দিনাজপুর থেকে হারিয়ে যাচ্ছে ১৯টি নদী
সুলতান মাহমুদ, দিনাজপুর।।
দিনাজপুরের অনেক নদীর বুকে এখন ধান সহ অন্যান্য ফসল চাষ হয়। এই চিত্র দিনাজপুরবাসীর জন্য সুখকর নয়। জেলার কৃষিকাজে শুষ্ক মৌসুমে খরা একটি প্রধান অন্তরায়। খরার কারণে ফসল বাঁচাতে এই অঞ্চলের কৃষকদের প্রতি বছর হিমশিম খেতে হয়, বাড়তি খরচও হয় অনেক বেশী। দিনাজপুরের মাটিতে যেন সোনা ফলে। কৃষি সমৃদ্ধ ও খাদ্য শস্য উদ্বৃত্ত এই জেলায় বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে ধানসহ অন্যান্য খাদ্য শস্যের আবাদ হয়। দিনাজপুরের শতকরা ৮৫% মানুষ পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে কৃষি কাজের সাথে জড়িত। এখানকার মানুষের অর্থনীতি কৃষিকে ঘিরে। সোনালী ফসল ফলাতে কৃষকরা দিনরাত পরিশ্রম করে। দিনাজপুরে খরা ছাড়া আর কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ নেই। এখানে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ খুবই কম হওয়ায় প্রতিবছরই প্রচণ্ড খরা দেখা দেয়। নদ-নদীর সংখ্যাও এখানে কম। দিনাজপুরে মোট আবাদী জমির পরিমাণ ৬ লক্ষ ৯ হাজার ৫৫৩ হেক্টরের মত।
ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে এ অঞ্চলে তাপমাত্রা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে, শুরু হয় অনাবৃষ্টি আর খরায় কৃষকদের হাহাকার। ফসল বাঁচানোর জন্য পানি যোগাড় করতে কৃষকদের হিমশিম খেতে হয়। কৃষকরা পানির জন্য যতই মরিয়া হয়ে ওঠেন ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর যেন ততই নিচে নামতে থাকে। সর্বোচ্চ তাপমাত্রা তখন ৩০ থেকে ৩২ ডিগ্রীর মধ্যে উঠানামা করে। দিনাজপুরে বার্ষিক বৃষ্টিপাতের গড় পরিমাণ মাত্র ১৬৫ থেকে ১৭০ মিলিমিটার। এসময় সেচের পানি ব্যবহার করতে কৃষকরা মাটির নিচে ১৫ থেকে ২০ ফুট গর্ত করে পাম্প বসিয়ে পানি তোলার চেষ্টা করেন। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হন তারা। দিনাজপুর সদর থানার দক্ষিণ অংশ সহ জেলার ফুলবাড়ী, বিরামপুর, নবাবগঞ্জ ও বিরল উপজেলায় বেশ কিছু অংশ জুড়ে প্রতি বছর খরার তান্ডব শুরু হয়। পানি তোলার জন্য সবরকম চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর শেষ পর্যন্ত সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা শুরু হয়। মাঠে-হাটে-ঘাটে সর্বত্রই চলে এই প্রার্থনা। আবার প্রত্যন্ত গ্রাম অঞ্চলে ব্যাঙের বিয়েরও আয়োজন করা হয়ে থাকে। কিন্তু দিনাজপুরের উপর দিয়ে প্রবাহিত পুণর্ভবা, আত্রাই, টাঙ্গন, গর্ভেশ্বরী, গাবুরা, কাঁকড়া নদীর পানি উপচে বর্ষায় বন্যা হলেও মৌসুম শেষে শুকাতে থাকে। জানুয়ারী মাসের পর এসব নদী পানি শূণ্য হয়ে যায়। নদীর বুকে গজাতে শুরু করে ঘাস। এপ্রিল মে মাসে নদীর প্রবাহ সম্পূর্ণ রূপে বন্ধ হয়ে যায়। তখন নদীতে কোন পানি থাকে না। কোথাও সামান্য হাঁটু পানি থাকে। তখন নদীর বুকে চলে বালি সংগ্রহের মহোৎসব। দিনাজপুর শহরের পশ্চিম প্রান্ত দিয়ে বয়ে যাওয়া পূর্ণভবা নদী এই সময়ে ধুধু বালুচরে পরিণত হয়। অথচ দেড় থেকে দু-দশক আগেও এই নদীর পানি দিয়ে সেচ কাজ করে শত শত হেক্টর জমিতে সোনার ফসল ফলানো হত।
নদীগুলির উৎস মুখ ভারতে হওয়ায় গ্রীষ্ম মৌসুমে ভারত সেখানে বাঁধ দিয়ে পানি আটকে রাখে। ফলে বাংলাদেশের অংশে নদী বাঁচিয়ে রাখার মত অবশিষ্ট পানিটুকুও থাকে না। প্রতিবছর এ শুষ্ক নদীর প্রতিক্রিয়া শুধু দিনাজপুর জেলার উপরই নয় জাতীয় অর্থনীতির উপরেও মারাত্মক প্রভাব ফেলে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, দিনাজপুর জেলায় প্রতি বছর উৎপন্ন ধান মজুদ করে জেলাবাসীর প্রায় সাড়ে ৪ বছরের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। কিন্তু এখানকার কৃষকদের ভাগ্যোন্নয়নে কোন সরকারই আজ পর্যন্ত কার্যকর ভূমিকা পালন করেনি। দীর্ঘদিন ধরে এই অবস্থা বিরাজ করলেও কোন সরকারের সুনজর পড়েনি দিনাজপুরের দিকে। জেলায় এতো দিনেও কোন পূর্ণাঙ্গ ধান গবেষণা কেন্দ্র গড়ে ওঠেনি। অথচ দিনাজপুর জেলা দেশের খাদ্য সরবরাহে বিশেষ ভূমিকা রাখে। খাদ্য শস্য উৎপাদনে অপার সম্ভাবনাময় এ জেলায় নদী খননের কোন ব্যবস্থা আজও গ্রহণ করা হয়নি। স্থানীয় কৃষকরা নিজস্ব বুদ্ধিমত্তা ও পরিশ্রমে দেশের খাদ্য চাহিদায় অত্যন্ত সহায়ক ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন যুগ যুগ ধরে।
সংস্কারের অভাবে দিনাজপুরের বুক থেকে পুরোপুরি কিংবা আংশিক হারিয়ে গেছে এক ডজন নদ-নদী। অথচ বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড নদী সংস্কারের নামে প্রতিবছই খরচ করছে হাজার হাজার মেট্রিক টন গম বা চাল। দিনাজপুর জেলার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া নদ নদীর সংখ্যা ছিল ১৯টি। এগুলো হলো- করতোয়া, তুলশীডাংগা, ছোটযমুনা, পূণর্ভবা, তিলাই, কাঁকড়া, আত্রাই, বেলান, ইছামতি, ভেলামতি, চিরি, তুলাই, টাঙ্গন, সোয়া, ঢেপা, ছোটঢেপা, পাথরাজ, এবং গর্ভেশ্বরী। পাল তুলে এসব নদ নদী বেয়ে এক সময় চলাচল করত যাত্রীবাহী নৌকাসহ মহাজনী নৌকা। আংশিকভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়া নদ-নদীগুলো হচ্ছে কাঁকড়া, পাথরাজ, তুলশীগঙ্গা, ইছামতি ও টাঙ্গন। এ জেলার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া নদ-নদীর বেশীর ভাগেরই উৎস ভারত। কোন কোনটি উপ-নদী বা শাখা নদী। বন্ধ হয়ে যাওয়া নদীগুলোর মধ্যে সবগুলোই কোন না কোন নদীর শাখা-কোনটি অথবা প্রশাখা। মাহিলা নদী প্রবাহিত হতো ঘোড়াঘাটের উপর দিয়ে। তিলাই প্রবাহিত হতো পার্বতীপুর উপজেলা দিয়ে। বেলান প্রবাহিত হতো চিরিরবন্দর ও খানসামা উপজেলা দিয়ে চিরি ও ভেলামতি প্রবাহিত হতো চিরিরবন্দর উপজেলা দিয়ে। সোয়া নদী বোচাগঞ্জের স্থানীয় নদী। এখন এসব নদ-নদীর বুক ভরাট হয়ে শস্যক্ষেতের সমান্তরালে এসে দাঁড়িয়েছে। এসব নদ-নদীর বুকে এখন রীতিমত আবাদ হচ্ছে ধানসহ অন্যান্য ফসল। কোথাও কোথাও স্থানীয় লোকজন মাছ চাষ করতে এগুলোকে জলাশয়ে রূপান্তরিত করেছে। গর্ভেশ্বরী নদীর ভাটিমুখ এবং উৎস মুখ বন্ধ হয়ে গেছে। সদর উপজেলার দেড় কিলোমিটার এলাকায় নদী থাকার প্রমাণ হিসেবে পানির সামান্য অস্তিত্ব আছে।
আংশিকভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়া নদ-নদীর মধ্যে পাথরাজ বীরগঞ্জ উপজেলা, তুলশীগঙ্গা হাকিমপুর ও নবাবগঞ্জ উপজেলা, কাঁকড়া চিরিরবন্দর উপজেলা, ইছামতি, চিরিরবন্দর উপজেলা এবং টাঙ্গন বীরগঞ্জ উপজেলা দিয়ে প্রবাহিত হতো। এসব নদ-নদীর ৭০-৭৫ ভাগই বন্ধ হয়ে গেছে। বর্তমানে ঘোড়াঘাট এবং নবাবগঞ্জ উপজেলা দিয়ে প্রবাহমান রয়েছে করতোয়া নদী। এই অঞ্চলের কৃষি ও অর্থনীতি বহুলাংশে নির্ভরশীল ছিল এসব নদ-নদীর উপর। আবহাওয়াকে নাতিশীতোষ্ণ রাখতে সহায়তা করত এসব নদ-নদী। এছাড়া এগুলো ছিলো মাছে পরিপূর্ণ, যা এই অঞ্চলের মানুষের আমিষের চাহিদাও পূরণ করত অনেকাংশে। বিরামপুর, ফুলবাড়ী, পার্বতীপুর ও সদর উপজেলার উপর দিয়ে বয়ে চলেছে পূণর্ভবা, চিরিরবন্দর, খানসামা ও বীরগঞ্জের উপর দিয়ে প্রবাহমান রয়েছে আত্রাই, বিরল ও বোচাগঞ্জ হতে বয়ে চলেছে তুলাই এবং কাহারোল ও বীরগঞ্জ উপজেলা দিয়ে প্রবাহমান রয়েছে ঢেপা নদী। এর মধ্যে তুলাই, ঢেপা, ছোট যমুনা এবং পূনর্ভবার স্থানে স্থানে জেগে উঠছে বিস্তীর্ণ চর। পানি প্রবাহের ধারা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে আসছে।
জেলার নদ-নদীর এই বেহাল অবস্থা আবহাওয়ার উপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। কয়েক বছর আগেও জেলার বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত ছিল ১২.৫। কিন্তু এখন খরা হয়ে উঠেছে এখানকার মানুষের প্রতি বছরের সঙ্গী। নদ-নদী থেকে আহরিত সুস্বাদু পানির মাছ এখন দুষ্প্রাপ্য হয়ে পড়েছে। পেশা বদল করতে হচ্ছে জেলে এবং মাঝি-মাল্লাদের। নদ-নদীর বেহাল দশার জন্য দায়ী করা হচ্ছে মাটির গঠনশৈলী, নদ-নদীর সর্পিল গতিপথ এবং সংস্কার না হওয়াকে। জেলার বেশীরভাগ নদ-নদীর গতিপথ অস্বাভাবিক সর্পিল বিধায় উজান হতে বয়ে আসা বর্জ্য এবং পলি জায়গায় জায়গায় আটকে যায়। এভাবে পলি ও ময়লা ইত্যাদি জমে বন্ধ হয়ে যায় নদীর গতিপথ।
তা ছাড়া এই অঞ্চলের মাটি মূলতঃ দো-আঁশ এবং বেলে দো-আঁশ জাতীয়। ফলে নদীর পাড় সামান্য বর্ষনেই ভেঙে পড়ে নদীর স্বাভাবিক গতিতে বাঁধা দেয়। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড হাজার হাজার মেঃ টন গম বা চাল বরাদ্দ দেয় নদী সংস্কারের নামে। কিন্তু সংস্কার না হয়ে বরাদ্দকৃত গম কৌশলে আত্মসাৎ করা হয় এমন অভিযোগ রয়েছে বিস্তর। এজন্য সংস্কার রয়ে যায় শুন্যের পর্যায়েই। আর নদ-নদীর নাব্যতা কমতে থাকে প্রতি বছর। এভাবে বন্ধ হয়ে যায় নদ-নদীগুলো। বর্তমানে খরাপীড়িত দিনাজপুরের শতকরা ৮০ থেকে ৮৫ ভাগ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষি নির্ভর। দিনাজপুর জেলা বরাবরের মত এখনও অবহেলিত। সরকারের পরিকল্পনার মধ্যে দিনাজপুরের নদী খনন পরিকল্পনা কোনদিনই ছিল না, এখনও নেই। অথচ দিনাজপুরের কৃষি পণ্য দেশের অর্থনীতিতে অনেক বড় ভূমিকা পালন করে। সরকারের উদাসীনতা এ অঞ্চলের কৃষক, জেলে, মাঝি সহ সর্বস্তরের সাধারণ জনগণকে চরম ভোগান্তিতে ফেলেছে।
এলাকাবাসীর মন্তব্য, নদীর বুকে আবাদ হোক এটা আমাদের কাম্য নয়। আমাদের কৃষকরা আশা করে সারা বছর নদী জলে ভরে টইটম্বুর থাক। নদীর দুই কুল কানায় কানায় ভরে থাক। বিশেষজ্ঞদের অভিমত হলো, নদী খনন করে সেগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করা গেলে তা এই অঞ্চলের অর্থনীতি এবং আবহাওয়ার ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এছাড়া ভারতের কাছে পানির ন্যয্য হিস্যা নেওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক কুটনৈতিক প্রচেষ্টাও জোরদার করতে হবে। সর্বোপরি, দিনাজপুরের নদীগুলো পুনঃখনন করার জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে এই প্রত্যাশা দিনাজপুর বাসীর।