দীপু ঘুমাক, বাংলাদেশ জেগে থাক…পীর হাবিব
পীর হাবিবুর রহমান-
আতিয়া মহলে জঙ্গিদের আস্তানার খবর পাওয়ার আগেই ঢাকায় আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণে নিহত হওয়ার একাধিক ঘটনা ঘটেছে। আশকোনার র্যাব ক্যাম্প, খিলগাঁওয়ে চেকপোস্ট ও বিমানবন্দর প্রবেশমুখে এ ঘটনাগুলো ঘটে। তারপরই আতিয়া মহলে জঙ্গিদের আস্তানার খবর ছড়িয়ে পড়ে। প্রতিটি ঘটনায় সন্ত্রাসবাদী সংগঠন আইএস দায় স্বীকার করেছে। দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী, র্যাব ও পুলিশ সদস্যরা দেশপ্রেম ও জঙ্গি আস্তানা গুঁড়িয়ে দিতে যে অমিত সাহস দেখিয়ে যাচ্ছেন তাকে অভিবাদন জানাতে হয়।
সেনাবাহিনীর প্যারা-কমান্ডো দল বিচক্ষণতা ও দক্ষতার সঙ্গে আতিয়া মহলে আটকে পড়া শিশু, নারী ও পুরুষদের যেভাবে নিরাপদে ফিরিয়ে এনেছে বাংলাদেশের ইতিহাসে তা সোনার হরফে লেখা থাকবে। একই সঙ্গে আত্মঘাতী জঙ্গিদের আস্তানা গুঁড়িয়ে দিতে যে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে তাতে হৃদয়নিঃসৃত অভিনন্দন জানানোর ভাষা আমার জানা নেই।
২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস, বাঙালি জাতির জীবনে এক বেদনাবিধুর নাম। সেদিন ভোর সাড়ে ৪টার ফ্লাইটে সিলেট গিয়েছিলাম ডাক্তার সাখাওয়াত হোসেনের লেখা ‘স্মৃতির পালে লাগলো হাওয়া’ বইটি নিয়ে আড্ডায় যোগ দিতে। ভোররাতের বিমানে দেখা হলো সুনামগঞ্জের সেনাশাসনবিরোধী, ছাত্র আন্দোলনের দুই প্রিয় মুখ, অনুজপ্রতিম শাহরিয়ার চৌধুরী বিপ্লব ও আসাদুজ্জামান সেন্টুর সঙ্গে। দুজনই স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সিলেট যাচ্ছিলেন। আকাশপথে বৈরী আবহাওয়ার মুখোমুখি বিমান ঝাঁকি খেতে খেতে সিলেটে নিরাপদেই নামালো। সিলেট ক্লাবের গেস্ট হাউসে শয্যা নিতে নিতে পর্দা সরিয়েই দিলাম। বাইরে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, আকাশে কালো মেঘ, গুড়, গুড় শব্দ আর অবিরাম বৃষ্টিপাতে মনটাই ভরে গেল। টানা ঘুম দিয়ে স্নেহভাজন সৈয়দ মনোয়ার, রায় রিংকু, বিশ্বজিৎ চৌধুরী, রেজওয়ান আহমেদ ও বন্ধু বকুলকে নিয়ে সিলেটের প্রখ্যাত গাইনি বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্য বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা লুত্ফুন নাহার জেসমিনের বাসভবনে মধ্যাহ্নভোজে মিলিত হলাম। সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজের অবসরপ্রাপ্ত শ্রদ্ধেয় প্রবীণ শিক্ষক অধ্যাপক আবদুর রশীদের কন্যা লুত্ফুন নাহার জেসমিন আমার বধুরা আপা পিঠেপিঠি বড় বোন জেব-উন নেসা খানম পুষ্পর ছোটবেলার বান্ধবী। উনার একমাত্র পুত্র মঞ্জুর মোর্শেদ টিপু আমার ছোটভাই সংসদ সদস্য পীর ফজলুর রহমান মিসবাহর শৈশবের বন্ধু। রশীদ স্যার একজন দিলখোলা, প্রাণবন্ত শিক্ষক। তার বড় মেয়ে পারভীন আপা ডাক্তার। টিপু সাউথইস্ট ব্যাংকের (এভিপি) ম্যানেজার। মধ্যাহ্নভোজের মধ্য দিয়ে গভীর মমতায় জড়ানো প্রখর সেন্স অব হিউমার নিয়ে আড্ডা গড়ায় বিকাল পর্যন্ত। বই নিয়ে আড্ডার আয়োজন করেছে স্নেহভাজন রাজীব চৌধুরীর প্রকাশনী চৈতন্য।
রাত ৮টায় বই নিয়ে আড্ডায় বইপ্রেমীরা সমবেত হয়েছেন মুসলিম সাহিত্য সংসদে। বালাগঞ্জ কলেজের শিক্ষক, সাংবাদিক অহি আলম রেজা ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের তরুণ কর্মী উজ্জ্বল চৌধুরীর নেতৃত্বে ঘটেছে তারুণ্যের সমাবেশ। বধুরা আপার স্বামী ডাক্তার সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান হলেও মুক্তমনের উদার, অসাম্প্রদায়িক ভালো মানুষ। সিলেটকে বলা হয় আধ্যাত্মিক রাজধানী। ইসলাম ধর্মের প্রচারে আসা হজরত শাহজালাল (রহ.), হজরত শাহ পরান (রহ.)-এর মাজার রয়েছে পুণ্যভূমি সিলেট শহরে। সারা দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষ মাজার জিয়ারত ও সিলেট ভ্রমণে পরিবার-পরিজন নিয়ে আসেন। সিলেটের এত এত হোটেল, গেস্ট হাউস, কোথাও তখন রুম খালি পাওয়া যায় না। শাহজালাল (রহ.) দরগা থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে প্রাকৃতিক নৈসর্গিক দৃশ্যশোভিত অসংখ্য সামরিক ও বেসমারিক আমলার জন্মস্থান গোলাপগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ধর্মগুরু শ্রীচৈতন্য দেবের আশ্রম। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঐহিত্যের বন্ধনে আবদ্ধ করে রেখেছে সিলেট বিভাগের বিশাল জনগোষ্ঠীকে। হাওর, বাঁওড়, সুফি, সাধক, বাউল ও মরমি কবিদের তীর্থভূমি হিসেবে প্রবাসী অধ্যুষিত সিলেট বিভাগ রাজনীতি ও সংস্কৃতিতে এমনকি সুমহান মুক্তিযুদ্ধে অনন্য সাধারণ ভূমিকা রাখার জন্য ইতিহাসে গৌরবময় ঠাঁই নিয়েছে। সুমহান মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসামানী, উপ-প্রধান সেনাপতি জেনারেল আবদুর রব মুক্তিযুদ্ধের অনন্য সাধারণ সংগঠক। রাজনীতিবিদ মরহুম আবদুস সামাদ আজাদ, দেওয়ান ফরিদ গাজী, কূটনীতিক ও স্পিকার মরহুম হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী, বোমা হামলায় নিহত সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এম এস কিবরিয়া, প্রবীণ পার্লামেন্টারিয়ান প্রয়াত সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, ’৬৯-এর ডাকসুর জিএস নাজিম কামরান চৌধুরী ও স্বাধীনতা-উত্তর সেনাশাসনকবলিত বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতির উজ্জ্বল নক্ষত্র ডাকসু ভিপি সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদের জন্মভূমি সিলেট। সিলেটের মানুষ ধর্মপ্রাণ, কিন্তু রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্রোতধারায় সুমহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরবের উত্তরাধিকারিত্ব বহন করে চলার কারণে এখানে সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে কখনো ঘটেনি। তাই, কোনো নির্বাচনেই স্বাধীনতাবিরোধী, ধর্মান্ধ রাজনৈতিক শক্তির প্রার্থী বিজয়ী হওয়া দূরে থাক নির্বাচনে জামানত হারাতে হয়েছে। সেনাশাসন জামানায় ধর্মান্ধ শক্তির হাতে জাসদ ছাত্রলীগের কর্মী মুনির, তপন, জুয়েল শাহাদাতবরণ করলেও বোমা হামলায় কিবরিয়ার মতো বিশ্ববরেণ্য মানুষের মৃত্যু ঘটলেও জামায়াতের বিজয় ঘটেনি কোনো জাতীয় নির্বাচনে।
কিন্তু গভীর বেদনা ও দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, পশ্চিমবঙ্গের চারু মজুমদারের হঠকারী, উগ্র, মানুষ হত্যার রাজনীতির মতো জঙ্গিবাদের গোপন আস্তানা সিলেট বিভাগে গড়ে উঠেছিল বলেই কিবরিয়াকে জীবন দিতে হয়েছে ভোটের প্রচারণায়। হরকাতুল জিহাদের ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি মুফতি হান্নানের সহযোগীদের নীলনকশায় সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের প্রাণনাশের জন্য বোমা হামলা হয়েছে। সিলেটের সাবেক নন্দিত মেয়র বদরুদ্দিন আহমদ কামরানের প্রাণনাশের লক্ষ্যে হোটেল গুলশান থেকে নানা জায়গায় গ্রেনেড হামলা হয়েছে। হোটেল গুলশানে আওয়ামী লীগ কর্মীর রক্ত ঝড়েছে। সিলেটের রাজনীতিতে দেশের অর্থনীতির সংস্কারক খ্যাত মরহুম সাইফুর রহমানের জন্ম হয়েছে। কিন্তু বেদনার সঙ্গে বলতে হয়, বিএনপি-জামায়াত জামানায় সারা দেশে জঙ্গিবাদের যে উত্থান ঘটেছিল জেএমবির ব্যানারে, রাজশাহীর বাগমারা থেকে যার দম্ভ ও আস্ফাালন সেই নিষিদ্ধ সংগঠনের শীর্ষ দুই নেতা ফাঁসির দণ্ডে দণ্ডিত শায়খ আবদুর রহমান ও সিদ্দিকুর রহমান ওরফে বাংলা ভাই। দুজনের মধ্যে শীর্ষ নেতা শায়খ আবদুর রহমানকে র্যাব আটক করেছিল সিলেটের সূর্যদীঘল বাড়ি থেকে।
সর্বশেষ সিলেটের দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ী এলাকার আতিয়া মহলে ভয়ঙ্কর, আত্মঘাতী জঙ্গিদের আস্তানা উদঘাটন হয়েছে। এটিকে হালকা করে দেখার কোনো সুযোগ বাংলাদেশ বা সিলেটের রাজনৈতিক শক্তির কোনো সুযোগ নেই। ঢাকায় যখন আত্মঘাতী বোমা হামলাকারীরা নিহত হয়েছে তখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই বলার চেষ্টা করেছেন— এ সরকারের সাজানো নাটক। ভারতের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তি সম্পাদনের জন্যই এটি সাজানো হয়েছে বলে কেউ কেউ বলতে দ্বিধা করেননি। কিন্তু সিলেটের আতিয়া মহলের ঘটনা বাংলাদেশের জনগণই নয়, বিশ্ববাসীর সামনে উন্মোচিত হয়েছে যে, লাখো শহীদ আর দুই থেকে তিন লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে জাতির মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের আস্তানা গড়ে উঠেছে। যদিও মুজিবকন্যা শেখ হাসিনার সরকার শুরু থেকেই সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদের প্রশ্নে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ ও অ্যাকশনে যেতে দ্বিধা করেননি, তবুও তারা বসে নেই। লাখো শহীদের রক্তে অর্জিত বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদের ঠাঁই হতে পারে না। আমাদের সুমহান মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্যই ছিল সমতার নীতি। রক্তে লেখা সংবিধানে জনগণকেই ক্ষমতার মালিক করা হয়েছে। স্বপ্ন ছিল একটি অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, বৈষম্যহীন রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থার। সেই লক্ষ্য অর্জন এখনো হয়নি। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের উত্তরাধিকারিত্ব বহন করলে রাজনীতিকে লুটেরা, দুর্নীতিগ্রস্ত, দুর্বৃত্তদের হাত থেকে আদর্শ ও মূল্যবোধের ধারায় ফিরিয়ে আনার কোনো বিকল্প নেই।
গ্রাম-গঞ্জে যাত্রা, পালা গান, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কলেজ ছাত্রসংসদ নির্বাচনের দুয়ার খুলে দিতে হবে। এই দুয়ার বন্ধ রাখলে তার নেতিবাচক প্রভাব এড়ানো যাবে না। আফগানিস্তান ও ইরাকের দখলনীতির প্রতিক্রিয়ায় উদার গণতান্ত্রিক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারেই হামলা হয়নি। সব মত-পথ ধারণ করা সংবিধান ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল গণতন্ত্রের গর্ভস্থান বিশ্বদরবারে সভ্য জাতি হিসেবে উদ্ভাসিত ওয়েস্ট মিনস্টার বা ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সামনেও সেদিন সন্ত্রাসবাদের হামলা সংঘটিত হয়েছে। নিরাপত্তারক্ষীরা নিহত হয়েছেন।
