দখল-ভরাটে নিশ্চিহ্ন সুনামগঞ্জ পৌর শহরের ৫ ‘খাল’
শহীদনুর আহমেদ, সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি :: সুনামগঞ্জ পৌর শহরের পানি নিষ্কাশনের প্রধানতম প্রবাহ ৫টি খালের অস্তিত্বই আজ বিলীন। প্রবীণরা খালগুলোর নাম মনে রাখলেও আজকের প্রজন্ম এ সম্পর্কে কিছুই জানেনা। দখল-ভরাটে মুছে গেছে শহরের পানি নিষ্কাশনকারী খালগুলোর সকল চিহ্ন। যার ফলে বৃষ্টি হলেই শহরে ভয়াবহ জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। বাসাবাড়ি, অফিস, গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, সড়ক, পাড়া-মহল্লা প্লাবিত হয়। গত শুক্রবার (২৮ জুন) টানা বৃষ্টিপাতে শহরের রাস্তাঘাট ডুবে গিয়েছিল। রাস্তাঘাট উপচে বৃষ্টির পানি প্রবেশ করেছিল অনেকের বসতঘরে। বিভিন্ন সময়ে দখল ও দূষণের শিকার গুরুত্বপূর্ণ খালগুলো উদ্ধারের তৎপরতা শুরু হলেও রহস্যজনক কারণে তা বন্ধ হয়ে গেছে। নাগরিকরা এই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার পেতে দখল ভরাটের শিকার খালগুলো পুনরুদ্ধারের দাবি জানিয়েছেন। প্রবীণদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জনশ্রুতি রয়েছে এক সময় ঝাউয়ার হাওর খনন করেই সুনামগঞ্জ শহর প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এই ঝাউয়ার হাওরই শহরের পানি নিষ্কাশনের প্রধান জলাধার ছিল। সুরমা নদী থেকে প্রবাহিত ৫টি খাল শহরের ভেতর দিয়ে ঝাউয়ার হাওরে প্রবাহিত হতো। এই খালগুলোই ছিল শহরবাসীর পানি নিষ্কাশনের প্রধান মাধ্যম। প্রবীণদের মতে খালগুলো হলো- ধোপাখালি খাল, বলাইখালী (ষোলঘর), কামারখাল, তেঘরিয়া খাল ও বড়পাড়া খাল।
শহরের পূর্ব উত্তর এলাকায় ধোপাখালি খালটি অবস্থিত। এই খাল দিয়ে এক সময় মরাগাঙে পানি নামতো। পরে এই পানি মোহাম্মদপুর হয়ে সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজের পূর্বে অবস্থিত জলাশয়ে গিয়ে পতিত হতো। এই জলাশয় থেকে সোনাখালি খাল হয়ে ঝাউয়ার হাওরে নামতো পানি। বর্তমানে পানি নামলেও ধোপাখালিতে অপরিকল্পিত স্নুইসগেটের কারণে পর্যাপ্ত পানি চলাচলে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এছাড়াও বিভিন্ন স্থানে ভরাট ও দখল হয়েছে খালটি। ষোলঘরের পুরাতন কাস্টমস অফিস সংলগ্ন সুরমা নদী থেকে বলাই খালের উৎপত্তি। এখান দিয়ে প্রবাহিত হয়ে খালের পানি অ্যাডভোকেট আফতাব উদ্দিন আহমদের বাসভবনের পাশের ঝিলে গিয়ে পড়তো। পরে সরকারি কলেজের পেছনের খাল হয়ে হাওরে নামতো পানি। খালের আশপাশের সকল বাসাবাড়ির পানি প্রাকৃতিকভাবেই এই খালে নিষ্কাশন হতো।
কামারখাল এক সময় খর স্রোতা ছিল। কলোনি আমলে শহরে আসতে এই খাল পাড়ি দিতে সমস্যা হতো নাগরিকদের। পশ্চিম বাজারের বর্তমান পৌর প্রাথমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন সুরমা নদী থেকে খালটির উৎপত্তি। এখানে পাকিস্তান আমলে বাঁশের সেতু দিয়ে জনগণ যাতায়াত করতেন। পরবর্তীতে পৌর চেয়ারম্যান দেওয়ান ওবায়দুর রেজা চৌধুরীর সময়ে পৌর কর্তৃপক্ষ এখানে আকর্ষণীয় ডিজাইনের পাকা সেতু নির্মাণ করে। পরে প্রয়াত মেজর ইকবাল হোসেন চৌধুরী’র সময়ে সেতুটি ভেঙে দিয়ে খালটি বন্ধ করে রাস্তা তৈরি করা হয়। প্রয়াত পৌর চেয়ারম্যান মমিনুল মউজদীনের সময়ে উৎপত্তিমুখে পৌর প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মাণ করা হয়। এভাবেই খালটির মৃত্যু ঘটে। এই খালটি আরপিননগর হয়ে, ডা. তৃণাঙ্কুর রায়ের বাসার সামনে দিয়ে শামীমাবাদ-বুলচান্দ, মহিলা কলেজের সামনে দিয়ে, বাঁধনপাড়া হয়ে ঝাউয়ার হাওরে পতিত হয়। ওই খালের পার্শ্ববর্তী বাসিন্দাদের পানি নিষ্কাশন হতো এই খাল দিয়ে। এক সময় এই খালটিতে পৌর কর্তৃপক্ষ সংকোচিত ড্রেন নির্মাণ করে আরো সংকট তৈরি করেছে বলে মনে করেন নাগরিকরা।
পশ্চিম তেঘরিয়ার ডা. আমিরুল ইসলামের বাসার পূর্বে তেঘরিয়া খালটির অবস্থান ছিল। এরও উৎপত্তি সুরমা নদী থেকে। এই খালটি তেঘরিয়াকে দুই অংশে ভাগ করে। এই খালটি লম্বাহাটি মসজিদ, বিদ্যুৎ অফিস, কোর্টের সম্মুখে সড়ক ও জনপথ বিভাগের খাল হয়ে মল্লিকপুর সেতু (বিজিবি অফিসের সামনের সেতু) হয়ে ঝাউয়ার হাওরে পতিত হতো। প্রয়াত পৌর চেয়ারম্যান মমিনুল মউজদীনের সময়ে সেতুর নিচ ভরাট করে স্থায়ীভাবে খালটির পানিপ্রবাহ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। পরবর্তীতে এই খালের অর্ধেক অংশে রাস্তা নির্মিত হয়। অনেকে খালটি দখলও করে নেন। বড়পাড়া খালটি ছমির উদ্দিনের বাড়ির সামন থেকে সুরমার একটি ধারা হিসেবে প্রবাহিত হতো। এই খালটি সিএনবি’র রাস্তা সংলগ্ন খালে যুক্ত হয়ে মল্লিকপুরের সেতুর নিচ দিয়ে ঝাউয়ার হাওরে পানি নিষ্কাশন করতো। এই খালে বর্তমানে পৌরসভার রাস্তা নির্মিত হয়েছে। প্রবীণরা জানান, এই ৫টি খালই ছিল শহরবাসীর প্রাকৃতিক পানি নিষ্কাশনের প্রধানতম ধারা। এক সময় ড্রেন না থাকায় এই খালগুলোই নাগরিকদের পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থাকে সহজতর করেছিল। বিশেষ করে শহরের বিভিন্ন পাড়া-মহল্লার ড্রেনেজগুলো পতিত ছিল এসব খালে।
জানা গেছে, ২০০৪ সালে জেলা প্রশাসক জাফর সিদ্দিকের সময়ে কামারখাল উদ্ধারে অভিযানে নামে প্রশাসন। এসময় প্রায় অর্ধশত স্থাপনা গুড়িয়ে দেয়া হয়। উচ্ছেদ করা হয় দখলদারদের। এক বছরের মাথায় আবার স্থাপনা তৈরি শুরু হয়। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে আবার খাল উদ্ধারের তৎপরতা শুরু হলে রহস্যজনক কারণে তা বন্ধ হয়ে যায়। ২০১৮ সালে তৎকালীন জেলা প্রশাসক মো. সাবিরুল ইসলামের সময়ে কামারখালের অবৈধ দখলদারদের তালিকাও করা হয়েছিল। সুনামগঞ্জ সার্কিট হাউসে ২০১৮ সালের ২৪ নভেম্বর অনুষ্ঠিত বৈঠকে সুনামগঞ্জ শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত কামারখাল এখন দুই’শ প্রভাবশালী অবৈধ দখলে রয়েছে বলে আলোচনা ওঠে।
‘বন্যা পরবর্তী হাওররক্ষা বাঁধ মেরামত ও সংরক্ষণ বিষয়ে আলোচনা সভায়’ তৎকালীন পানিসম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এই কথা বলেন তৎকালীন জেলা প্রশাসক মো. সাবিরুল ইসলাম। সভায় তিনি উল্লেখ করেছিলেন, সংশ্লিষ্ট ভূমি অফিস দিয়ে জরিপ চালিয়ে দখলদারদের তালিকা করা হয়েছে। প্রশাসনিকভাবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে এবং তাদের উচ্ছেদ করে পানি নিষ্কাশনের জন্য খাল পুনরুদ্ধারের কথা জানিয়েছিলেন তিনি। জেলা প্রশাসক উদ্ধার অভিযান পরিচালনায় একটি প্রকল্প করে বরাদ্দ দেওয়ার জন্য পানিসম্পদমন্ত্রীকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। শহরের বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা মালেক হুসেন পীর বলেন, এই ৫টি খালই ছিল পৌর শহরবাসীর প্রাকৃতিক পানি নিষ্কাশনের প্রধানতম মাধ্যম। বাসা বাড়ি, সরকারি অফিস-স্থাপনার পানি নিষ্কাশিত হতো এই খালগুলো দিয়ে। যার ফলে বর্ষা মওসুমেও জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হতোনা। কিন্তু উন্নয়নের নামে অপরিকল্পিতভাবে খালগুলোতে হত্যা করে নাগরিকদের দুর্ভোগে ফেলা হয়েছে। এখন বৃষ্টি হলেই শহরে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। ভবিষ্যতে আরো বড় সংকট তৈরি করবে।
আইনজীবী প্রদীপ কুমার নাগ হারু বলেন, অপরিকল্পিত ড্রেনেজ ব্যবস্থা, খাল দখল-ভরাট, নাগরিক অসচেতনতায় ড্রেন ভরাট, সংশ্লিষ্টদের উদাসীনতাসহ নানাবিধ কারণে সুনামগঞ্জ জেলা শহরের পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। এটা এখন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। এই সমস্যার কারণে শহরের বাসাবাড়িতে বৃষ্টি ও ঢলের পানি ঢুকে পড়ছে। এগুলো উদ্ধার ও পরিকল্পিত ড্রেনেজ ব্যবস্থা না করলে আগামীতে নাগরিকরা আরো কঠিন সংকটে পড়বেন। পৌর মেয়র নাদের বখত বলেন, আমাদের পৌর শহরের পানি নিষ্কাশনের মাধ্যম খালগুলো ভরাট-দখল হয়ে গেছে। এগুলো উদ্ধারে প্রশাসনিক সহযোগিতা প্রয়োজন। এ ব্যাপারে নাগরিক সচেতনতাও জরুরি। তিনি বলেন, আমাদের পানি নিষ্কাশনের এই সমস্যা নিয়ে শীঘ্রই মতবিনিময় করে নাগরিকদের কাছ থেকে মতামত নিয়ে নিরসনের উদ্যোগ নেওয়া হবে।