তসলিমা নাসরিন এর কলাম
পুরুষের পৃথিবীতে কেউ নিরাপদ নই, না গৃহকর্ত্রী, না গৃহকর্মী
পুরোনো ঢাকার দরিদ্র দর্জি বিশ্বজিৎ দাসের হত্যাকাণ্ডের একটি ভিডিও দেখলাম। নিরপরাধ নিরীহ ছেলেটি বাঁচার জন্য কী আপ্রাণ চেষ্টাই না করছিল। আর যেভাবে উন্মাদের মতো ওকে মারা হচ্ছিল, কোপানো হচ্ছিল — রড দিয়ে, চাপাতি দিয়ে – দেখে হাতপা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। যারা ওকে নির্যাতন করেছে, হত্যা করেছে — তারা সবাই কিন্তু পুরুষ ছিল।
দেখেছি রাস্তায় পড়ে আছে প্রগতিশীল যুবক অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর রহমান, অনন্ত বিজয় দাস, রাজিব হায়দার। কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে ওদের। দেখেছি নিলয়, জুলহাসের রক্তাক্ত শরীর। হত্যাকারীরা সকলেই পুরুষ। গুলশান ক্যাফের ঘটনা নিশ্চয়ই কেউ ভুলে যায়নি। শুধু গুলি করেই তৃষ্ণা মেটেনি ওদের, সবারই গলা কেটেছে। জঙ্গিরা সবাই পুরুষ ছিল, মেয়ে নয়।
প্রতিদিন যারা মানুষকে নির্যাতন করছে, ধর্ষণ করছে, হত্যা করছে – তারা প্রায় সবাই পুরুষ। সারা পৃথিবীতে যুদ্ধ লেগেই আছে, মানুষের দিকে গ্রেনেড ছুঁড়ছে, গুলি ছুঁড়ছে, বোমা ছুঁড়ছে, তীর ছুঁড়ছে — পুরুষ। ঘরে ঘরে অত্যাচার চলছে, স্ত্রীকে কেটে টুকরো টুকরো করে ফ্রিজে ভরে রাখছে, স্ত্রীর শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন জ্বেলে দিচ্ছে। রাস্তাঘাটে কারো পেটে ছুরি বসাচ্ছে, কারো বুকে গুলি করছে, পকেটমারকে পিটিয়ে মেরে ফেলছে কারা? পুরুষ। আমরা জানি ক্রাইম যত হয়, রিপোর্ট তত হয় না। পুলিশের খাতায় ২০০২ থেকে ২০১৫ সাল অবধি ক্রাইমের সংখ্যাটা একবার একটু দেখি —ডাকাতি ১০৭৩৮টি। দস্যুতা ১৫৮৯৫। খুন ৫৫৮২৫। দাঙ্গা ৫৩১৫। অপহরণ ১১৮৮৭। নারী নির্যাতন ২৪৩৩৭৩। পুলিশের নির্যাতন ৬৬৪১। দরজা জানালা ভেঙ্গে ঘরে ঢুকে চুরি ৪৭১৩৩। চুরি ১২৩২৫৪। অন্যান্য অপরাধ ১১৫৬৭৮৬। অস্ত্র অপরাধ ২২৫৬৮৭। বোমা বাজি ৬১৪৮। মাদক অপরাধ ৩৪১১৭৭। অবৈধ পাচার ৮১৫৩৫। মোট অপরাধ সংখ্যা– ২১৫৭২৫৬।
এত যে লক্ষ লক্ষ অপরাধ, এগুলো করেছে কে? পুরুষ না নারী? উত্তর কিন্তু আমরা সবাই জানি। হাতে গোনা কয়েকটি ছাড়া সবই করেছে পুরুষ। কিন্তু গৃহকর্ত্রীরা যখন গৃহকর্মীকে নির্যাতন করে, আমরা আঁতকে উঠি। আমরা পুরুষের বর্বরতা দেখে অভ্যস্ত, নারীর কাছে বর্বরতা আশা করি না বলে দেখলে বিস্মিত হই!
গত পাঁচ বছরে ১৭০ জন গৃহকর্মীকে মেরে ফেলা হয়েছে। আহত করা হয়েছে ১৬৫ জনকে। মোট নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে প্রায় ৩৫০টি। দেশজুড়ে গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনা নিশ্চয়ই আরও অনেক ঘটেছে। কিন্তু পুলিশ রিপোর্ট নেই। শুনেছি কিছু ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে। আদুরী নামের এক গৃহকর্মীকে নির্যাতন করার কারণে গৃহকর্ত্রী নওরীনের যাবজ্জীবন কারাদন্ড হয়ে গেছে। আরও একটি ভালো খবর শুনলাম, গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনায় তাৎক্ষনিক ব্যবস্থা নিচ্ছে সরকারের তৈরি ‘গৃহকর্মী বিষয়ক কেন্দ্রীয় মনিটরিং সেল’। এই সেলের পক্ষ থেকে নির্যাতিতকে সাহায্য তো করা হচ্ছেই, নির্যাতনকারীর বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপও নেওয়া হচ্ছে। শিশুশ্রম বন্ধ করার উদ্যোগও শুনেছি সরকার নিয়েছে।
গৃহকর্মীদের শুধু যে গৃহকর্ত্রীরাই নির্যাতন করে, তা নয়। গৃহকর্তারাও করে। গৃহকর্মীরা হামেশাই ধর্ষণের শিকার হয়। যারা বদ গৃহকর্তা, তারা এই অন্যায়টি করে আসছে আদিকাল থেকেই। গৃহকর্ত্রীদের গৃহকর্মী নির্যাতন নতুন ঘটছে। এখন প্রশ্ন হলো, কেন গৃহকর্ত্রীরা হঠাৎ এত বর্বর হয়ে উঠল?
এক সময় মধ্যবিত্ত গৃহকর্তার স্ত্রীও গৃহকর্মী হিসেবে গৃহে বাস করতো। তারাও ছিল বাড়ির দাসি। তাদের কখনও গৃহকর্ত্রী হতে দেওয়া হয় নি। সংসারের কোনও ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার তাদের কোনও অধিকার ছিল না। গ্রামে গঞ্জে বা শহরের ঘরে যে গরিব মেয়েরা কাজ করতো, তাদের সঙ্গে বাড়ির স্ত্রীটির একধরণের সখ্য গড়ে উঠতো। দুজনে সুখ দুঃখের গল্প করতো। দুজনের অসহায়ত্বের মধ্যে খুব একটা পার্থক্য ছিল না। দুজনই দাসি। গৃহকর্তা দুজনেরই কর্তা। এই চিত্রটি হাওয়া হয়ে যায়নি, এখনও বেশ নেচেখেলেই আছে। কিন্তু পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি শহুরে মধ্যবিত্তের ঘরে। মধ্যবিত্তের শান-শওকত কিছুটা বাড়ছে বৈকি। মেয়েরা ইস্কুল কলেজ পাশ করছে। বিয়ের পর তাদের এখন গৃহকর্ত্রী আখ্যা দেওয়া হচ্ছে। ঘরকন্নার তদারকি এখন মেয়েদের হাতে। তারা সিদ্ধান্ত নিতে পারে সংসারের অনেক ব্যাপারেই। লেখাপড়া জানার, হাতে কলেজ-ডিগ্রি থাকার, গৃহকর্ত্রী বনার, সংসারের ক্ষমতা হাতে পাওয়ার একটা অহংকার এসে ভর করে মেয়েদের গ্রীবায়। তখন তারা সেই আচরণটি করে, যে আচরণ ক্ষমতাবানরা করে, ধনীরা করে। তারা গরিবকে নির্যাতন করে।
এ-ছাড়া অশান্তির সংসার আরেক কারণ। দিনের পর দিন অশান্তির ভেতর ডুবে থাকলে মন মেজাজ দপদপ করে, তখন পান থেকে চুন খসলেই গৃহকর্মীদের শাস্তি পেতে হয়। অশান্তির ক্ষতিপূরণ। যে স্ত্রী মার খায় স্বামীর, সে স্ত্রীই মার দেয় অন্যকে। নিজের চেয়ে দুর্বল, নিজের চেয়ে ক্ষমতাহীন জগতে কেউ যদি থেকে থাকে, সে দাসি। নাগালের মধ্যে আছে বলেই তার ওপর গৃহকর্ত্রী নির্যাতন চালায়, এতে নিজের ক্ষমতা প্রকাশিত হয়, পুষে রাখা ক্রোধও কিছুটা প্রশমিত হয়।
মেয়েরা বর্বরতা জানে না এটা ভাবা খুবই ভুল। মেয়েরা সুযোগ পেলে নিষ্ঠুর, বর্বর , খুনী সবই হতে পারে। বর্বরতা না জানলেও পুরুষের কাছ থেকে বর্বরতা এর মধ্যে শিখে নিয়েছে মেয়েরা। এক পৃথিবীতে, এক সমাজে, এক মহল্লায়, এক বাড়িতে পুরুষের সঙ্গে জীবনভর বাস করছে , আর পুরুষ যা করে, তার কিছুই করতে শিখবে না তারা , এ কেমন কথা? মেয়েরা এখন পুরুষ যা করতে পারে, তার প্রায় সবই করতে পারে। পুরুষের মতো ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হতে পারে, বৈমানিক, বিজ্ঞানী, কৃষক শ্রমিক, প্রধানমন্ত্রী প্রেসিডেন্ট – সব হতে পারে। এত সব পারে বলেই পুরুষের মতো নির্মমও হতে পারে। আগুনের ছ্যাকা দিতে পারে গৃহকর্মীদের।
পুরুষেরা ৯৯টি অন্যায় করলে, আর নারী ১টি অন্যায় করলেও মানুষ নারীর দিকে আঙুল তুলে গালাগালি করে। সব নারী কিন্তু গৃহকর্মীদের অত্যাচার করে না। কেউ কেউ করে। যারা করে, তাদের শাস্তি হচ্ছে, শাস্তি হবে। অনেকে গৃহকর্ত্রীদের ওপর এমন ফুঁসে উঠেছে পারলে ওদের ছিঁড়ে খেয়ে ফেলে। ওরা যে কত বর্বর — তা যে যেমন পারে বর্ণনা করছে। মানছি ওরা বর্বর, তবে বর্বরতায় পুরুষের সঙ্গে নারীর তুলনা হাস্যকর। পুরুষ এ ব্যাপারে মাস্টার। নারী নিতান্তই শিশু। সমাজকে সুস্থ করতে চাইলে পুরুষকে বর্বরতা আর নিষ্ঠুরতা ত্যাগ করতে হবে। সংসারে শান্তি আনতে হবে। সংসারে শান্তি থাকলে গৃহকর্ত্রী খুশী থাকে, গৃহকর্ত্রী খুশী থাকলে গৃহকর্মীও খুশী থাকে।
এই পৃথিবী এখনও পুরুষের পৃথিবী। এই পৃথিবীতে আমরা মেয়েরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাস করি। গৃহকর্মী, গৃহকর্ত্রী কেউই নিরাপদে নেই। আমরা মেয়েরা যত বড় লেখক সাংবাদিক হই না কেন, যত বড় ব্যবসা বাণিজ্য করি না কেন, ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বনি না কেন — কেউই নিরাপদে নেই।