ্ত বাজেট নিশ্চিত করতে হবে, তার পর নাটকের মান ভালো হবে। সংস্কৃতির দায়ভার শুধু শিল্পী বা নির্মাতাদের উপর নয়, তাদের উপরও রয়েছে।

টেলিভিশন প্রযোজক সমিতির সভাপতি মামুনুর রশীদ বলেন, নাটকের দর্শক কমে যাওয়ার পেছনে কয়েকটি কারণ জড়িয়ে আছে। এক হচ্ছে, আমাদের নাটকগুলোর জন্য প্রযোজনা ব্যয় পর্যাপ্ত না, অন্যদিকে বিদেশি চ্যানেল ও ডাবিংকৃত বিদেশি সিরিয়ালের প্রভাব তো রয়েছেই। আবার দেশে যেই পরিমাণ চ্যানেল আছে, সবার চাহিদা পূরণ করার মতো এতো বেশি নাটক নির্মাণের সামর্থ্য আমাদের নেই। তিনি আরও বলেন, নাটকের মান কমছে না। বাজেট স্বল্পতার কারণে নাটকের মধ্যে বিভাজন হয়ে গেছে। বিভিন্ন গ্রেড চলে আসছে। চ্যানেলগুলো বাজেট কম দিচ্ছে, আবার প্রচুর নাটকও চাচ্ছে। তাহলে তো ভালো নাটক পাওয়া যাবে না। ভালো নির্মাণের জন্য ভালো বাজেট দিতে হবে।

নাট্যকার, নির্মাতা ও প্রযোজক শাকুর মজিদ বলেন, টিভি নাটকে বিনিয়োগ ফিরে পাই না। নাটক বানানো বন্ধ করে দিয়েছি। তাছাড়া টেলিভিশন নাটক এখন অশ্রদ্ধার সাথে দর্শকরা দেখে। তাই টেলিভিশন নাটকও লিখছি না। শ্রদ্ধাভরে নাটক দেখার পরিবেশ নাই কারণ নাটকের মাঝে অনেক বেশি বিজ্ঞাপন প্রচার হয়। দর্শক বিরক্ত। আগে অন্যের কাজ দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে নিজে কাজ করতাম। এখন অন্যের কাজ দেখি না অনুপ্রেরণাও পাই না। আমার মনে হয়, টিভি নাটক এখন আর কেউ দেখে না। দেশে বাতিলদের সংখ্যাই বেশি। যে অভিনয় পারে না সে অভিনয় শিল্পী, যে পরিচালনা জানে না সেই পরিচালক।

নাট্যকার, নির্মাতা মাসুম রেজা বলেন, টিভি নাটকের দর্শক কমে যাওয়ার নানাবিধ কারণ আছে। প্রথম কারণটা হলো মনস্তাত্ত্বিক। আর এটাই প্রথম কারণ বলে আমি মনে করি, আমরা যারা টিভি নাটক লিখি বানাই অভিনয় করি বা যারা চ্যানেলের  অনুষ্ঠান বিভাগে কাজ করি বা নাটক প্রযোজনা ও পরিবেশনা করি তাঁদের কেউই আর নাটককে শিল্প হিসাবে নিচ্ছিনা।  সবাই এটাকে জীবীকার মাধ্যম হিসাবে দেখছি।  মুনাফা খুঁজছি নাটকের ভিতর, কত অল্প দিয়ে কত বেশী পাওয়া যায়। শিল্প যখন কেবল জীবীকার মাধ্যম হয় তখন সে শিল্প দর্শক বর্জন করবেই।

অভিনেত্রী, নির্মাতা রোকেয়া প্রাচী বলেন, অনেকেই বলছেন এখনকার নাটকের মান পড়ে গেছে, নাটক কেউই দেখছে না । আসলে আমি এই বিষয়গুলোর সঙ্গে একমত নই। নাটকের মান পড়েনি। বাজেটের কারণে ভালোমানের নাটক নির্মাণ হচ্ছে না। দিন যাচ্ছে শিল্পী কলাকুশলীদের সম্মানি বাড়ছে, সে তুলনায় টিভি নাটকের বাজেট বাড়ছে না। টেলিভিশনের বাজেট না থাকায় ভাল নাটক হচ্ছে না। তারপরও অনেক নির্মাতা ভাল কাজ করছেন । অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যে তরুণরা ভাল কাজ করছেন । নাটকের মান খারাপ হচ্ছে বললে, তাদের প্রতি অশ্রদ্ধা করা হবে । তবে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর নাটক প্রচারের ক্ষেত্রে গ্রেড নির্ধারণ উচিত। অন্যদিকে প্রতিনিয়ত যারা নাটক নির্মাণ করছেন, তারা ভালো বাজেট পাচ্ছে না । ফলে ভাল মানের নাটক তৈরি করতে পারছেন না নির্মাতারা।

তিনি যোগ করে আরো বলেন, সিঙ্গেল নাটক কমে গেছে । তাই ধারাবাহিক নাটকের নির্মাণ বেড়েছে। নাটক খুব যে দর্শক দেখছে না তা ঠিক নয়। এখনও ভালো নাটক প্রচার হলে ভালো রেসপন্স পাচ্ছি। সত্যি বলতে কী? চ্যানেল বেড়েছে, অতিরিক্ত বিজ্ঞাপন এবং বিদেশি চ্যানেলের অনুপ্রবেশ সব মিলিয়ে দেশীয় নাটকের প্রতি দর্শকের আগ্রহ কমে যাচ্ছে। বাংলাদেশের নাটকের কলাকুশলীরা অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যে দিয়ে ভাল ভাল কাজ করছেন।

অভিনেতা তারিক আনাম খান বলেন, এখন বিজ্ঞাপন নির্ভর হয়ে গেছে টেলিভিশন। তাই চ্যানেলের মার্কেটিং বিভাগ ঠিক করছে কোন নাটক যাবে আর কোন নাটক যাবে না। বিজ্ঞাপনদাতাদেরকেও ভাবতে হবে, দর্শক কি বিরক্ত হন, নাকি তারা বিজ্ঞাপনটা দেখেন? পুরো অবস্থাটা সব মিলিয়ে ভালো না। মানোন্নয়ন যদি না হয় তাহলে ক্রমান্বয়ে আমাদের বাজার বিদেশি চ্যানেলগুলো দখল করতে থাকবে, আমাদের তখন দেখা ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না।

অভিনেতা আনিসুর রহমান মিলন বলেন, এখন চ্যানেল বেড়েছে। অনেক কাজ হচ্ছে। সে ভিড়ে ভালো নাটকের সংখ্যা এখন কমে গেছে। সব মিলিয়ে টিভি নাটকে অস্থিরতা বিরাজ করছে।

অভিনেতা, নির্মাতা তৌকীরের মতে, নাটকের এই ক্রান্তিলগ্নেও ভালো নাটক দেখার আগ্রহ দর্শকের আছে। এটা আমরা বিশ্বাস করি। আমাদের নাটকের যে ঐতিহ্য আর সুনাম ছিলো সেটাকে আমরা ধরে রাখতে পারছি না এটা যেমন সত্য, সেটাকে হারিয়ে যেতে দেওয়া যাবে না এটা আরেকটা সত্য।চলমান সংকট থেকে উত্তরণের জন্য কিছু নীতিমালা দরকার।

অভিনেতা, নির্মাতা জাহিদ হাসানের মতে, চ্যানেলগুলো ঈদ এলে আমাকে বলে- অমুক ভাইয়ের(আরমান ভাই) মতো আরেকটা বানান না! আবার সিরিয়ালের সময় চ্যানেল বলে দেয়- একে নেন, ওকে নেন। এখন চ্যানেলের প্রোগ্রাম বিভাগের চেয়ে বেশি কথা বলতে হয় মার্কেটিং এজেন্সির সঙ্গে। কিন্তু তারা নাটক কী বুঝবেন? এজন্য মান পড়ে গেছে, দর্শকও ভারতমুখী হয়েছে। দোষ আমাদের সবার আছে। নাটকের জন্য অঙ্গীকার দরকার। আমরা যদি মনে করি সবাই একসঙ্গে আছি তাহলে সমস্যাগুলো ছোট হয়ে যায়। সবাইকে একত্রিত হতে হবে।

