ঢাবি প্রতিনিধি:ছবি দেখে মনে হতে পারে, গৃহযুদ্ধে বিপর্যস্ত সিরিয়া থেকে আসা অসহায় মানুষের দল বাঁচার আশায় ইউরোপের কোনো সীমান্তে  খোলা আকাশের নিচে শিবির গেড়েছে। অথবা মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণের জেলা টেকনাফে আসা রোহিঙ্গা মুসলিম শরণার্থীদের শিবিরের ছবি এটি। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ছবিটি প্রাচ্যের অক্সফোর্ড হিসেবে খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্যবাহী সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের, যেখানে শিক্ষার্থীরা হলের বারান্দায় গণশিবির ফেলেছে। সেখানে তাদের নিদারুণ জীবনযাপনের ছবি দেখলে যে কেউই মর্মাহত হবেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্নচারী এই ছেলেগুলোও যেন নীলকণ্ঠ। গরমের দিনে প্রচণ্ড গরম, শীতের দিনে হাড় কাঁপানো ঠান্ডা, বৃষ্টিবাদলার ঝাপটা আর নিত্যযন্ত্রণা ছাড়পোকার আগ্রাসন- এত সব সইয়ে জীবনের লক্ষ্যে পৌঁছার সংগ্রাম করে যাচ্ছেন।

সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের এই ছবিটা আপনি ধরে নিতে পারেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সব হলের গণরুমের প্রতীক হিসেবে। একটু উনিশ-বিশ ছাড়া ছাত্র-ছাত্রী প্রায় সব হলের চিত্র একই। দেশের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠের শ্রেষ্ঠ মেধাবী সন্তানরা এভাবে দিনের পর দিন কাটিয়ে দিচ্ছেন, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ওই সব শিক্ষার্থীর প্রতি সহানুভূতি দেখানো ছাড়া যেন আর কিছু করার নেই। তারা বলছে, শিক্ষার্থীদের জন্য হলে আবাসন নিশ্চিত করার সদিচ্ছা থাকলেও নানা কারণে সংকট উতরাতে পারছেন না তারা। আর এই সংকট পুরোপুরি নিরসন করা সম্ভবও নয় কখনো। তবে তারা নতুন হল নির্মাণের চেষ্টা করছেন।

ঢাবির  বিভিন্ন হল ঘুরে দেখা যায়,  কোনো হলে ৪-৫ বেড বিশিষ্ট এক রুমেই ২০-২৫ জন অবস্থান করছে। আবার কোনো কোনো হলে এক রুমে ৩০-৩৫ জন। এই গরমের দিনে গণরুমের কেউ কেউ অসহ্য হয়ে মসজিদের বারান্দায় ও হলের ক্যান্টিনে গিয়ে রাত কাটাচ্ছেন। ফলে  শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যের অবনতির পাশাপাশি ব্যাঘাত ঘটছে পড়ালেখায়। ফলে অনেক শিক্ষার্থীর একাডেমিক ফল ভালো হচ্ছে না। এস এম হলের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী বাপ্পি জানান, গরমের দিনে হলের বারান্দায় গাদাগাদি করে থাকাটা কী যে কষ্টের তা বোঝানো সম্ভব নয়। বৃষ্টির দিনে বিছানা ভিজে যায় পানিতে।  খোলা বারান্দায় নিরাপত্তাজনিত সমস্যার কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্যার এ এফ রহমান হলের দ্বিতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমাদের এই মানবেতর জীবনযাপন দেখেও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।  ফলে দিনে দিনে বেড়েই চলেছে দুর্ভোগ ।’

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, হলগুলোতে শিক্ষার্থীর সংখ্যার তুলনায় পর্যাপ্ত আসন না থাকায় আবাসন সংকটে পড়ছেন প্রায় ২০ হাজার শিক্ষার্থী।  রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় হলগুলোতে অবৈধ বহিরাগত ও নেতাদের বছরের পর বছর অবস্থান এই সংকটকে আরো প্রকট করেছে। আবাসিক হলগুলোর হিসাব অনুযায়ী, ছাত্র হলগুলোতে মোট আসন রয়েছে ৭ হাজার ৮৫৪টি। বিপরীতে যেখানে অবস্থান করছেন সাড়ে ১১ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী। এটি হল কর্তৃপক্ষের খাতাপত্রের হিসাব। এর বাইরে রাজনৈতিক ছায়ায় হলে অবস্থান করছেন আরো কয়েক হাজার শিক্ষার্থী ও বহিরাগত।

আসনের হিসাবে সবচেয়ে বড় শহীদল্লা হল- ১ হাজার ২২৬টি আসন সেখানে। এর পরে রয়েছে নবনির্মিত বিজয় একাত্তর হল- ১ হাজারটি আসন। অন্যগুলোর মধ্যে মাস্টারদা সূর্য সেন হলে ৫৭৭টি, কবি জসীম উদদীন হলে ৩৯৭টি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে ৪৫০টি, জিয়াউর রহমান হলে ৪৮৪টি, হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলে ৫৪০টি, স্যার এ এফ রহমান হলে ৪৯৬টি, শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে ৭২৫টি, সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে ৪০৫টি, ফজলুল হক মুসলিম হলে ৭৬৬টি, অমর একুশে হলে ৬২৫টি এবং আইবিএ হোস্টেলে ৮৬টি ও শাহনেওয়াজ ছাত্রাবাসে ৭৭টি আসন রয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক  নিয়ম অনুযায়ী, একজন ছাত্র তৃতীয় বর্ষ থেকে হলে আবাসিক ছাত্র হিসেবে থাকার সুযোগ পান। কিন্তু দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এখানে পড়তে আসা শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। তাদের বেশির ভাগের পক্ষে বাসাভাড়া নিয়ে হলের বাইরে থাকা সম্ভব নয়। ফলে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই তারা ঢাবির  ছাত্রলীগ নিয়ন্ত্রিত হলের গণরুমে গাদাগাদি করে অবস্থান নেন।

হলে গণরুম বলতে সাধারণত অনেক শিক্ষার্থী একসঙ্গে এক রুমে থাকাকে বোঝায়। ঢাবির প্রতিটি হলে কমবেশি গণরুম আছে। এসব গণরুম এখন ছাত্রলীগ নিয়ন্ত্রিত। এই সংগঠনের নেতাকর্মীর হাত ধরে এসব রুমে শিক্ষার্থীরা ওঠেন। নেতারা নিজের দল ভারী করার জন্য গণরুমে শিক্ষার্থীদের থাকতে দেন। বিনিময়ে তারা নেতাদের মিছিল-মিটিংয়ে অংশ নেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হলের কয়েকজন ছাত্র জানান, মিছিল-মিটিংয়ে না গেলে চোখের সামনে ঝুলে হল থেকে বের করে দেয়ার হুমকি। আর যারা প্রতিদিন প্রোগ্রাম করবে তাদের সামনে ঝুলে সবার আগে গণরুম  থেকে রুমে সিট দেয়ার মুলা।

দেশের এই শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠে যেখানে মুক্তবুদ্ধির চর্চা আর গবেষণা নিয়ে ব্যস্ত থাকার কথা শিক্ষার্থীদের, সেখানে তাদের ব্যস্ত থাকতে হয় দলীয় কর্মসূচিতে।

মেয়েদের হলেও গণরুম

ছেলেদের হলের মতো এত ব্যাপক না হলেও মেয়েদের কিছু হলেও গণরুম ব্যবস্থা চালু আছে। প্রশাসনের নজরদারি বেশি থাকায় মেয়েদের হলে ছাত্ররাজনীতির প্রভাব অতটা প্রকট নয়। তরে গণরুমের নিয়ন্ত্রণ একেবারে হাতছাড়া নয় ছাত্রলীগের। ছাত্রীসংখ্যার তুলনায় আসনস্বল্পতার কারণে আবাসন সংকট বড় আকারে দেখা দিয়েছে।

হল সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত ছাত্রীসংখ্যা প্রায় সাড়ে ১৩ হাজার। আর ৫টি ছাত্রী হল ও দুটি ছাত্রী হোস্টেলে আসন আছে ৫ হাজার ২২৩টি। ছাত্রী হলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় রোকেয়া হলে আসন রয়েছে ১ হাজার ৬১৮টি। এ ছাড়া কবি সুফিয়া কামাল হলে ১ হাজার ৬২৬টি, শামসুন্নাহার হলে ৬৮৮টি, কুয়েত মৈত্রী হলে ৬৬১টি, ফজিলাতুন্নেসা মুজিব হলে ৪১০টি এবং নবাব ফয়জুন্নেসা ছাত্রী হোস্টেলে ১২০টি ও লেদার টেকনোলজি ইনস্টিটিউটের ছাত্রীদের আবাসনের জন্য নির্মিত সুলতানা কামাল হোস্টেলে ১৫০টি আসন রয়েছে। শামসুন নাহার হলের  দ্বিতীয় বর্ষের একজন শিক্ষার্থী  বলেন, গণরুমে থাকা অনেক কষ্টকর, এই কষ্ট গণরুমে না থাকলে কেউ উপলব্ধি করতে পারবে না।

গণরুমে পড়াশোনার সমস্যার কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘অনেক শিক্ষার্থী একসাথে থাকায় হলের গণরুমে এমনিতেই পড়ালেখার পরিবেশ নেই। তার ওপর রুমের মধ্যে সহপাঠীরা উচ্চস্বরে  গান শুনে বলে রাতে ঠিকমতো ঘুমানো সম্ভব হয় না। ফলে প্রায় সময় সকালের ক্লাসে যেতে বিলম্ব হয়। এই হলের গণরুমের নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে আরেকজন শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমাদের হলে উঠতে হলে গণরুমের মাধ্যমে উঠতে হয়। এই হলের মোট আটটি গণরুমের মধ্যে ৭টি হল প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করে, আর বাকি একটি ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে।’ যারা ছাত্রলীগের গণরুমে থাকে, তাদের আগে হলে সিট  দেওয়া হয় বলে জানান তিনি।

আবাসন সংকটের ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, আবাসন সমস্যা পুরো সমাধান করা কোনোদিনই সম্ভব না।  তারপরও আমরা চেষ্টা করছি কিছুটা হলেও সমস্যার সমাধান করতে। যাদের খুব বেশি সমস্যা অন্তত তারা যাতে হলে থাকতে পারে, সেজন্য আমরা নানা পদক্ষেপ নিয়েছি। ইতোমধ্যে আমরা হলগুলোর সিট বাড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছি। তাছাড়া রোকেয়া হল ও বঙ্গবন্ধু হলে ইতোমধ্য এক্সটেনশন ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে।’ হলে বহিরাগত ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন শিক্ষার্থীদের অবস্থানের ব্যাপারে উপাচার‌্য বলেন,  ‘তাদের  বিরুদ্ধে  ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য হল প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn