তিন কন্যা পেলেন শ্বশুরবাড়ি
বুধবারের সকালটা রোদে ঝলমল ছিল। তবে বিষণ্ন ছিল বিকেলের আকাশ। বিয়ের দুই বরযাত্রী চলে এসেছে। আসা বাকি আছে আরেক বরযাত্রী। তৃতীয় বরযাত্রীর সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হচ্ছে। কিন্তু কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না ওই বরযাত্রীর। তাই বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত লোকজন একটু চিন্তিত হয়ে পড়েন। জেলা প্রশাসনসহ সমাজসেবা কার্যালয়ের কর্মকর্তারা ছোটাছুটি করতে থাকেন। তাহলে কি এক কন্যার বিয়ে হবে না? এভাবেই কেটে গেল দুপুরটা। বিকেলের আকাশটাও ভারী ছিল। কালো মেঘে ঢেকে যাচ্ছিল চারপাশ। প্রকৃতির সঙ্গে যেন ভারী হচ্ছিল জেলা সমাজসেবার আওতায় পরিচালিত কুষ্টিয়া সামাজিক প্রতিবন্ধী মেয়েদের প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে উপস্থিত সবার মন। কারণ, তৃতীয় বরযাত্রী শেষ পর্যন্ত আসেনি। এ নিয়ে চলছে নানা ধরনের কথাবার্তা। এমন সময় সেখানে হাজির হলেন কেন্দ্রের সামনের মার্কেটের নৈশপ্রহরী রেজাউল ইসলাম। তিনি তৃতীয় কনেকে বিয়ে করার আগ্রহ প্রকাশ করলেন। পরে এই পাত্রের বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া হলো। অবশেষে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা তৃতীয় কনের সঙ্গে বিয়ে দিতে সম্মত হলেন। এতে নতুন করে বিয়ের উৎসবের আনন্দ আরও বেড়ে গেল। বিয়ের অনুষ্ঠানে কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর মাহবুবর রহমান, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) হাসান হাবিব, স্থানীয় সরকারের উপপরিচালক মোস্তাক আহমেদ, কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের সহযোগী অধ্যাপক লাল মোহাম্মদ, কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসনের সরকারি কৌঁসুলি (জিপি) আ খ ম আখতারুজ্জামান মাসুম, জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক রোকসানা পারভীন, কুষ্টিয়া প্রেসক্লাবের সভাপতি আবদুর রশীদ চৌধুরীসহ শহরের বিশিষ্টজনেরা উপস্থিত ছিলেন। সকাল থেকেই ওই পুনর্বাসন কেন্দ্রে বিয়ের আয়োজন চলতে থাকে। বরযাত্রী ও অতিথি আপ্যায়নের জন্য রান্না হয়। দুপুরের মধ্যে দুই বরযাত্রী বিয়ের আসরে হাজির হয়। প্রত্যেক বরের সঙ্গে ১৫ জন করে ছিলেন। পরে আরও এক বরযাত্রী এলে অতিথিও বেড়ে যায়। অন্যান্য বিয়ের মতোই গেটে মিষ্টিমুখ করিয়ে ফিতা কেটে বিয়ের আসরে বসেন বর সুজন আলী, জিল্লুর রহমান ও রেজাউল ইসলাম। সুজনের বাড়ি মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার মহাম্মদপুর গ্রামে। তিনি পেশায় কৃষক। আর জিল্লুরের বাড়ি কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলার শোমসপুর গ্রামে। তিনি পেশায় ভ্যানচালক। আর রেজাউল নৈশপ্রহরী। বিকেলে ২০ নম্বর ওয়ার্ডের নিবন্ধিত কাজী আজিজুর রহমান তিন কনের বিয়ে রেজিস্ট্রি করেন। তাঁদের উকিল ছিলেন কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসনের সরকারি কৌঁসুলি আ খ ম আখতারুজ্জামান মাসুম। প্রতি বিয়েতে দেনমোহর ধার্য করেন ৫০ হাজার ১ টাকা। কনে হাওয়া খাতুন বাক্প্রতিবন্ধী হওয়ায় ইশারায় মাথা কাত করে স্বামী হিসেবে সুজন আলীকে সম্মতি জানান এবং রেজিস্ট্রি খাতায় সই করেন। আরেক কনে ইতি খাতুন কবুল উচ্চারণ করে জিল্লুর রহমানকে স্বামী হিসেবে মেনে নেন। পরে উরুফার সঙ্গে রেজাউল ইসলামের বিবাহবন্ধনের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়। তাঁদের প্রত্যেকের বয়স ১৮ বছর পেরিয়ে গেছে।
বিয়ের আসরে বরদের উদ্দেশে জেলা প্রশাসক জহির রায়হান বলেন, ‘এত দিন এই মেয়েদের অভিভাবকের ছায়ায় ঢেকে রেখেছিলাম। আজ তোমাদের হাতে তুলে দিলাম। তোমাদের জীবন-সংসার সুখ-শান্তিতে ভরে উঠুক।’ এ সময় জেলা প্রশাসকের সঙ্গে তাঁর স্ত্রী শামসুন্নাহার বেগম ওই কন্যাদের নতুন জীবনে প্রবেশে শুভেচ্ছা ও শুভকামনা জানান। এই মেয়েদের পরিবারের সঙ্গে নিয়মিত খোঁজখবর রাখার কথাও জানালেন জেলা প্রশাসক। তাঁদের গায়েহলুদসহ পুরো বিয়ের আয়োজনের উদ্যোগ নেন তিনি। এ নিয়ে গত মঙ্গলবার প্রথম আলো অনলাইন ও বুধবার ছাপা সংস্করণে একটি সচিত্র প্রতিবেদন ছাপা হয়। বর-কনে মালাবদলের পর প্রশাসনের কর্মকর্তাসহ আমন্ত্রিত অতিথিদের সঙ্গে ছবি তোলেন। এ সময় তাঁদের প্রত্যেকের হাতে ১৫ হাজার টাকার চেক তুলে দেওয়া হয়। এ ছাড়া সংসারে নিত্যব্যবহারের জিনিসপত্রও তুলে দেওয়া হয়। সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে যখন দুটি বিয়ের গাড়ি কেন্দ্র থেকে বের হয়ে গেল, তখন প্রশাসনসহ সবার মনও কিছুটা হলেও নীরব হয়েছিল। তিন কন্যা ইতি, হাওয়া ও উরুফা খাতুনের বাড়ি কোথায়, তা প্রাথমিকভাবে জানা যায়নি। তবে ওই পুনর্বাসন কেন্দ্রে ইতি খাতুন দুই বছর ধরে এবং হাওয়া খাতুন ও উরুফা খাতুন পাঁচ বছর ধরে বসবাস করে আসছিলেন। এবার তাঁরা পেল শ্বশুরবাড়ি। সেখানেই সুখ-দুঃখে বাকি জীবন পার করে দেওয়ার ইচ্ছে তাঁদের।