ডিরেক্টরস গিল্ডের সভাপতি গাজী রাকায়েতের মতে, কনটেন্ট যদি ভালো হয় তাহলে মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ে। মান যদি ঠিক থাকে, কনটেন্ট ভালো হলে দর্শক বাইরে যেতে পারবে না। এখন মুক্তবাজার অর্থনীতির সময়। এই অবস্থায় দর্শককে আটকে রাখা যাবে না। তবে সব পাখি ঘরে ফেরে। ফিরে আসতে হয়। আমাদের দর্শকরাও বিভিন্ন চ্যানেল ঘুরে নিজেদের সংস্কৃতিতে এসে ঘুমাতে চায়। কিন্তু তাকে আমরা ঘরে ফিরতে দেই না। দর্শক যখন ঘরে ফিরতে চায় তখন বিজ্ঞাপনের অত্যাচারে অপরিকল্পিত অনুষ্ঠানের কারণে আর ঘরে ফিরতে পারে না। তখন তারা অপসংস্কৃতি নিয়েই ঘুমিয়ে পড়ে।

অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী বলেন, আমাদের কাজের মধ্যে ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। মানসম্মত কাজ দিতে পারছি না বলেই হয়ত দর্শক কমে যাচ্ছে। একটা নাটক বানাতে হলে একজন ভালো পরিচালক লাগে, ভালো গল্প, ভালো শিল্পী এবং ভালো বাজেট লাগে। এগুলোর যেকোনো একটাতে সমস্যা হলেই পুরো নাটকের উপর প্রভাব পড়বে। আমাদের সব উপকরণের সঠিক প্রয়োগ হচ্ছে না বলেই নাটকের মান কমছে এবং দর্শকও স্বাভাবিক নিয়মে কমে যাচ্ছে। তাছাড়া বিদেশি সিরিয়াল বা চ্যানেলকে দোষ দেওয়ার আগে আমি বলবো আমাদের কাজের মান বাড়াতে। আমরা যদি ভালো কাজ দিতে পারি, তাহলে দর্শক আমাদেরটাই গ্রহণ করবে। ভালো কাজের জন্য একটা সুস্থ প্রতিযোগিতা দরকার। টিভি নাটকের দর্শক কমে যাওয়ার প্রসঙ্গে নির্মাতাদের অভিযোগ, তারা ভুগছে বাজেট সংকটে। বাজেটের কারণে তারা ভালো নাটক নির্মাণ করতে পারছেন না।

নির্মাতা সালাউদ্দিন লাভলু’র মতে আজ একটি নতুন কাজ করতে গেলে ভয় পাই। কারণ ইনভেস্টররা আমাদের যে পরিমাণ টাকা দেন তা দিয়ে ভালো একটি নাটক তৈরি করা কঠিন হয়ে যায়। তার মধ্যে আবার টিভি চ্যানেলগুলো সময়মতো টাকা দেয় না। এত প্রতিকূলতা পাড়ি দিয়ে একটা নাটক দর্শকের কাছে এসে পৌঁছায়। তবে নাটক দেখার সেই ‘ক্রেজি দর্শক’ কমে গেছে।

নির্মাতা চয়নিকা চৌধুরী বলেন, নাটক পরিচালনাটা একটা সময় আমার শখ ছিল কিন্তু এখন এটি আমার পেশা। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি এখন নাটকের এই বাজেটে কাজ করতে অনেক কষ্ট হয়। অভিনেতা- অভিনেত্রীদের বাজেট বেড়ে গেছে অনেকগুণ। আমার মনে হয়, এ বিষয়টি নিয়ে টিভি চ্যানেল ও প্রডিউসারদের এক টেবিলে বসতে হবে। তা না হলে আমারা ভালো মানের নাটক নির্মাণ করতে পারব না।

নির্মাতা রেদওয়ান রনি বলেন, আসল কথা হলো নাটকের বাজেট বাড়াতে হবে। এজন্য চ্যানেল, এজেন্সি এবং নির্মাতাদের সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। ভালো বাজেটের পাশাপাশি পরিচালকেরও অভাব আছে। টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর দায়িত্ব নিয়ে এ কাজ করার কথা। অথচ বেশিরভাগ চ্যানেলেই কোনো ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর নেই। টিভি নাটক থেকে কেন দর্শকরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন? এ নিয়ে দেশের গুনী নির্মাতা-কলাকুশলীদের বক্তব্যে নানা বিষয় উঠে এসেছে। সবাই নাটকের বাজেটকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। এছাড়া নাটকের মান বাড়াতে টেলিভিশন কর্তৃপক্ষকে এগিয়ে আসার বিষয়টিও তুলে ধরেছেন। নাটকের বাজেট বৃদ্ধি পেলে নাটকের মান বাড়বে এবং ভবিষ্যতে টিভি নাটক পুরনো ঐতিহ্য ফিরে পাবে বলে এমনটাই আশা সকলের।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn