তিন দিন আগে-পরে
উল্লেখ্য, ১৩ অক্টোবর অস্ট্রেলিয়ায় যাওয়ার আগে প্রধান বিচারপতি তার হেয়ার রোডের সরকারি বাসভবনে সাংবাদিকদের কাছে একটি লিখিত বিবৃতি দেন ।বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘আমি অসুস্থ নই। আমি সাময়িকভাবে যাচ্ছি। আবার ফিরে আসব। বিচার বিভাগ যেন বিব্রত না হয়। আমার ধারণা, সরকারকে ভুল বোঝানো হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি সম্পূর্ণ সুস্থ আছি। কিন্তু ইদানীং একটা রায় নিয়ে রাজনৈতিক মহল, আইনজীবী ও বিশেষভাবে সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী আমাকে ব্যক্তিগতভাবে যেভাবে সমালোচনা করেছেন, এতে আমি সত্যিই বিব্রত। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সরকারের একটা মহল আমার রায়কে ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে পরিবেশন করায় প্রধানমন্ত্রী আমার প্রতি অভিমান করেছেন, যা অচিরেই দূরীভূত হবে বলে আমার বিশ্বাস। সেই সঙ্গে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে আমি একটু শঙ্কিতও বটে। কারণ গতকাল (বৃহস্পতিবার) প্রধান বিচারপতির কার্যভার পালনরত দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রবীণতম বিচারপতির উদ্ধৃতি দিয়ে মাননীয় আইনমন্ত্রী প্রকাশ করেছেন যে, দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি অচিরেই সুপ্রিম কোর্টের প্রশাসনে পরিবর্তন আনবেন। প্রধান বিচারপতির প্রশাসনে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি কিংবা সরকারের হস্তক্ষেপ করার কোনো রেওয়াজ নেই। তিনি শুধু রুটিনমাফিক দৈনন্দিন কাজ করবেন। এটিই হয়ে আসছে। প্রধান বিচারপতির প্রশাসনে হস্তক্ষেপ করলে এটি সহজেই অনুমেয় যে, সরকার উচ্চ আদালতে হস্তক্ষেপ করছে এবং এর দ্বারা বিচার বিভাগ ও সরকারের মধ্যে সম্পর্কের আরও অবনতি হবে। এটি রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে না।’
এর আগে সাংবাদিকদের উদ্দেশে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমি অসুস্থ না। আমি চলে যাচ্ছি। আমি পালিয়েও যাচ্ছি না। আমি আবার ফিরে আসব। আমি একটু বিব্রত। আমি বিচার বিভাগের অভিভাবক। বিচার বিভাগের স্বার্থে, বিচার বিভাগটা যাতে কলুষিত না হয়, এ কারণেই আমি সাময়িকভাবে যাচ্ছি। আমার কারও প্রতি কোনো বিরাগ নেই। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সরকারকে ভুল বোঝানো হয়েছে। এই আমার বক্তব্য আর কিছু বলব না। আমি লিখিত বক্তব্য দিচ্ছি। এই হল আমার লিখিত বক্তব্য।’ এদিকে, প্রধান বিচারপতি অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার পরদিন ১৪ অক্টোবার প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার বক্তব্য বিভ্রান্তিকর ছিল বলে বিবৃতি দেয় সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল সৈয়দ আমিনুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এত বিবৃতিতে বলা হয়ে, গত ৩০ সেপ্টেম্বর প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা ছাড়া আপিল বিভাগের অন্য পাঁচ বিচারপতিকে বঙ্গভবনে আমন্ত্রণ জানান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। বিচারপতি মো. ইমান আলী দেশের বাইরে থাকায় বঙ্গভবনের ওই বৈঠকে উপস্থিত থাকতে পারেননি। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বৈঠকে অংশ নেন বিচারপতি আবদুল ওহহাব মিঞা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেইন, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী এবং বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার। বৈঠকে দীর্ঘ আলোচনার এক পর্যায়ে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার বিরুদ্ধে ১১টি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ সংবলিত দালিলিক তথ্য বিচারপতিদের কাছে হস্তান্তর করেন রাষ্ট্রপতি। এসবের মধ্যে বিদেশে অর্থ পাচার, আর্থিক অনিয়ম, দুর্নীতি, নৈতিক স্খলনসহ আরও সুনির্দিষ্ট গুরুতর অভিযোগ রয়েছে।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, সুপ্রিম কোর্টের ওই বিচারপতি মো. ইমান আলী ঢাকায় ফেরার পর ১ অক্টোবর বিচার বিভাগের পাঁচ বিচারপতি আবারও বৈঠকে বসেন। ওই বৈঠকে প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে তাদের আনা ১১টি অভিযোগ বিশদভাবে পর্যালোচনা করা হয়। এরপর তারা এসব গুরুতর অভিযোগ প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাকে অবহিত করার সিদ্ধান্ত নেন। তারা আরও সিদ্ধান্ত নেন প্রধান বিচারপতি এসব অভিযোগের যথাযথ উত্তর দিতে ব্যর্থ হলে তার সঙ্গে একসঙ্গে বিচার কাজে আর বসবেন না তারা। বিবৃতিতে বলা হয়, ওই সিদ্ধান্তের পর ওইদিনই বেলা সাড়ে ১১টায় পাঁচ বিচারপতি প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার হেয়ার রোডের সরকারি বাসভবনে সাক্ষাৎ করে অভিযোগগুলো নিয়ে বিশদভাবে আলোচনা করেন। দীর্ঘ আলোচনার পরও তার (প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা) কাছ হতে কোনও গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা বা সদুত্তর না পেয়ে আপিল বিভাগের উল্লিখিত পাঁচজন বিচারপতি তাকে সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন যে, এমতবস্থায় এসব অভিযোগের সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত তার সঙ্গে একই বেঞ্চে বসে বিচার কাজ পরিচালনা করা তাদের পক্ষে সম্ভব হবে না। এ পর্যায়ে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা সুস্পষ্টভাবে বলেন যে, তিনি পদত্যাগ করবেন। তবে এ ব্যাপারে পরেরদিন তিনি তার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাবেন। এর পরদিন ২ অক্টোবর তিনি উল্লিখিত বিচারপতিদের কোনও কিছু না জানিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে এক মাসের ছুটির দরখাস্ত দেন। রাষ্টপতিও তা অনুমোদন করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপতি সংবিধানের ৯৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, প্রধান বিচারপতির অনুপস্থিতিতে আপিল বিভাগের সিনিয়র বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিঞাকে প্রধান বিচারপতির অনুপস্থিতিতে অনুরূপ কার্যভার পালনের দায়্ত্বি দেন।
উল্লেখ্য, গত ১ অক্টোবর আইন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বিদেশ যাওয়ার অনুমতি চেয়ে রাষ্ট্রপতিকে একটি চিঠি দেন প্রধান বিচারপতি। ওই চিঠিতে ১৩ অক্টোবর থেকে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়া থাকতে চান বলেও উল্লেখ করেন তিনি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার সকাল ১১টার দিকে প্রধান বিচারপতির বিদেশ যাওয়া সংক্রান্ত সরকারি আদেশ (জিও) জারি করে আইন মন্ত্রণালয়। আইন সচিব আবু সালেহ শেখ মো. জহিরুল হকের স্বাক্ষর করা ওই আদেশে বলা হয়, প্রধান বিচারপতির আবেদনে এর আগে ৩ অক্টোবর থেকে ১ নভেম্বর পর্যন্ত ৩০ দিনের ছুটি মঞ্জুর করেছিলেন রাষ্ট্রপতি। কিন্তু প্রধান বিচারপতি আরও বেশি দিন বিদেশে থাকবেন। তাই রাষ্ট্রপতি নতুন আদেশ দিয়েছেন। ২৫ দিনের অবকাশ শেষে ৩ অক্টোবর সুপ্রিম কোর্ট খোলার দিনই অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে ১ নভেম্বর পর্যন্ত এক মাসের ছুটিতে যান প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা।এর মধ্যেই প্রধান বিচারপতি সস্ত্রীক অস্ট্রেলিয়ায় যেতে পাঁচ বছরের ভিসার জন্য দূতাবাসে আবেদন করেন। তাদের তিন বছরের ভিসা দেয় অস্ট্রেলিয়া দূতাবাস। ভিসা পাওয়ার পর মঙ্গলবার (১০ অক্টোবর) প্রধান বিচারপতি আইন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতিকে তার বিদেশ ভ্রমণের বিষয়টি চিঠি দিয়ে অবহিত করেন। ওই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতেই পরে বৃহস্পতিবার জিও জারি করে আইন মন্ত্রণালয়।