‘তুমিহীন, দিন…’
উজ্জ্বল মেহেদী-
‘বৃষ্টিভেজা সড়কপথ দেখলেই মনে পড়ে সেই ভয়ংকর ঘটনা। ভুলতে যখন পারবো না, তাই ইচ্ছে আছে, বাবা যেমন করে বিভিন্ন গণদাবিতে আন্দোলন সংগঠিত করতেন, সেভাবেই সড়ক-হত্যার বিরুদ্ধে জনপ্রতিবাদ জাগ্রত করার।’ এ কথাগুলো ফিদেল নাহিয়ানের। অকালপ্রয়াত কবি ও জনপ্রতিনিধি মমিনুল মউজদীনের একমাত্র সন্তান তিনি। ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কাছে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় ফিদেল নাহিয়ানের বাবা মউজদীন, মা তাহেরা চৌধুরী ও একমাত্র ছোট ভাই কহলিল জিব্রান নিহত হন। তাঁদের সঙ্গে থাকা একমাত্র ফিদেল নাহিয়ান বেঁচে আছেন। এদিকে মমিনুল মউজদীনের নির্বাচিত সাতটি কবিতা নিয়ে ‘তুমিহীন, দিন…’ নামে একটি স্মরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে সিলেটের দর্পণ থিয়েটার। আজ বুধবার সন্ধ্যা ছয়টায় সিলেটে সম্মিলিত নাট্য পরিষদের মহড়াকক্ষে সাতটি কবিতা পাঠ করবেন সিলেটের সাতজন আবৃত্তিশিল্পী। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনে স্নাতকোত্তর করেছেন। বাবার ইচ্ছাপূরণে দেশের বাইরে গিয়ে ‘বার-অ্যাট-ল’ করার প্রস্তুতি রয়েছে তাঁর। সুনামগঞ্জে পৈতৃক বাড়িতে আসা-যাওয়া করছেন। তবে বসবাস করছেন নানার বাড়ি মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার শমসেরনগরে।
ফিদেল নাহিয়ানের কথায় উঠে এসেছে মমিনুল মউজদীনের কবি, জনপ্রতিনিধি পরিচিতির বাইরে একজন বাবা ও সড়ক দুর্ঘটনায় চিরবিদায় নেওয়ার সেই ভয়ংকর স্মৃতিও। ফিদেল নাহিয়ান বলেন, ‘বাবা টানা তিনবারের পৌর চেয়ারম্যান ছিলেন। ওই বছর সংসদ নির্বাচনে প্রার্থিতার ঘোষণা দিয়েছিলেন বাবা। আমি প্রথম ভোটার হব, ভোটার আইডি (পরিচয়পত্র) করতে সুনামগঞ্জ ফিরছিলাম আমরা। বাবাও তখন ঢাকায় ছিলেন। ফিরছিলেন আমাদের সঙ্গে। সকাল থেকেই হালকা বৃষ্টি ছিল। গাড়িচালকের পাশের সিটে একসময় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আমি। হঠাৎ ঘুম ভাঙল বাবার চিৎকারে। ফিরে তাঁর দিকে তাকাতেই প্রচণ্ড শব্দ। আর কিছু মনে নেই।’ দুর্ঘটনার পর নাহিয়ান নিজেকে সিঙ্গাপুরের হাসপাতালে দেখতে পান। ওই সময় তাঁকে জানানো হয় বাবা, মা ও ভাই হারানোর কথা। তিনি বলেন, ‘এখনো শুধু মউজদীনের সন্তান বলে দূরদূরান্ত থেকে আমাকে দেখতে আসেন বহু মানুষ। অশ্রুসজল চোখে ওই মানুষেরা আমাকে আশীর্বাদ করে বলেন, “বেঁচে থাকো, বাবার মতো হও।” এটাই আমার সান্ত্বনা।’
মা-বাবা, তাঁরা দুই ভাই—এ নিয়ে ছিল তাঁদের সাজানো পরিবার। ব্যস্ত বাবা কিন্তু সন্তানদের জন্য ঠিকই সময় বের করতেন। পড়ার অভ্যাস গড়ার তাগাদা দিতেন। নাহিয়ান বলেন, ‘বাবা মাঝে মাঝে আমাদের দুই ভাইকে ডেকে শোনাতেন চে গুয়েভারা, মাও সে তুং আর হুগো শাভেজদের গল্প। তাঁর সঙ্গে যেতাম বইয়ের দোকানে। টিনটিন আর কাকাবাবু ভক্ত আমরা দুই ভাই বই কিনতাম বাবার পছন্দে।’ মমিনুল মউজদীনের জনপ্রতিনিধিত্ব তাঁর বিপ্লবী চেতনার ফসল—এ কথা জানিয়ে নাহিয়ান বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই আমি বাবাকে দেখেছি দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের পক্ষে নানান লড়াইয়ে।’
মরমি কবি হাসন রাজার প্রপৌত্র মমিনুল মউজদীন। কবি পরিচিতিও ছিল তাঁর। আশির দশকে বিচিত্রায় গণিউর রাজার রোজনামচা লিখে সাহিত্য অঙ্গনে পরিচিতি পান। পড়াশোনার জন্য ঢাকায় ছিলেন। সুনামগঞ্জ ফিরে ১৯৯৩ সালে প্রথম সুনামগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান হন। পৌর শহরে পূর্ণিমা রাতে জোছনা দেখতে স্ট্রিট লাইট নিভিয়ে দিতেন। তাঁর এই উদ্যোগ একদিকে তরুণদের জোছনার দিকে আকৃষ্ট করেছিল, অন্যদিকে লোডশেডিংয়ের সময়ে বিদ্যুৎ সাশ্রয় হিসেবে প্রচার পেয়েছিল। তাঁর পৌর চেয়ারম্যানের তিনটি মেয়াদে দুর্নীতিবিরোধী ও মাদকবিরোধী সামাজিক আন্দোলন হয়েছে।