মিজানুর রহমান-যুদ্ধ-সংঘাত বা উস্কানির কারণে বিশ্ব পরিস্থিতি যতই ঘোলাটে হোক না কেন সেটি মোকাবিলা করে এগিয়ে যাওয়ার সক্ষমতা বেইজিংয়ের রয়েছে- এমন বার্তা দিয়েই ১৭ ঘণ্টার স্বপ্রণোদিত ঢাকা সফর শেষ করলেন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই। একইসঙ্গে তিনি চীনের ইতিবাচক সব উদ্যোগে বাংলাদেশের মতো বন্ধু রাষ্ট্রগুলোকে পাশে চাইলেন। দাবি করলেন, আচমকা সৃষ্ট তাইওয়ান পরিস্থিতিতে চীন যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে সেটাও ভবিষ্যৎ শান্তি এবং সমৃদ্ধির জন্যই। দীর্ঘ সময় ধরে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বপালনকারী ওয়াং ই অনেকটা আফসোসের সুরে বলেন, আজ চীন, বাংলাদেশ তথা উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোর ভাগ্য এক সুঁতোয় বাঁধা পড়েছে! ব্যাখ্যায় তিনি পশ্চিমাদের প্রতি অভিযোগের আঙ্গুল তুলে বলেন, পরিস্থিতি এমন ঠেকেছে যে, যারা ইতিমধ্যে উন্নতি করেছে এবং শক্তিমত্তা অর্জন করে নিয়েছে তারা কার্যত অন্য কারও সমৃদ্ধি পছন্দ করে না। এ অবস্থায় চীন, বাংলাদেশ তথা উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া বাড়ানো জরুরি উল্লেখ করে তিনি ঢাকার যেকোনো সংকটে বেইজিংয়ের ত্বরিত পদক্ষেপের অঙ্গীকার করেন। সুনির্দিষ্টভাবে ৩ ইস্যুতে বাংলাদেশের পাশে শক্তভাবে থাকার ঘোষণা দেন।
কূটনৈতিক সূত্র বলছে, আনুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাণিজ্য, বিনিয়োগ তথা অর্থনৈতিক সাপোর্ট, টেকনোলজিক্যাল সাপোর্ট এবং পলিটিক্যাল সাপোর্ট- নিয়ে সর্বাত্মকভাবে বাংলাদেশের পাশে থাকার স্পষ্ট অঙ্গীকার করেন। সফরকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেনের সঙ্গে একান্ত এবং আনুষ্ঠানিক বৈঠক করেন ওয়াং ই। গতকাল সকালে রাজধানীর একটি হোটেলে দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রাতঃরাশ বৈঠক শেষে গণমাধ্যমে ব্রিফ করেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম এমপি। দুই মন্ত্রীর আনুষ্ঠানিক আলোচনাকালে অন্যান্যের মধ্যে তিনি উপস্থিত ছিলেন। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, চীন পৃথিবীর সব রাষ্ট্রের জন্য একটি অভিন্ন ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার লক্ষ্যে যৌথ সহযোগিতা চায়।
এ উদ্যোগে তারা বাংলাদেশকে পাশে চায়। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আলোচনায় উল্লেখ করেছেন, কিছু রাষ্ট্র আছে, যারা ভুল বোঝে বা চীনকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করে। ওই বিষয়ে কিছুটা কথা হয়েছে। ওয়াং ই এমন এক সময়ে ঢাকায় এলেন, যখন তাইওয়ান ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। চীনের প্রেসিডেন্ট সমপ্রতি গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ (জিডিআই) এবং গ্লোবাল সিকিউরিটি ইনিশিয়েটিভের (জিএসআই) মতো উদ্যোগের ঘোষণা দিয়েছেন।
চীন এসব উদ্যোগে বাংলাদেশকে পাশে চায়। এ বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে কিনা- জানতে চাইলে শাহরিয়ার আলম বলেন, ‘এটা একটি রুদ্ধদ্বার বৈঠক। নিয়ম অনুযায়ী তারা যেটা বলেছেন, তা জনসমক্ষে কতোটা আনা হবে, সেটা তাদের বিষয়। অবশ্যই এ ব্যাপারে (তাইওয়ান, জিডিআই ও জিএসআই) বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। তারা এসব বলেছেন। এটা আলোচনার বিষয় নয়। আমাদের অগ্রাধিকারে আরও অন্যান্য বিষয় আছে। তবে তারা তাদের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছেন। রোহিঙ্গা সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানে চীন কাজ করে যাবে বলে উল্লেখ করে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আলোচনায় আব্দুল মোমেন রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের বিষয়টি তুলেছিলেন। মন্ত্রী মোমেন বলেছেন, এ ক্ষেত্রে চীনের জোরালো সহযোগিতা প্রয়োজন। চীন এ সমস্যা সমাধানে এগিয়েছে। এর চূড়ান্ত সমাধান হওয়া দরকার। শাহরিয়ার আলম বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিস্তারিত আলাপ হয়েছে। চীন বলেছে, সে দেশের অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ দূর করার চেষ্টা করছে। সেটা শুধু বাংলাদেশ নয়, অনেকেরই সমস্যা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে রোহিঙ্গা সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানে চীন অব্যাহতভাবে কাজ করে যাবে। এ নিয়ে আরেক প্রশ্নের উত্তরে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা পরিষ্কারভাবে বলেছি, অনেকদিন হয়ে গেল, আমাদের দুর্ভোগের মাত্রা বেড়েছে।
সেটা শুধু স্থানীয় জনগোষ্ঠীই নয়; রোহিঙ্গা শিবিরে মাদক ও অস্ত্র পাচার বেড়েছে। আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রচণ্ড ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছে। সেখানকার ক্রমাবনতিশীল পরিস্থিতি আমাদের অবশ্যই থামাতে হবে।’ আলোচনার বিষয়ে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম আরও বলেন, চীনের বাজারে বাংলাদেশের পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধার পরিধি আরও ১ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। এটি আগামী ১লা সেপ্টেম্বর থেকে কার্যকর হবে। আমরা আশা করি, বাড়তি এই শতাংশে বাংলাদেশের টেক্সটাইল ও গার্মেন্টস খাতের ওভেন প্রোডাক্টসের যে সীমাবদ্ধতা ছিল, সেটা দূর হবে। আমরা হয়তো তালিকাটা পাবো। আমার মনে হয়, এ সফরে আমাদের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি এটি। অতিরিক্ত ১ শতাংশ পণ্য ও সেবা, যেটা আমাদের তারা শুল্কমুক্ত সুবিধা দেবে। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্ভাব্য অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি বা অগ্রাধিকারমূলক শুল্ক চুক্তির বিষয়ে একটি যৌথ সমীক্ষা শুরুর বিষয়ে আলোচনা হয়েছে জানিয়ে শাহরিয়ার আলম বলেন, চট্টগ্রামের আনোয়ারায় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে চীনের কারখানা ও প্রযুক্তি স্থানান্তরে সহায়তা করবেন বলে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে দ্রুত চালুর বিষয়ে বাংলাদেশকে যথেষ্ট ব্যবস্থা নেয়ার তাগিদ দিয়েছেন। তিনি জানান, আলোচনায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী চীনের বিনিয়োগ বাড়ানোর অনুরোধ জানিয়েছেন।
বাণিজ্য বৈষম্য দূর করাটা আলোচনায় একটি বড় ইস্যু ছিল। এদিকে আনুষ্ঠানিক এবং দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মধ্যকার একান্ত বৈঠকের পর ঢাকা ও বেইজিং বিভিন্ন সহযোগিতার বিষয়ে ৪টি সমঝোতা স্মারক ও চুক্তি হয়। স্বাক্ষরিত নথির মধ্যে অবকাঠামো উন্নয়ন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, সাংস্কৃতিক বিনিময় এবং সমুদ্র বিজ্ঞানে সহযোগিতার বিষয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে এশিয়া একসঙ্গে কাজ করতে পারে: প্রধানমন্ত্রী ওদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে সৃষ্ট চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও চীন একসঙ্গে কাজ করতে পারে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, নিষেধাজ্ঞা-অবরোধ ও পাল্টা নিষেধাজ্ঞা ও অবরোধের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এসব কারণে সারা বিশ্বের মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও চীন একসঙ্গে কাজ করতে পারে।’ চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তার সরকারি বাসভবন গণভবনে রোববার সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে গেলে এসব কথা বলেন। বৈঠককালে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, তার দেশ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ইস্যুতে সমর্থন দেবে এবং একটি কৌশলগত অংশীদার হিসেবে বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নে তাদের সহযোগিতা অব্যাহত রাখবে। বৈঠকের পর প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন।
শেখ হাসিনা বলেন, জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং এই সংকট নিরসনে বাংলাদেশ চীনের সহযোগিতা চায়। চীনা মন্ত্রী আশা প্রকাশ করেন, রোহিঙ্গা ইস্যুটি বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান হবে। তিনি আরও বলেন, ‘তৃতীয় পক্ষের সম্পৃক্ততার প্রয়োজন হলে চীন তার ভূমিকা পালন করবে।’ তিনি উল্লেখ করেন, তারা এখন মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বাসস্থান নির্মাণ করছে। চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশের অভূতপূর্ব উন্নয়নের ভূয়সী প্রশংসা করেন। তিনি আরও বলেন, ডিজিটাল অর্থনীতির উন্নয়নেও চীন বাংলাদেশকে সাহায্য করবে। ওয়াং ই প্রধানমন্ত্রীর কাছে তাইওয়ান ইস্যুতে তাদের অবস্থান ব্যাখ্যা করেন। এ সময় শেখ হাসিনা বাংলাদেশ ‘এক চীন নীতিতে’ বিশ্বাসী এ কথা পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে তার বন্ধুত্বকে মূল্যায়ন করে। যে সব বাংলাদেশি শিক্ষার্থী কোভিড-১৯ মহামারির সময়ে চীন থেকে দেশে ফিরে এসেছে প্রধানমন্ত্রী তাদের পড়াশুনার জন্য ফিরে যাওয়ার পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্যও ওয়াং ইকে অনুরোধ করেন যাতে করে তারা তাদের শিক্ষা সম্পন্ন করার সুযোগ পায়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৫২ ও ১৯৫৭ সালের চীন সফরের কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, বঙ্গবন্ধু পিপল’স রিপাবলিক অব চায়নার প্রতিষ্ঠাতা মাও সে তুংয়ের গুণমুগ্ধ ছিলেন। বঙ্গবন্ধু তার ‘আমার দেখা নয়াচীন’ বইয়ে তা উল্লেখ করেছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীনের প্রেসিডেন্টকে শুভেচ্ছা জানান এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ভিডিও বার্তা দেয়ায় তাকে ধন্যবাদ জানান। ওয়াং ই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানান। কমিউনিস্ট পার্টি অব চায়নার ১০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বার্তা পাঠানোর জন্য চীনা প্রেসিডেন্ট শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। এ সময় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস, প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম ও বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত লি জিমিং।
চীনগামী বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের ভিসা দেয়া শুরু: এদিকে করোনা মহামারিতে চীন থেকে দেশে এসে অন্তত পাঁচ হাজার শিক্ষার্থী বাংলাদেশে আটকা পড়েছিলেন। আগামী দু-একদিনের মধ্যে চীনে ফেরত যাওয়ার অপেক্ষায় থাকা এসব শিক্ষার্থীর ভিসা দেয়া শুরু হবে। ঢাকায় রোববার দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে এ নিয়ে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম বলেন, ‘আনন্দের সঙ্গে জানাতে চাই, চীনে যাত্রা বন্ধ থাকায় কয়েক হাজার শিক্ষার্থী দেশে অপেক্ষায় ছিলেন। আমরা তাদের সঙ্গে অব্যাহত যোগাযোগের মধ্যে ছিলাম। দু-একদিনের মধ্যে চীনে ফেরত যেতে আগ্রহী শিক্ষার্থীদের ভিসা দেয়া শুরু হবে।’
সংবাদ টি পড়া হয়েছে :
১০৮ বার