সন্ত্রাসবাদ আজকের দুনিয়ায় সভ্যতা ও মানবতাবিরোধী অবস্থানে দাঁড়িয়েছে। পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দুনিয়ার ভ্রান্ত নীতির বিপরীতে ধর্মযুদ্ধের নামে যা শুরু হয়েছে তার অভিশাপ তামাম দুনিয়ার শান্তি বিঘ্নিত করেছে। উদার গণতান্ত্রিক সংখ্যারিষ্ঠ মুসলিমগুলোও সেই অশুভ শক্তির বিষাক্ত নখের আঁচড়ে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। পশ্চিমাদের যেমন ভাবতে হবে, তেমনি মুসলিম অধ্যুষিত দেশের জনগণকে সচেতন হতে হবে। ধর্মের নামে প্রতিহিংসার আগুনে সন্ত্রাসের পথ কতটা আত্মঘাতী ও ভয়ঙ্কর তা উপলব্ধি করতে হবে। সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে, জঙ্গিবাদের সঙ্গে শান্তির ধর্ম, মানবতার ধর্ম ইসলাম জড়িত নয়। উগ্রপন্থি, আত্মঘাতী জঙ্গিদের কারণে গোটা দুনিয়ায় মুসলমানরা আজকে প্রশ্নবিদ্ধই নয়, নিন্দিতই নয়; এমনকি ধর্মপ্রাণ মুসলমানরাও জঙ্গি, সন্ত্রাসীদের হাতে জীবন দিচ্ছে।
সিলেটের আতিয়া মহলের ঘটনায় গ্রেনেড বিস্ফোরণে নিহত সিলেটের পুলিশ কর্মকর্তা চৌধুরী মোহা. আবু কায়সার দীপু আমার বন্ধু ছিল। একাত্তরের গণহত্যার বেদনাবিধুর, শোকের স্মৃতিবহ এই রাতে নিহত হতে হয়েছে তাকে। যে শক্তির গ্রেনেডে নিহত হয়েছেন বন্ধু দীপু, সেই শক্তির ইন্ধনদাতা একাত্তরের পরাজিত শক্তির গোয়েন্দা সংস্থা। এই সত্য জানার জন্য তাবৎ পৃথিবীর মোটা মোট বই পড়ার প্রয়োজন নেই। সুনামগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী সরকারি জুবলি স্কুলে তৃতীয় থেকে আমরা যারা পাঠ শুরু করেছিলাম, দীপু তাদের একজন। লেখাপড়ায় পিছিয়ে পড়া দীপুর সঙ্গে দীর্ঘদিন যোগাযোগ নেই। একজন জনপ্রিয় ক্রিকেটার থেকে পুলিশ সদস্য হওয়ার পর বারদুয়েক টেলিফোনে কথা হয়েছে। যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা বন্ধুত্বকে শিথিল করেছে। দীপুর বাবা মরহুম অ্যাডভোকেট আছদ্দর আলী চৌধুরী একজন সম্ভ্রান্ত মুসলমান পরিবারের উত্তরাধিকারীই ছিলেন না, ভদ্র ও বিনয়ী, নিরহঙ্কারী, সৎ এবং সাহসী মুক্তিযুদ্ধের অনন্যসাধারণ সংগঠক ছিলেন। জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন অনেক বছর। আদালত থেকে ফিরে বাগানে মনোনিবেশ করতেন। তার সন্তানরাও বড় হয়েছিলেন বাবার আদর্শে। বড় ছেলে চৌধুরী মোহা. আবু সাইয়ীদ স্বপন ’৭৫-উত্তর দুঃসময়ে আমার বড় অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান পীর যখন ছাত্রলীগের আহ্বায়ক ও পরবর্তীতে দুই দফা সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন তখন তিনি সক্রিয় সহযোগিতা করেছিলেন। তার আরেক ভাই চৌধুরী মোহা. আবু তারেক সাজু সেনাশাসনবিরোধী উত্তাল ছাত্র আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূমিকা রেখেছেন। তার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে। আরেক সন্তান জায়েদ চৌধুরী অপু বেসরকারি ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাসিন্দা হয়েছে। সুখের জীবনে যতবার নিউইয়র্ক যাই, অপু গভীর মমতায় জড়িয়ে রাখেন। সব ভাই ক্রিকেটার ছিলেন। সৎ জীবনযাপনে অভ্যস্ত সব ভাই মানুষকে ভালোবাসতেন। সবার সঙ্গে যোগাযোগ থাকলেও