মোসাইদ রাহাত, সুনামগঞ্জ- ঘরের মাঠে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজের প্রথম টি-টোয়েন্টি ম্যাচে ক্যারিয়ার সেরা বোলিং করে নাসুম আহমেদ যখন সংবাদ শিরোনাম, তখন ভিন্ন সংবাদও ছড়িয়ে পড়ে অনলাইন প্লাটফর্মে। বলা হয়, টাইগারদের বাঁহাতি এ স্পিনার ‘নিজ জেলা’ সুনামগঞ্জে ‘আজীবন নিষিদ্ধ’। অস্ট্রেলিয়া সিরিজ শেষে এবার বিষয়টি নিয়ে মুখ খুললেন নাসুম। তার দাবি জেলাটির সঙ্গে তার কোনো ক্রিকেটীয় সম্পর্ক নেই। আর সুনামগঞ্জ জেলা ক্রীড়া সংস্থা বলছে, নিবন্ধন ফর্মে উল্লেখ করা স্থায়ী ঠিকানাই বলে দিচ্ছে সুনামগঞ্জের সাথে তার জড়িয়ে থাকার প্রমাণ।
ফেসবুক পোস্টে নাসুম লেখেন, ‘আমার জন্ম, বড় হওয়া, পড়ালেখা কিংবা ক্রিকেট খেলা সবকিছুই সিলেটে। আমার বাবার জন্মও সিলেটে। একসময় আমার দাদাবাড়ি সুনামগঞ্জ জেলায় ছিল। কিন্তু আমার দাদা ১৯৫৮ সালে সিলেটে স্থায়ীভাবে চলে আসেন। ছোটবেলা সুনামগঞ্জে একবার গিয়েছিলাম এবং রাস্তাঘাটও ঠিকভাবে চিনি না ওখানকার।’ সুনামগঞ্জে খ্যাপে খেলতে যাওয়ার কথা উল্লেখ করে ক্রিকেটার লেখেন, ‘‘পরবর্তীতে ওখানকার একটা টুর্নামেন্টে একবার ‘খ্যাপ’ খেলতে গিয়েছিলাম। সম্প্রতি বিভিন্ন সংবাদে হয়তো অনেকে বিভ্রান্ত হয়েছেন, আমি আমার জেলা দলে নিষিদ্ধ। কিন্তু আমি যে জেলার হয়ে কখনো খেলিনি তারা আমাকে কীভাবে নিষিদ্ধ করে? ২০০৫ সালে ১১ বছর বয়সে আমি পেশাগতভাবে ক্রিকেট শুরু করি এবং ওই বছর জেলা ক্রিকেটে সুনামগঞ্জের কোনো দলই ছিল না। তখন থেকে সবসময়ই সিলেটের হয়ে খেলেছি।’’
নাসুম লেখেন, ‘সিলেট লিগে খেলেছি ২০০৬ সাল থেকে এবং সিলেট জেলা দলে খেলেছি ৩ বছর আর বিভাগীয় দলে ২০১০ সাল থেকে। আল্লাহর অশেষ রহমতে আমি বাংলাদেশ দলে সুযোগ পেয়েছি ও ভবিষ্যতে আরও এগিয়ে যেতে সবার দোয়া কামনা করি।’ তার এ কথার সূত্র ধরে সুনামগঞ্জ জেলা ক্রীড়া সংস্থায় গেলে নিউজবাংলার হাতে আসে ক্রিকেটার নাসুমের বিভিন্ন কাগজপত্র। যেখানে দেখা যায় নাসুম ২০১০ সালে সুনামগঞ্জ জেলা ক্রীড়া সংস্থা ক্রিকেট লিগের নিবন্ধন ফরম পূরণ করেন। সে সময়েই নিবন্ধিত ফরমে নাসুম তার বর্তমান ঠিকানা সিলেটের জালাবাবাদ আবাসিক এলাকায় দিলেও তার স্থায়ী ঠিকানা দেন সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার ভাটিপাড়া ইউনিরনের মর্দাপুর গ্রাম।
এ ছাড়া নিবন্ধিত ফরমের সঙ্গে পরিচয়পত্র হিসেবে তিনি জমা দেন নিজের জন্ম নিবন্ধন। সেখানে শুধু জন্মস্থানের জায়গায় সিলেট দিলেও স্থায়ী ঠিকানা দেন সুনামগঞ্জের মর্দাপুর গ্রাম। এ সময় তিনি সুনামগঞ্জের প্যারামাউন্ট ক্লাবের হয়ে খেলার ইচ্ছা পোষণ করেন বলে নিবন্ধন ফরমে উল্লেখ করে স্বাক্ষর করেন। এ ছাড়া ২০১০ ও ২০১৩ সালে অনুষ্ঠিত জেলা প্রথম বিভাগ ক্রিকেট লিগের স্কোরকার্ড আসলে সেখানেও নাসুমের পরিসংখ্যান দেখা যায়। ২০২০ সালেও সুনামগঞ্জে একটি লিগ খেলতে এলেও নিষিদ্ধ থাকায় খেলতে দেওয়া হয়নি তাকে।
সুনামগঞ্জ জেলার হয়ে খেলার পরও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নাসুম আহমেদের এমন মন্তব্যে সুনামগঞ্জ জেলাকে হেয় করা হয়েছে বলে মনে করছেন জেলার সাধারণ মানুষ। এ ছাড়া প্রথম বিভাগ ক্রিকেট লিগকে ‘খ্যাপ’ বলাটাও অনুচিত মনে করছেন ক্রীড়া সংশ্লিষ্টরা। সুনামগঞ্জ জেলা ক্রীড়া সংস্থার ক্রিকেট বিভাগের যুগ্ম সম্পাদক চৌধুরী আহমদ মুজতবা রাজী বলেন, ‘নাসুমের খেলোয়াড়ি জীবনের শুরু আর উত্থান সিলেট থেকে। বিভিন্ন বয়সভিত্তিক দলে সে সিলেট জেলার প্রতিনিধিত্ব করেছে। ২০১০ সালে সে প্রথম সুনামগঞ্জ প্রথম বিভাগ ক্রিকেট লিগে প্যারামাউন্ট ক্রিকেট ক্লাবে খেলে।
‘২০১৩ সালে একই ক্লাবের হয়ে অংশ নেয়। জাতীয় ক্রিকেট চ্যাম্পিয়নশিপে তাকে সুনামগঞ্জ জেলা দলের প্রাথমিক স্কোয়াডে ডাক পেলে সে অংশ না নিয়ে সিলেট জেলার পক্ষে অংশ নেয়।’ তিনি বলেন, ‘বাইলজ মোতাবেক পরবর্তীতে জেলা ক্রীড়া সংস্থা তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ প্রদান করে ও জবাব না পাওয়ায় তাকে জেলা ক্রীড়া সংস্থার আয়োজিত সব ধরনের খেলা থেকে বহিষ্কার করে।’ মুজতবা রাজীর মতে, নাসুমের নিবন্ধন ফরমে স্থায়ী ঠিকানা মর্দাপুর বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এর সমর্থনে জন্ম নিবন্ধন সনদও সংযুক্ত করা হয়েছে। নাসুম এখন সুনামগঞ্জে তার কিছু নেই, চেনে না বা সুনামগঞ্জে খেলেনি বললে তা মিথ্যাচার হয়।
তিনি বলেন, ‘একজন জাতীয় তারকা হিসেবে তার নিজের বিষয়টি পরিষ্কার করা উচিত। সে বলেছে জেলা ক্রীড়া সংস্থা তাকে কীভাবে সাসপেন্ড করে? তালিকাভুক্ত কোনো খেলোয়াড়কে সাসপেন্ড করার ক্ষমতা জেলা ক্রীড়া সংস্থার আছে। এটি তার জানা উচিত।’ এ বিষয়ে নাসুম আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমার জন্ম সিলেটে, আমার পড়াশোনা খেলাধুলার শুরুটাও সিলেটে। আমার দাদার বাড়ি সুনামগঞ্জে, কিন্তু সেখানে একবারই আমি দাদির সঙ্গে বেড়াতে গিয়েছিলাম। তাও ছোটবেলায়। ‘আপনারা সবাই ভুল বুঝতেছেন। আমি সুনামগঞ্জকে হেয় করিনি। আমি নিজেও অনেকবার সুনামগঞ্জ জেলা দলের হয়ে খেলতে চেয়েছি।’
তিনি বলেন, ‘যখন আমি প্রথম বিভাগ ক্রিকেট খেলতে সেখানে যাই তাদের শর্ত দিয়েছিলাম লিগ খেললেও জেলাভিত্তিক ক্রিকেট খেলব না। খেলার কারণে ঢাকায় থাকার সময় আমাকে নিষিদ্ধ করা হয়। চিঠিটি পরে বাসায় এসে দেখতে পাই। যেখানে খেলতেই চাইনি সেখানে আমাকে কেন নিষিদ্ধ করা হবে।’
জন্মনিবন্ধনে সুনামগঞ্জ জেলা থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমি অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপ খেলেছি। কয়েকটি দেশে গিয়ে টুর্নামেন্ট খেলেছি বয়সভিত্তিক। সেখানে তো অবশ্যই আমি একটি পরিচয় বহন করেছি। সেখানে সুনামগঞ্জ লেখা নেই। আমি যখন প্যারামাউন্ট ক্লাবে খেলতে যাই তখন ক্লাবের লোকেরাই বলেছিলেন যে তারা ক্রীড়া সংস্থার কর্মকর্তা। এগুলো নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না।
‘আমার বাবাও বিষয়টি দেখে অবাক হয়েছেন। যখন ২০২০ সালে খেলতে যাই তারা আমাকে খেলতে দেয়নি নিষিদ্ধ বলে। ক্লাবের কর্মকর্তার আমার সিলেট বিভাগের কোচকে অনুরোধ করে নিয়ে আসেন। আমিও গিয়েছিলাম। কিন্তু আমাকে খেলতে দেওয়া হয়নি।’ প্যারামাউন্ট ক্রিকেট ক্লাবের সভাপতি উজ্জ্বল বখত বলেন, ‘নাসুম সিলেট থাকত এবং সেখানেই খেলত, কিন্তু তার সুনামগঞ্জে খেলার যাত্রা শুরু হয় প্যারামাউন্ট ক্রিকেট ক্লাবের হয়ে। সে তার লেখায় লিখেছে একবার খ্যাপ খেলেছে। বিষয়টি সত্য নয়। সে প্রথম বিভাগ ক্রিকেট লিগ খেলেছে তাও একবার নয়; দুইবার।
‘প্রথম বিভাগ ক্রিকেট লিগে খেলতে হলে তাকে সুনামগঞ্জ জেলার হতে হবে। তাহলে যে জন্মনিবন্ধন দিয়েছে, সেটি কি তাহলে ভুল? আমি মনে করি সে এখন ছোট মানুষ। তার বুঝশক্তি এখন সেভাবে হয়নি বলেই এমন ভুলভাল মন্তব্য করেছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘সে নিজেই তো তার কাগজে সুনামগঞ্জের বলে দাবি করেছে। তাহলে মৌখিক শর্তটা কী?’ সুনামগঞ্জ ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক দেওয়ান ইমদাদ রেজা চৌধুরী বলেন, ‘আমি চাই সে আরও বড় হোক, কিন্তু এমন মিথ্যাচার করা ঠিক নয়। ‘সে সুনামগঞ্জ জেলার কেউ না হলে প্রথম বিভাগ ক্রিকেট খেলে কেমন করে? তার ক্লাব অবশ্যই তার মিথ্যা তথ্য দেয়নি। যদি দিয়ে তাকে তাহলেও সেটা বলুক আমাদের।’