দুই মন্ত্রীর ‘দ্বন্দ্ব’ ও ছাতক-সুনামগঞ্জ রেলপথ
জাহাঙ্গীর নোমান :: সিলেটের দুই মন্ত্রীর ‘দ্বন্দ্বে’ উন্নয়ন কাজ থমকে যাচ্ছে এরকম নিউজ হচ্ছে মিডিয়ায়। সিলেট-১ আসনকে সিলেটের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ আসন হিসেবে ধরা হয় এবং হেভিওয়েট প্রার্থীরা এখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এই আসনে এমপি হওয়া মানেই রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পাওয়া যেমন স্পিকার হয়েছিলেন হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী যার বাড়ি ছিল সুনামগঞ্জ জেলায়, তিনি এর আগে ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এই আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হয়ে অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী হয়েছেন মৌলভীবাজার জেলার সাইফুর রহমান, সিলেট জেলার আবুল মাল আবদুল মুহিত।
বর্তমানে একই আসনে এমপি হয়ে তাঁর ভাই একে আব্দুল মোমেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। মিথ রয়েছে সিলেট-১ আসনে যে দল থেকে এমপি নির্বাচিত হন সে দলই সরকার গঠন করে। এর ব্যতিক্রম এখনও হয়নি। যেহেতু সিলেট বিভাগীয় সদরের আসন এটি সেক্ষেত্রে সিলেট বিভাগের সব এলাকার মানুষের চাহিদা ও দাবি নিয়ে কথা বলা এই আসনের মাননীয় মন্ত্রী একে আব্দুল মোমেনের নৈতিক দায়িত্ব। তিনি সেই অধিকারে ছাতক-সুনামগঞ্জ রেলপথ নিয়ে ডিও লেটার দিয়ে সুনামগঞ্জের সব জনপ্রতিনিধিদের দাবির সাথে একাত্ম হয়েছেন মাননীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী। কারণ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিলেট বিভাগের উন্নয়ন চান।
তাছাড়া সুনামগঞ্জ জেলায় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নানাবাড়ি। জগন্নাথপুরের সৈয়দপুর গ্রামের মেয়ে সৈয়দা শাহারবানু চৌধুরী সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেনের মা। সেক্ষেত্রে সুনামগঞ্জ জেলা ও তার ভূ-প্রকৃতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা রয়েছে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর। কিন্তু পরিকল্পনামন্ত্রী ফেসবুকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে লিখেছেন, “আমি যতটুকু জানি, তাঁর বর্ণিল জীবনে তিনি কখনো সুনামগঞ্জে যাননি। সুনামগঞ্জে কখনো তাঁর পা পর্যন্ত পড়েনি। অথচ তিনি রেললাইন নির্মাণ নিয়ে একটি পক্ষের অবস্থান নিয়েছেন।” আচ্ছা কেউ কখনো তার নানাবাড়ি যায়নি সেটা কেন মন্ত্রী মহোদয়ের মনে হলো?
একজন মন্ত্রী যখন কেবিনেট সদস্য হিসেবে শপথ নেন তখন সংবিধানে বর্ণিত শপথ বাক্য অনুযায়ী বলতে হয়, “আমি ভীতি বা অনুগ্রহ, অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হইয়া সকলের প্রতি আইন অনুযায়ী যথাবিহিত আচরণ করিবো।” অথচ মাননীয় মন্ত্রী সুনামগঞ্জের এমপিদের প্রতি বিরাগের বশবর্তী হয়ে ২০১৫ সালের জরিপে চূড়ান্ত হওয়া ছাতক-দোয়ারা-সুনামগঞ্জ রেলপথ যার দূরত্ব ২৭ কিমি কিন্তু মাননীয় মন্ত্রী ঘুরপথে ৫০ কিমি দূরত্বে গোবিন্দগঞ্জ-শান্তিগঞ্জ রেলপথ নিতে নতুন করে জরিপ কাজ তাঁর নির্দেশনায় শুরু হয়েছে। মন্ত্রীর এই ক্ষুব্ধতার হেতু কী? কারণ সুনামগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় মন্ত্রীর বাড়ি শান্তিগঞ্জে হতে না দিয়ে সরকারের খাস জায়গা দেখার হাওর পাড়ে নিয়ে যাওয়া। অর্থাৎ সুনামগঞ্জের সংসদ সদস্যরা সরকারের বিপুল অর্থ বাঁচিয়ে দিয়েছেন যা ব্যয় হতো জমি অধিগ্রহণ বাবদ।
একইভাবে ২৭ কিমি রেলপথে স্বল্প ব্যয়ে সুনামগঞ্জ শহর কানেক্টেড হবে সেখানে বিপুল ব্যয়ে শান্তিগঞ্জ হয়ে রেলপথ নেওয়া সরকারের ব্যয় বাড়ানোর প্রচেষ্টা বৈ কিছু নয়। পরিকল্পনা মন্ত্রী হিসেবে টেকসই ও ব্যয় সাশ্রয়ী পরিকল্পনা যেখানে করার কথা সেখানে মন্ত্রী মহোদয় নিজের উপজেলাকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে ব্যয় বাড়িয়েই যাচ্ছেন। অথচ এমপি থেকে মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার পর মাননীয় মন্ত্রী সমগ্র দেশের প্রতিনিধিত্ব করেন সেখান নিজের উপজেলা ছাড়া পুরো জেলার সাথে বিমাতাসুলভ আচরণ বোধগম্য নয়। তাই মাননীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রী সিলেট বিভাগের উন্নয়নে সরকারের একজন উদ্বিগ্ন জনপ্রতিনিধি হিসেবে ডিও লেটার দিয়েছেন যাতে রেলপথটি নির্মাণ সহজ ও ব্যয় সাশ্রয়ী হয়। ছাতক শিল্পাঞ্চল ও অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্যে রেলপথ কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা যদি পরিকল্পনামন্ত্রী উপলব্ধি না করেন তাহলে তো মুশকিল। জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী হিসেবে সব উপজেলার সুষম উন্নয়ন নিশ্চিত করা তাঁর দায়িত্ব।
একজন সাইফুর রহমানকে সবাই মনে রেখেছে কারণ তিনি সিলেটের উন্নয়ন নিয়ে ছিলেন সদাসক্রিয় যদিও তাঁর দলীয় আদর্শ একেবারেই না-পসন্দ। সাবেক এই অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী তাঁর গ্রাম বাহারমর্দান নিয়ে পড়ে থাকেননি। তিনি সিলেটের উন্নয়ন নিয়ে ভেবেছেন এবং কাজও করেছেন যেকারণে সিলেটবাসী আজও তাঁকে স্মরণ করে। মাননীয় পরিকল্পনা মন্ত্রীর উচিত শান্তিগঞ্জের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে এসে সিলেট বিভাগের উন্নয়নে সব মন্ত্রী-এমপিদের নিয়ে সমন্বিত পরিকল্পনা করা। শান্তিগঞ্জের মতো উপজেলা লেভেলে নিজেকে নামিয়ে মন্ত্রী তাঁর মর্যাদাহানি করছেন। শান্তিগঞ্জের উন্নয়নের দায়িত্ব আপনার উপজেলা চেয়ারম্যানের উপর ন্যস্ত করুন না!
কথা একটাই সুনামগঞ্জের বৃহত্তর স্বার্থে ও সিলেট বিভাগের লাখো মানুষের কর্মসংস্থানের সুবিধার্থে ২৯০০ একর জায়গা নিয়ে নির্মিতব্য ছাতক অর্থনৈতিক অঞ্চলের যোগাযোগ, কাঁচামাল সরবরাহ ও রপ্তানি পণ্য পরিবহনের নিমিত্তে সিলেট-ছাতক-দোয়ারা-সুনামগঞ্জ রেলপথ নির্মাণ ও আধুনিকায়ন হোক। সুনামগঞ্জ-ঢাকা আন্তঃনগর ট্রেন সার্ভিস চালু হোক।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব।