মরিয়ম চম্পা-
জিনিয়া ওরফে টিকটক জিনিয়া রোজ। মিরপুরের পল্লবীর একটি কলেজের শিক্ষার্থী। তবে পড়ালেখার তুলনায় জিনিয়াকে টিকটকে বেশি ব্যস্ত থাকতে দেখেন নেটিজেনরা। নিয়মিত টিকটক করায় জিনিয়া তার নিজ এলাকায় টিকটকার জিনিয়া নামে পরিচিত। টিকটক করতে গিয়ে জিনিয়ার উচ্ছৃঙ্খল পোশাক এবং জীবন যাপনে পরিবারের সদস্য থেকে শুরু করে প্রতিবেশী বন্ধুমহল অনেকেই বিরক্ত।
কম বয়সে উচ্ছন্নে যাওয়ায় পারিবারিক শাসনের ঊর্ধ্বে চলে গেছে টিকটকার জিনিয়া। টিকটকের ভিডিও করতে মিরপুর, পল্লবী, বেড়িবাঁধ, দিয়াবাড়ীসহ বিভিন্ন স্থানে নিয়মিত যাতায়াত ছিল জিনিয়ার। স্কুলে এক সঙ্গে পড়ালেখার সুবাদে জিনিয়ার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় কলেজপড়ুয়া নিশার। জিনিয়ার মতো মাঝেমধ্যে নিজের ফেসবুক, ইউটিউব এবং ইনস্টাগ্রামে শেফায়েত উল্লাহ শেফু ওরফে শেফুদা সহ অনেককেই নকল করে টিকটক করতো কলেজ শিক্ষার্থী কাজী দিলখুশ জান্নাত নিশা। নিশার সঙ্গে নিখোঁজ অপর দুই শিক্ষার্থীও নানা সময়ে জিনিয়ার পাল্লায় পড়ে টিকটক ভিডিও তৈরি করতো। এদিকে তিন কলেজছাত্রীর বাসা ছেড়ে ‘নিখোঁজ’ হওয়ার তৃতীয় দিনে গত শনিবার রাতে অপহরণ মামলা করলে এক তরুণীসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, তাদের প্রত্যেকের বাসায় নিয়মিত যাতায়াত ছিল জিনিয়ার। এদিকে জিনিয়ার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক ছিল মামলার প্রথম আসামি তরিকুল্লাহ’র। নিখোঁজ হওয়ার আগের সপ্তাহে তারা একসঙ্গে উত্তরার দিয়াবাড়ীর কাশবনে টিকটক ভিডিও করতে যায় বলে জানায় সূত্রটি। নিখোঁজ তিন শিক্ষার্থীর পরিবারের পক্ষ থেকে করা মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, মিরপুরের পল্লবীর ব্লক-সি, সেকশন-১১ তে প্যারিস রোডের ৭১-তে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে নিখোঁজ শিক্ষার্থী নিশা বসবাস করতেন। নিশা মিরপুর গার্লস আইডিয়াল কলেজের দ্বাদশ বিজ্ঞান বিভাগে পড়ালেখা করেন। পড়ালেখার সুবাদে আসামি মো. তরিকুল্লাহ, তার বড় ভাই মো. রকিবুল্লাহ, জিনিয়া ওরফে টিকটকার জিনিয়া রোজ ও শরফুদ্দিন আহম্মেদ অয়নদের সঙ্গে নিশাসহ তার অপর দুই বান্ধবী স্নেহা আক্তার এবং কানিজ ফাতেমার সঙ্গে পরিচয় হয়। মামলার তৃতীয় আসামি টিকটক জিনিয়া রোজ প্রায় সময় নিশাদের বাসায় যাতায়াত করতেন। মাঝে মধ্যেই তরিকুল্লাহ এবং জিনিয়া নিশাদের বাসায় এসে বেড়াতে যাওয়ার জন্য বাসার বাইরে নিয়ে যেতেন।
ঘটনার দিন গত বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা ২০ মিনিটে নিশার বোনের মেয়েকে তার মায়ের কাছে রেখে যেতে আসলে তখন নিখোঁজ শিক্ষার্থী স্নেহা এবং কানিজ ফাতেমার মা’সহ তাদের পরিবারের সদস্যরা বাসায় আসেন। এ সময় নিশা এবং তার বান্ধবীর মায়েরা জানান, শিক্ষার্থীদেরকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। পরবর্তীতে প্রতিবেশী এবং নিকটাত্মীয়দের বাসাসহ বিভিন্ন স্থানে খুঁজে না পেয়ে আসামি তরিকুল্লাহ, রকিবুল্লাহ এবং জিনিয়ার প্রতি নিখোঁজ শিক্ষার্থীদের পরিবারের সদস্যদের সন্দেহ হয়। পরবর্তীতে রাত ৮টার দিকে নিশার মা বাসার আলমারি খুলে দেখতে পান তার হজে যাওয়ার জন্য রাখা নগদ ৬ লাখ টাকা এবং ৮০ হাজার টাকা মূল্যমানের স্বর্ণালঙ্কার, নিশার স্কুল সার্টিফিকেট এবং জন্মসনদ কিছুই নেই। এদিকে নিশার বান্ধবী স্নেহার বাবা এসে জানান, বাসা থেকে তার মেয়ে নগদ ৭৫ হাজার টাকা, আড়াই ভরি স্বর্ণালঙ্কার, স্কুল সার্টিফিকেট, জন্মনিবন্ধন নিয়ে গেছে। খোঁজাখুঁজির এক পর্যায়ে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ঘটনার দিন সকাল ৯টায় আসামিরা মিলে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী তাদের সহযোগীদের নিয়ে একটি অজ্ঞাত নম্বরের সাদা মাইক্রোবাসে উঠিয়ে তাদেরকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে অসৎ উদ্দেশ্যে তাদেরকে ফুসলিয়ে অপহরণ করে নিয়ে গেছে বলে এজাহারে উল্লেখ করা হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মামলার অন্যতম আসামি তরিকুল্লাহ’র পারিবারিক অবস্থা ভালো না হওয়ায় সে রুটির দোকানে কাজ করার পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের হ্যাকিংয়ের কাজ করতো বলে প্রাথমিকভাবে স্বীকার করেছে। টিকটকের ফাঁদে ফেলে তরিকুল্লাহ’র সঙ্গে পাচারকারী বড় কোনো চক্রের যোগসাজশ রয়েছে বলে জানায় সূত্রটি। এ ছাড়া প্রযুক্তিগত বিষয়ে অনেক বেশি দক্ষ হওয়ায় বিভিন্ন দেশের ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ করতো সে। নিখোঁজ শিক্ষার্থী নিশার আইটি বিষয়ে জানার আগ্রহ থেকে নানা সময়ে মামলার অন্যতম আসামি তরিকুল্লাহ’র শরণাপন্ন হতো। এর সুযোগ নিয়ে তরিকুল্লাহ নিশাকে বিভিন্ন সময়ে জাপান এবং আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে পাঠানোর সুযোগ রয়েছে বলে ফুসলিয়েছে। নিশার অপর দুই বান্ধবীর সঙ্গে তার ভালো সম্পর্ক থাকায় তারাও বিদেশে যাওয়ার বিষয়ে উৎসাহী ছিল। তাদেরকে বিদেশে পাঠানোর প্রলোভন দেখিয়ে মোটা অঙ্কের নগদ টাকা, স্বর্ণালঙ্কার এবং সার্টিফিকেটসহ মূল্যবান জিনিসপত্র নিয়ে পালাতে উৎসাহী করেছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছে তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র।
এদিকে তরিকুল্লাহ’র মুঠোফোন চেক করে টিকটকার জিনিয়া এবং নিশাসহ তার বান্ধবীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগের সন্ধান পেয়েছে তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রটি। নিখোঁজ শিক্ষার্থী নিশার বোন এবং মামলার বাদী আইনজীবী কাজী রওশন দিল আফরোজ বলেন, আমার বোন এবং তার দুই বান্ধবীকে তরিকুল্লাহ, জিনিয়া এবং অপর আসামিরা ফুসলিয়ে অপহরণ করে নিয়ে গেছে বলে আমরা জানতে পেরেছি। এখন তাদেরকে মেরে ফেলেছে নাকি কোনো দেশে পাচার করে দিয়েছে এ বিষয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। আসামিদের বিস্তারিত জিজ্ঞাসাবাদ করলে সঠিক তথ্য বেরিয়ে আসবে বলে জানান তিনি।
এ বিষয়ে পল্লবী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) পারভেজ ইসলাম বলেন, গত শনিবার এ ঘটনায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে নিখোঁজ এক শিক্ষার্থীর বড় বোন একটি মামলা করেছেন। মামলা নম্বর ৬। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত এজাহারভুক্ত চার আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গতকাল দুপুরে আদালতে নিয়ে গেলে মামলার দ্বিতীয় আসামি রকিবুল্লাহর দুইদিনের রিমান্ড মঞ্জুর হয়েছে। বাকিদের বয়স বিবেচনা করে রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়নি। রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে বিস্তারিত তথ্য জানা যাবে বলে জানান এই কর্মকর্তা।
সংবাদ টি পড়া হয়েছে :
১২৬ বার