শৈশবের ক্লাসমেট দীপুর সঙ্গেই যোগাযোগ ছিল না। দীপু হজ করেছেন। আমেরিকার নিরাপদ জীবন নেননি, দেশপ্রেমে ফিরে এসেছিলেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন। দাড়ি রেখেছিলেন। ধর্মের নামের উগ্র জেহাদি জঙ্গিদের গ্রেনেড হামলায় আল্লাহর প্রিয় বান্দা দীপু নিহত হয়েছেন। বই নিয়ে আড্ডা, দিনভর আপনজনদের সঙ্গে কাটানোর সব আনন্দ রাত নামতেই নির্বাসিত হয়েছে। পাথরের মতো বুকের ওপর বেদনা চেপে বসেছে, এই বেদনা বন্ধু হারানোরই নয়; একজন সৎ, ইমানদার, দেশপ্রেমিক পুলিশ কর্মকর্তার জীবন ধর্মান্ধ ও উগ্রপন্থিদের গ্রেনেডে নিভে যাওয়ার বেদনা। বন্ধু দীপু, শান্তিতে ঘুমিয়ে থাক, গোটা দেশ জেগে থাক। অসত্য, অসুন্দর ও অমানবিক শক্তির বিরুদ্ধে।
বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারত শুধু আমাদের বন্ধুপ্রতিম পার্শ্ববর্তী দেশই নয়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যখন নিরস্ত্র, ঘুমন্ত বাঙালিদের হত্যার বীভৎস উৎসবে মেতে উঠেছিল, যখন আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রামকে স্তব্ধ করে দিতে নারী ও মদে বুদ হয়ে থাকা জল্লাদ ইয়াহিয়া খানের সেনাবাহিনী হত্যা, অগ্নিসংযোগ ও ধর্ষণে উন্মত্ত হয়েছিল; তখন আমাদের এক কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছিল শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর মহান ভারত। ভারতের জনগণ আশ্রয়ই দেয়নি, খাবার দিয়েছিল, অস্ত্র দিয়েছিল, ট্রেনিং দিয়েছিল এমনকি মিত্রবাহিনীর কুড়ি হাজার সৈন্য জীবন দিয়েছিল। ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ঐতিহাসিক। ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক রক্তে লেখা। এই সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার নয়, এই সম্পর্ক বন্ধুত্বের বঙ্গবন্ধু-ইন্ধিরা গান্ধী রচিত। এই সম্পর্ক আত্মমর্যাদার। আত্মার বাঁধনে জড়ানো। যারা বলেন, গোলামীর চুক্তি-মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি, তারাই হতাশ হয়েছেন মুজিবকন্যা শেখ হাসিনার আমলে সীমান্ত চুক্তি কার্যকর হওয়ার মধ্যদিয়ে ছিটমহলের মানুষকে বুকভরে শ্বাস নিতে দেখে। এই সস্তা কথাবার্তাও শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদির জামানায় চলবে না। গণতন্ত্রের সুবাতাস বইতে দিতে হবে। রক্তগঙ্গায় অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশে কি সরকার, কি বিরোধী দল সবাইকে হতে হবে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও উত্তরাধিকারিত্বের দাবিদার। এই দেশে মানবতা ও সত্যের জয় অনিবার্য। জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদের পরাজয় চূড়ান্ত পরিণতি। কে আওয়ামী লীগ, কে বিএনপি, কে অন্য দল সেটি বড় নয়; সবার ওপরে মানুষ সত্য, সবার ওপরে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবের উত্তরাধিকারিত্বের অহঙ্কার বহন করার শক্তিই বড়। এই শক্তি পরাজয় মানে না, কোনো অন্ধকার শক্তির কাছে, কোনো অশুভ শক্তির কাছে। সেনাবাহিনী যেভাবে জঙ্গিদের উত্খাত করে সাধারণ মানুষ ও শিশুদের উদ্ধার করেছে তা অভিনন্দনযোগ্য। এটাই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকারিত্বের গৌরব।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক।