দফতর সম্পাদক ছাড়াই চলছে বিএনপির দাফতরিক কার্যক্রম। দীর্ঘ দশ বছর ধরেই গুরুত্বপূর্ণ এই পদটি শূন্য অবস্থায় রয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে স্বাভাবিকভাবেই দলের দাফতরিক কাজে কোনো গতি আসেনি বিগত দিনগুলোতে। গত বছর দলের ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিল শেষে ঘোষিত কমিটিতেও এ পদের বিপরীতে কাউকে রাখা হয়নি। দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদকেই পুনরায় দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি এর আগেও যুগ্ম মহাসচিবের পাশাপাশি দফতর সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। এর পাশাপাশি তিনজনকে সহ দফতর সম্পাদক হিসেবে নতুন কমিটিতে স্থান দেয়া হলেও এদের মধ্যে দুইজনের বিরুদ্ধে রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। তাদের দাফতরিক কার্যকমে একদিকে যেমন ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে সংবাদ মাধ্যমগুলোকে অপরদিকে প্রতিনিয়ত বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হচ্ছে নেতাকর্মীদের।

আর এ কারণে রাজধানীতে একটি অনুষ্ঠানে বিএনপি ঘরানার বুদ্ধিজীবি ও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বিএনপির দফতরের কর্মকাণ্ডের কড়া সমালোচনা করেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত মির্জা ফখরুলের কাছে তিনি জানতে চান, রিজভী যে সকল বক্তৃতা-বিবৃতি দেন তা চেয়ারপারসনের সঙ্গে আলোচনা করে দেন কিনা। জবাবে, মির্জা ফখরুল কোনো উত্তর না দিয়ে নীরব থাকেন। ড. জাফরুল্লাহ ওই সময়ে রিজভী আহমেদকে উদ্দেশ্য করে প্রতিনিয়ত সংবাদ সম্মেলনের রেওয়াজ বন্ধের আহ্বান জানান।

এই বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির একজন সহ-দফতর সম্পাদক বলেন, ‘দফতরে কাজের কোনো সমন্বয় নেই। রিজভী ভাই যাকে ইচ্ছা তাকেই কাজ করতে দেন। দাফতরিক কাজগুলো সুষ্ঠুভাবে বণ্টন না হওয়ায় কেউই মনোযোগী হয়ে কাজ করতে পারছে না।’

বিএনপির নেতাকর্মীরা জানান, দলের একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট দফতরকে কব্জায় রেখে নিজেদের মতো করে পুরো পল্টন কার্যালয়ে প্রভাব ধরে রাখার চেষ্টা করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। তাই আগের মতোই অন্য পদ-পদবী থেকে দত্তক নেতা নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করার প্রচেষ্টায় হতাশ হয়ে পড়ছেন দলের নেতাকর্মীরা। বিএনপির মতো বড় একটি রাজনৈতিক দলের স্বতন্ত্র কোন দফতর না থাকায় রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক অনেক সমস্যা শুধু জিইয়ে রাখা হচ্ছে তা নয়, একধরণের স্বৈরতান্ত্রিকভাবে দলের প্রধান কার্যালয় পরিচালিত হচ্ছে বলেও অভিযোগ অনকের।

তারা জানান, সহ দফতর সম্পাদক হিসেবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রনেতা তাইফুল ইসলাম টিপুকে রাখা হয়েছে। এর আগে তার বিরুদ্ধে পদ-বানিজ্যসহ নানা অনিয়মের মাধ্যমে কয়েক কোটি টাকার দূর্নীতির অভিযোগ ও প্রমাণসহ সংবাদ মাধ্যমে আলোচনার ঝড় তোলে। তিনি রিজভী আহমেদের ‘কাছের লোক’ হিসেবে পরিচিত হওয়ার কারণে বিএনপির বিগত কমিটির সদস্য থেকে তিনি এ পদে চলে আসেন। তাইফুল ইসলাম টিপুর সিনিয়র হওয়ার পরও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রনেতা মনিরুজ্জামন মনিরকে দ্বিতীয় সহ দফতর সম্পাদক করা হয়েছে নতুন কমিটিতে। তৃতীয় সহ দফর সম্পাদক বেলাল আহমেদ এর বিরুদ্ধেও হত্যা, আর্থিক কেলেঙ্কারীসহ শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়েও অনেক অভিযোগ রয়েছে। সে ফেনী জেলা পৌরসভা বিএনপির জনপ্রিয় নেতা হত্যা মামলার এজাহারভূক্ত আসামী। নেতাকর্মীরা অভিযোগ করে বলেন, রিজভী আহমেদ একদিকে সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব এবং দলের ‘মুখপাত্র’ হিসেবে ধারাবাহিক সংবাদ সম্মেলন করেন। অপরদিকে দফতরে প্রভাব বিস্তার করতে গিয়ে লেজেগোবরে অবস্থা তৈরি করেছেন।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, গত বছর ২৭ সেপ্টেম্বর বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য হান্নান শাহ মারা যান। কিন্তু বিএনপির এই সিনিয়র নেতার মৃত্যু সংবাদ বা দলীয় চেয়ারপার্সনের শোকবার্তা প্রকাশের পরিবর্তে মহিলা দলের নতুন কমিটির খবর গণমাধ্যমে পাঠানো হয়। দফতরের এমন কাণ্ডজ্ঞানহীন কর্মকান্ডে তখন ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন বিএনপির নেতারা। ২৪ জানুয়ারি গণ-অভ্যুত্থান দিবস উপলক্ষে বিএনপির চেয়ারপার্সনের পাঠানো বিবৃতিতে অন্তত ১০টি ভুল পাওয়া গেছে। ২৬ জানুয়ারী দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মামলায় গ্রেফতারী পরোয়নার প্রতিবাদে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিবৃতিতে তারেক রহমানকে সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এছাড়া প্রতিদিন বিএনপির দফতর থেকে গণমাধ্যম কর্মীদের মুঠোফোনে যে সকল খুদে বার্তা পাঠানো হয় তাতেও থাকে ভুলের ছড়াছড়ি। দলের একজন নেতা জানান, গত ১৪ মার্চ বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার আদালতে হাজিরা উপলক্ষে দলের সহ দফতর সম্পাদক বেলাল আহমেদ নেতাদের নিকট “Recpected Leadear, BNP Chairpersion Deshnetri Begume Khaleda Zia Will go to Dhaka Judge Coart Tomorrow ( 14 Mar) 9AM. Pls Attend There. Regards-Belal Ahamed” ক্ষুদে বার্তা পাঠান। আবার ৩১ মার্চ রাত ১টা ৪০ মিনিটে গণমাধ্যমে বিএনপি চেয়ারপারসনের বিবৃতি পাঠানো হয় কোনো উদ্দেশ্য ছাড়াই।

এদিকে রুহুল কবীর রিজভীর কর্মসূচি কভার করতে যেভাবে খুদে বার্তা পাঠানো হয় তা মির্জা ফখরুলের অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে হয় না। বিএনপির মহাসচিবের প্রতিদিনের কর্মসূচির খবর হাতে গোনা কয়েকটি গণমাধ্যমকে জানানো হয়।

দলীয় সূত্র জানায়, ওয়ান ইলেভেনের জরুরী সময়ে দলের দফতর সম্পাদক মফিকুল হাসান তৃপ্তিকে তৎকালীন মহাসচিব অ্যাডভোকেট খন্দকার দেলোয়ার হোসেন বিএনপি থেকে বহিষ্কার করার পর নতুন করে কাউকে এই পদে নিয়ে আসা হয়নি। পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিলে দলের সহ দফতর সম্পাদক রুহুল কবির রিজভীকে যুগ্ম মহাসচিব পদে উন্নীত করার আগে থেকেই তিনিই দফতরের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। এরপর একাধারে তিনি দলের মুখপাত্র এবং অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করার পাশাপাশি দফতরের দায়িত্বও পালন করছেন।

সূত্রটি জানায়, দফতরের দায়িত্বপ্রাপ্ত রুহুল কবির রিজভী বিগত বছরগুলোতে দাফতরিক কাজ সম্পন্ন করার জন্য এ শাখার দায়িত্বশীলদের নিয়ে নিজেদের মধ্যে কোন বৈঠক, পরিকল্পনা কিংবা দফতর টিম নিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এমনকি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এর সাথেও কোন বৈঠক করেননি বিগত দিনে। আবার দাফতরিক কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার জন্য সহ দফতর সম্পাদকদের মধ্যে দায়িত্ব বন্টনের কাজটিও করা হয়নি বলে জানা গেছে।

এদিকে দফতরের স্বাভাবিক রুটিন কাজ হিসেবে বিগত দিনে নেতাকর্মীদের ওপর নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র- মামলার পরিসংখ্যান, নিহত, গুম কিংবা পঙ্গুত্ব বরণকারীদের সঠিক তথ্য নেই দায়িত্বশীলদের কারো কাছে। পাশাপাশি সারাদেশে নেতাকর্মীদের নামে মামলার হিসাব নিয়েও রয়েছে জটিলতা। কারাগারে আটক নেতাকর্মীদের আইনি সহযোগিতার জন্য দফতর থেকে কোন তালিকা তৈরী করে আইনজীবিদের কাছে দেওয়া হয় না বলেও অভিযোগ রয়েছে। একইভাবে সঠিক মনিটরিং না থাকার কারনে ক্ষতিগ্রস্থ নেতাকর্মীরাও দল ধেকে সুবিধাবঞ্চিত হচ্ছেন।

নেতাকর্মীরা জানান, সব কাজ ও নির্দেশনা রিজভী আহমেদের নির্দেশনায় হয়ে থাকে বলে দফতরের অন্য কোন নেতার মূলত কোন কাজ করার সূযোগ নাই। এছাড়া, রিজভী বলয়ের বাইরে গিয়েও তাদের কিছু করার থাকে না। যার কারনে এ শাখায় একটি হ-য-ব-র-ল অবস্থা বিরাজ করছে দীর্ঘদিন ধরে। যা অদূর ভবিষ্যতে আরো ভয়াবহ অবস্থায় রূপ নিতে পারে বলে আশঙ্কা নেতাকর্মীদের। অনেক নেতাকর্মী দলের দায়িত্বশীল সহ দফতর সম্পাদকদের কটাক্ষ করে ‘মাছিমারা কেরানির’ সাথে তুলনা করে বলেন, দলের এই দূর্বলতাকে পুঁজি করে অনেক নেতা নিজেদের আখের গুছিয়ে নিচ্ছেন।

এসব বিষয়ে বিএনপির সিনিয়র নেতৃবৃন্দ জানান, যে কোন রাজনৈতিক দলের দফতর শাখা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এখান থেকেই দলের সকল সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য একটি যোগসূত্র তৈরী করা হয়। আর এ শাখাটিকে মূলত দলের মহাসচিব এর অধীনে সুবিন্যস্ত করার নিয়ম থাকলেও বিএনপিতে এর ব্যতয় ঘটছে কয়েক বছর ধরে। তারা বলেন, দলের মহাসচিবের নিয়ন্ত্রনে দাফতরিক কাজ সম্পন্ন করা, সারাদেশের নেতাকর্মীদের সুবিধা-অসুবিধাসহ, রাজনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়ন ও সমাজের বিভিন্ন পেশাজীবিদের সাথেও সমন্বয় করে থাকে এ দফতর শাখা। কিন্তু এখন বিএনপির মহাসচিব এর নিয়ন্ত্রনে দফতর কতটুকু কাজ করছে তা আমরাও জানি না।

নেতাকর্মীরা জানান, সারাদেশের তৃণমূল নেতাকর্মীদের সাথে দলের হাইকমান্ডের যোগাযোগের সহজ উপায় হচ্ছে দফতর শাখা। কিন্তু বিগত দিনে এই শাখায় কোনো দফতর সম্পাদক না থাকায় এবং সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব এর মতো একটি বড় পদের নেতাকে দায়িত্ব দেওয়ার কারণে কর্মীরাও স্বভাবজাত তটস্থ অবস্থায় থাকেন। প্রাণ খুলে তাদের সমস্যা-সুখ-দুঃখ নিয়ে আলোচনার চিন্তাও করতে পারেন না বলে দীর্ঘদিনের অভিযোগ।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn