বার্তাডেক্সঃ কিডনি বিকল। গুরুতর রোগীদের ডায়ালাইসিস করেই বেঁচে থাকতে হয়। কিন্তু অতি জরুরি এই চিকিৎসা ব্যবস্থার বেহাল দশা দেশে। ডায়ালাইসিস করতে হয় এমন রোগী আছে অন্তত ৫০ থেকে ৬০ হাজার। কিন্তু চিকিৎসাসেবা নিতে পারেন এর ২০ শতাংশ। অর্থাৎ ১২ থেকে ১৫ হাজার মানুষ চিকিৎসাসেবা নিতে পারছেন। যারা  সুযোগ পাচ্ছেন তারাও আছেন ভোগান্তিতে। কেউ কেউ এই সেবা নিতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন খরচের কারণে। ভিটেমাটি হারিয়েছেন কেউ কেউ। মো. লোকমান হোসেন। বয়স ৭০ বছর।

গ্রামের বাড়ি যশোরের চৌগাছা। প্রায় ৭ হাসপাতাল বদল করে গত রোববার রাতে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ভর্তি হন। বাবাকে ভর্তি করাতে এসে ৭টি হাসপাতালে হয়রানির শিকার হন লোকমানের ছেলে আরিফুল ইসলাম। পেশায় পার্টস ব্যবসায়ী। তিনি বলেন, বাড়তি টাকাও দিতে হচ্ছে আবার হয়রানিরও শেষ নেই। সম্প্রতি বাবার কিডনিতে সমস্যা দেখা দিলে প্রথমে যশোরের স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসা করাই। পরবর্তীতে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নিয়ে আসি। এখানে এনে রাতেই ভর্তি করানোর কথা বলে প্রথমে ৬ তলায় নিয়ে আসে। এরপর বলা হয় আপনাদের রোগীকে এখানে রাখা যাবে না। পরবর্তীতে মহাখালীর কিডনি ইনস্টিটিউটে পাঠায়। সেখানে গেলে বলা হয় এখানে ভর্তি করা যাবে না। ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যান। ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে গেলে সেখানেও ভর্তি করতে পারিনি। পরবর্তীতে বিভিন্নজনকে ধরে টাকা দিয়ে শেষ পর্যন্ত এখানে ভর্তি করাতে পেরেছি। বাবার চিকিৎসায় এখন পর্যন্ত প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। 

আমজাদুল হক। বয়স ৩১ বছর। ভাই-বোনদের মধ্যে ছোট। দেখতে সুদর্শন। এক সময় সিনেমা জগতের প্রতি প্রবল আকর্ষণের জায়গা থেকে সিনেমার হিরো হওয়ার স্বপ্ন দেখেন। এসএসসি পাস করে আর পড়াশোনা নিয়মিত করেননি। পরবর্তীতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে চাকরিতে যোগদান করেন। সরকারি চাকরি ভালো না লাগায় কিছু দিনের মধ্যে চাকরি ছেড়ে আরব আমিরাতে চলে যান। সেখানে যাওয়ার প্রায় এক বছরের মাথায় তার শরীরের এক অংশ প্যারালাইজড হয়ে যায়। কথা বলতে পারেন না। পরবর্তীতে দেশে ফিরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে চিকিৎসকরা জানান তার দুটো কিডনিই ড্যামেজ হয়ে গেছে। মা তার একটি কিডনি সন্তানকে দিয়ে বাঁচাতে চান। আমজাদকে নিয়মিত কিডনি ডায়ালাইসিস করাতে হয়। আমজাদুলের বাবাও সরকারি চাকরি করতেন। বিদেশে গিয়ে যে সামান্য অর্থ আয় করেছিলেন তা শেষ হয়েছে অনেক আগেই। এখন শেষ সম্বল বলতে পৈতৃক ভিটা। আমজাদ জানায়, শুরুর দিকে এনাম হাসপাতালসহ সাভারের বিভিন্ন প্রাইভেট হাসপাতালে ডায়ালাইসিস করাতেন। এতে পানির মতো টাকা খরচ হতে শুরু করে। এখন অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে পেটের খাবার জোটাবেন না ডায়ালাইসিস করাবেন ভেবে কুল পাচ্ছেন না। তিনি বলেন, ডায়ালাইসিস করার খরচ কম পড়ায় এখন সাভারের গণস্বাস্থ্যে নিয়মিত ডায়ালাইসিস করান। চিকিৎসার জন্য এখন পর্যন্ত প্রায় ১৭ লাখ টাকা খরচ করেছেন। আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে সাহায্য নিয়ে চিকিৎসা চালাচ্ছেন আমজাদ।

বেসরকারি হিসাব অনুযায়ী দেশে কিডনি রোগীর সংখ্যা দুই কোটির মতো। তাদের একটি অংশের অবস্থা এমন যে তাদের নিয়মিত ডায়ালাইসিস নিতে হয়। কিন্তু সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে এই সেবা পর্যাপ্ত না থাকায় এবং ব্যয় বেশি হওয়ায় অনেকে ডায়ালাইসিস নিতে পারেন না। তাদের ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে থাকতে হয়।

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ষষ্ঠ তলা। বেড নম্বর-১১। মেঝেতে বসে কালোজিরা ভর্তা দিয়ে স্বামীর জন্য ভাত মাখাচ্ছেন মো. ওমর ফারুকের স্ত্রী ফজিলা বেগম। গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলের সখীপুর। কিডনি বিকল। কথা বলতে পারে না। জড়িয়ে যায়। প্রথমে সবাই ভেবেছিল মাথার অসুখে ভুগছে। পরবর্তীতে স্থানীয় চিকিৎসকের কাছে নিলে জানায় ওমরের দুটো কিডনিই নষ্ট হয়ে গেছে। পেশায় দিনমজুর। থাকেন সরকারি জমিতে। সম্বল বলতে নিজেদের একটি নসিমন গাড়ি। ছোট ছেলে হাইস্কুলে পড়ে। বড় ছেলে বাবার অর্থের জোগান দিতে এখন দিনমজুরের কাজ করছে। কখনো আবার অটোরিকশা চালাচ্ছেন। যেভাবেই হোক বাবাকে বাঁচাতে হবে। ময়মনসিংহের স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসার পর ঢাকায় স্থানান্তরের পরামর্শ দেন চিকিৎসক। এরপর এলাকার বিত্তশালী আর আত্মীয়দের কাছ থেকে সাহায্য তুলে ২০ হাজার টাকা নিয়ে স্বামীকে নিয়ে ঢাকায় আসেন স্ত্রী ফজিলা। গত ৮ দিন আগে হাসপাতালে ভর্তি হন। তিনটি ডায়ালাইসিসসহ চিকিৎসা শেষে এখন হাতে অবশিষ্ট আছে মাত্র ৪ হাজার টাকা। এটা দিয়ে কতোদিন স্বামীর চিকিৎসা চালাতে পারবেন জানেন না ওমর ফারুকের স্ত্রী।

পাশের বেডের কর্নারে ছেলের মাথার কাছে বসে কাঁদছেন ২৪ বছর বয়সী যুবক সোহেলের মা ফাতেমা খাতুন। বেশ কয়েক মাস ধরে অসুস্থ সোহেল। চিকিৎসকরা রোগ নির্ণয় করতে পারছেন না। গত সোমবার চিকিৎসকরা কিডনি থেকে মাংস পরীক্ষা করেছেন। সোহেলের মা বলেন, গ্রামের বাড়ি নরসিংদীর রায়পুরা থানা। আগে সে নসিমন গাড়ি চালাতো। চার ছেলে মেয়ের মধ্যে ছোট। গাড়ি থেকে পড়ে গিয়ে কোমরের হাড়ে আঘাতপ্রাপ্ত হয়। পরবর্তীতে কিডনি জটিলতা দেখা দিলে মহাখালীর কিডনি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়। সেখান থেকে সোহরাওয়ার্দীতে পাঠানো হয়। সহায় সম্বল বলতে এখন আর কিছু অবশিষ্ট নেই। নিজের একখণ্ড জমি ছিল সেটাও বিক্রি করে দিয়েছেন। এখন পর্যন্ত প্রায় আড়াই লাখ টাকার মতো খরচ হয়েছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছে সোহেলের সুস্থতায় আরও প্রায় ৭ লাখ টাকা লাগবে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসা নেন নুরুল। গত ৭ মাস আগে কিডনি রোগে আক্রান্ত হন। পরীক্ষায় দুটো কিডনিই নষ্ট হয়ে গেছে বলে জানায় চিকিৎসক। এখানে প্রতিটি ডায়ালাইসিসের জন্য প্রায় ২ হাজার ৭শ টাকা খরচ হয়। গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালী। দুই মেয়ে স্ত্রীকে নিয়ে সংসার। ছেলে নেই। সুস্থ থাকাকালীন ভবন মেরামতের ঠিকাদারি করতেন। নুরুল বলেন, ওখানে ডায়ালাইসিস করাতে হলে প্রথমে আবেদন করতে হয়। এরপর চিকিৎসকদের মর্জি হলে শিডিউল মেলে। এভাবে দীর্ঘদিন চিকিৎসা চলে। একপর্যায়ে দুই লাখ টাকা খরচ হয়ে যায়। পরবর্তীতে হাসপাতাল বদলে সোহরাওয়ার্দীতে ভর্তি হই। এখানে আসার পর প্রথম দিন প্রায় ১৬শ’ টাকার ডায়ালাইসিস সরঞ্জাম ক্রয় করতে হয়েছে। ৪শ’ টাকা ডায়ালাইসিস ফি এবং ২শ’ টাকা তাদের বকশিশ। পরের ডায়ালাইসিসে ২৫০ টাকার সরঞ্জাম ডায়ালাইসিস ফি ৪শ’ এবং ১শ’ টাকা বকশিশ। সরকারি খরচ এখানে ৪শ’ টাকা বললেও এখানে দুই থেকে তিনগুণ বেশি খরচ দিতে হচ্ছে। এখন পর্যন্ত প্রায় ২ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। সম্বল বলতে নিজের ভিটা ছাড়া আর কিছু নেই। শুরুতে সিদ্ধান্ত নেই আর চিকিৎসা করাবো না। বিনা চিকিৎসায় মারা যাবো। তাতে অন্তত মেয়ে দুটোর বিয়ে দেয়া যাবে। মেয়েদের বিয়ে দেয়া তাদের পড়ালেখা করানো নিজের চিকিৎসা খরচ কীভাবে চালাবেন কিছুই জানেন না তিনি।

বাংলাদেশে প্রায় ২ কোটি মানুষ নানাবিধ কিডনি রোগে আক্রান্ত বলে গত বছরের নভেম্বরে জানিয়েছেন কিডনি ফাউন্ডেশন। প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক ডা. হারুন আর রশিদ বলেন, আক্রান্তদের মধ্যে প্রতি বছর ৪০ হাজার মানুষের কিডনি বিকল হয়। আরও প্রায় ২০ হাজার রোগী হঠাৎ কিডনি বিকল হয়ে মারা যায়। এদের মধ্যে ৭৫ ভাগই মৃত্যুবরণ করে। এর প্রধান কারণ ডায়ালাইসিস অথবা কিডনি সংযোজনের চিকিৎসার অভাবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় গত ৩০ বছর ধরে ডায়ালাইসিস ও কিডনি সংযোজন করে আসছে।

এ বিষয়ে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পরিচালক ডা. মো. খলিলুর রহমান বলেন, আমাদের এখানে ভবনের ৬ষ্ঠ তলায় ২০ শয্যাবিশিষ্ট ডায়ালাইসিস কক্ষ রয়েছে। সেখানে নারী-পুরুষ উভয় রোগীকেই সরকার নির্ধারিত ফি দিয়ে সম্পূর্ণ সরকারিভাবে ডায়ালাইসিস করানো হয়। এক্ষেত্রে একজন রোগীকে ৬ মাসের জন্য ২০ হাজার টাকা দিতে হয়। তারা চাইলে প্রতি ডায়ালাইসিস হিসেবে সরকারি খরচ ৪শ’ টাকা করে দিতে হয়। রোগীদের নিজেদের অর্থে ডায়ালাইসিস সরঞ্জাম ক্রয় এবং অতিরিক্ত খরচ নেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখানে সরকার নির্ধারিত ফির বাইরে রোগীর অতিরিক্ত খরচ কিংবা ঝামেলার কোনো সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে কোনো রোগী যদি নিজেকে দুস্থ প্রমাণ করতে পারে তাদেরকে সরকারিভাবে আবেদন করে ফ্রি ডায়ালাইসিসের ব্যবস্থা করার সুযোগ রয়েছে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক মানবজমিনকে বলেন, এখানে সরকারিভাবে একজন কিডনি আক্রান্ত রোগীকে ৬ মাসের জন্য ডায়ালাইসিস করাতে ২০ হাজার টাকা দিতে হয়। এক্ষেত্রে গড়ে প্রতিটি ডায়ালাইসিস ৪শ’ টাকার কিছু কম খরচ আসে। এই টাকার মধ্যে যতগুলো ডায়ালাইসিস রোগীর দরকার সবগুলোই নিতে পারবে। আনলিমিটেড বলা যায়। কোনো কারণে রোগী যদি নিজে কোনো সরঞ্জাম কিনতে চায় সেটা তার ইচ্ছা। ঢাকা মেডিকেলে প্রতিদিন প্রায় ৪০ জন রোগীকে ডায়ালাইসিস করার সক্ষমতা রয়েছে বলে জানান তিনি। ডায়ালাইসিস সম্পর্কে বিএসএমএমইউ’র ভিসি অধ্যাপক শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, আমাদের এখানে প্রতিটি ডায়ালাইসিসের বিপরীতে ১৯শ’ থেকে ২৫শ’ টাকা পর্যন্ত খরচ আসে। হাসপাতালটিতে প্রায় ২০টির মতো শয্যা রয়েছে। আমাদের যে নিজস্ব মেশিন রয়েছে তাতে প্রতিদিন গড়ে ২০ জনকে ডায়ালাইসিস করা যায়। কোনো রোগী যদি এই অর্থ দিয়ে ডায়ালাইসিস করাতে না পারেন সেক্ষেত্রে সমাজকল্যাণের তহবিলের অর্থ সহায়তার মাধ্যমে চিকিৎসা করার ব্যবস্থা রয়েছে।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn