মো. রেজাউল হক ডালিম :: আকবর হোসেন ভূইয়া। দেশ রক্ষা ও মানুষের জান-মালের নিরাপত্তা প্রদানের দৃঢ় প্রতিশ্রুতি দিয়ে ২০১৪ সালে এস.আই হিসেবে যোগ দেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পুলিশে। কিন্তু অটল থাকতে পারেননি নিজের প্রতিশ্রুতির উপর। ফেরাতে পারেননি অন্ধকার জগতের মোহময় হাতছানি। অর্থ-সম্পদের লোভে একসময় পা ফেলেন পাপের দুনিয়ায়। নিজেকে আইনের পোশাকে আবৃত রেখেও ধীরে ধীরে হয়ে উঠেন অপরাধ জগতের এক মুকুটহীন সম্রাট। সিলেট মহানগর পুলিশের কোতোয়ালি মডেল থানাধীন বন্দরবাজার ফাঁড়ির সাবেক (সদ্য বরখাস্তকৃত) ইনচার্জ এস.আই আকবর হোসনে ভূইয়া বর্তমানে লাপাত্তা। নগরীর আখালিয়া নেহারিপাড়ার এলাকার যুবক রায়হান আহমদ (৩৪)-কে পুলিশ ফাঁড়িতে মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্মমভাবে নির্যাতন করে মেরে ফেলার ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত তিনি। সোমবার বিকেলে তাকেসহ এ ফাঁড়ির ৪ পুলিশ সদস্যকে সাময়ীক বরখাস্ত করা হয়। নিয়ম অনুযায়ী বরখাস্তকৃত পুলিশ সদস্যরা পুলিশ লাইন্সে রুলকলে হাজির থাকার কথা। কিন্তু সোমবার রাত থেকে তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ওই দিন বিকাল ৫টা পর্যন্ত আকবর তদন্ত কমিটির সামনে হাজির ছিলেন। এসময় তাকে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ (এসএমপি) এলাকা না ছাড়ার জন্য নির্দেশও দেয়া হয়েছিলো।
এদিকে, রায়হানের মৃত্যুর পর আকবরের অপরাধ কর্মকাণ্ড নিয়ে মুখ খুলেন বন্দরবাজারসহ এ ফাঁড়ির আওতাধীন এলাকার অনেক বাসিন্দা। তার বিরুদ্ধে একের পর এক উঠে আসে গুরুতর নানা অভিযোগ।  এর মধ্যে রয়েছে- বন্দরবাজার এলাকার স্থায়ী ও ভ্রাম্যমাণ হকার, আবাসিক হোটেল, মাদকদ্রব্য কেনা-বেচার স্পট, নিশীকন্যাদের অসামাজিক কার্যকলাপের স্পট, ছিনতাইকারী গ্রুপ, জুয়া খেলার স্পটগুলো থেকে প্রতিদিন, সপ্তাহ ও মাসিক হিসাবে লাখ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করতেন এস.আই আকবর। এছাড়াও তার নির্দেশে নিরীহ পথচারীদের আটকে ভয়-ভীতি দেখিয়ে নিয়মিত চাঁদাবাজি করতেন বন্দরবাজর ফাঁড়ির পুলিশ সদস্যরা।  রায়হান হত্যাকাণ্ডের পর আকবরের অপরাধ কর্মকাণ্ড তুলে ধরতে অনুসন্ধান চালায় সিলেটভিউ। অনুসন্ধানকালে বন্দর ফাঁড়ি এলাকার ব্যবসায়ী, জনসাধারণ ও ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বললে বেরিয়ে আসে আকবর সম্পর্কে ভয়াবহ অনেক তথ্য।
জানা গেছে, নগরীর বাণিজ্যিক প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত বন্দরবাজার এলাকা ঘিরে ছিল এসআই আকবরের রামরাজত্ব। ওই এলাকার অপরাধীদের নিয়ে ছিলো তার বিশাল সিন্ডিকেট এবং অপরাধরাজ্য। নগরীর বন্দরবাজার ফাঁড়ির আওতাভুক্ত তালতলা থেকে জিন্দাবাজার পর্যন্ত প্রায় ১ হাজার ভাসমান হকার রাস্তা ও ফুটপাতে বসেন। এর মধ্যে প্রত্যেক স্থায়ী হকারের কাছ থেকে প্রতিদিন ৫০ টাকা এবং ভ্রাম্যমাণ হকারদের কাছ থেকে ২০ টাকা করে চাঁদা ওঠাতেন এসআই আকবর। এ হিসেবে বন্দর ফাঁড়ির নামে প্রতি মাসে প্রায় ১০ লক্ষ টাকা উত্তোলন করা হতো হকারদের কাছ থেকে। তার পক্ষে কনস্টেবল জিয়া এই চাঁদার টাকা তুলতেন। সম্প্রতি জিয়া শিবেরবাজার পুলিশফাঁড়িতে বদলি হয়েছেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, অসামাজিক কাজের সুযোগ করে দিয়ে কয়েকটি হোটেল থেকে মাসোয়ারা আদায় করতেন আকবর। তার ফাঁড়ি এলাকার সুরমা মার্কেটে ২টি, জিন্দাবাজারে ২টি ও কালীঘাটে ২টি- এই ৬টি আবাসিক হোটেল থেকে মাসিক ২০ হাজার টাকা করে মোট ৬০ হাজার নিতেন এই পুলিশ কর্মকর্তা। এর বিপরীতে এই ৬ হোটেলে অবাঞ্চিত নারীদের দিয়ে প্রতিরাতে চলতো অসামাজিক কার্যকলাপ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন জানান, বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির আওতাধীন এলাকায় রয়েছে শিলং তীর ও তিনপাতি খেলার ২টি স্পট। এসব স্পট থেকে প্রতি সপ্তাহে ৫ হাজার টাকা করে ২০ হাজার- এ হিসেবে মাসে মোট ৪ লাখ টাকা আদায় করতেন আকবর। বন্দর এলাকাভিত্তিক মাদকদ্রব্য বিক্রির একটি বিশাল সিন্ডিকেট পোষতেন এস.আই আকবর। কাষ্টঘর ও কিন ব্রিজের নিচে মদ, ইয়াবা, ফেনসিডিল ও গাঁজাসহ নানা ধরণের মাদকদ্রব্য বিক্রি করতো এই সিন্ডিকেটের সদস্যরা। তাদের কাছ থেকে প্রতি মাসে কয়েক লক্ষ টাকা চাঁদা নিতো আকবর বাহিনী। লালদিঘীরপাড়ের সাধারণ ব্যবসায়ীরাও রেহাই পাননি আকবরের কবল থেকে। বৈধ ব্যবসা করেও নিয়মিত চাঁদা দিতে হতো তাকে। না দিলে ব্যবসায়ীদের নানাভাবে হেনস্থা করতেন আকবর। ব্যবসায়ীরা জানান, প্রতি মাসে লালদিঘীরপাড়স্থ হকার্স মার্কেটের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে জোরপূর্বক ৩০ হাজার চাঁদা তুলতো আকবরের মদদপুষ্ট পুলিশ সদস্যরা।
প্রতিরাতে বন্দরবাজার এলাকায় ঘুরে বেড়ায় ছিনতাইকারী কয়েকটি গ্রুপ। তারা সুযোগ বুঝেই হামলে পড়ে পথচারীদের উপর, ছিনতাই করে সর্বস্ব লুটে নিতো সাধারণ মানুষের। এই ছিনতাইকারীদের কয়েকটি গ্রুপকে শেল্টার দিতেন আকবর। বিনিময়ে তাদের কাছ থেকে প্রতি মাসে পেতেন বড় অংকের টাকা। বন্দরবাজার, কিন ব্রিজের মুখ, সুরমা মার্কেটের ও করিমুল্লাহ মার্কেটের সামন এবং ধোপাদিঘীর পূর্বপাড়ের সিএনজি অটোরিকশা স্ট্যান্ড থেকে মাসোয়ারা আদায় করতেন এস.আই আকবর।বন্দরবাজার এলাকা ও আদালতপাড়ায় রাত-দিন ২৪ ঘণ্টাই চলে পতিতাবৃত্তি ও অসামাজিক কার্যকলাপ। তাদের বিরুদ্ধ কোনো পদক্ষেপ নিতেন না এস.আই আকবর। কারণ- ফাঁড়িতে মাসিক বড় অংকের টাকা পাঠিয়ে দিতো অবাঞ্চিত নারীদের গডফাদাররা। সুরমা মার্কেটের কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, ভোরে এবং রাতে ঢাকা অথবা সিলেটের বহিরাঞ্চল থেকে আগত নারী-পুরুষদের রাস্তা থেকে ধরে ফাঁড়িতে নিয়ে মাদক ও অবাঞ্চিত নারীদের দিয়ে আটক দেখানোর ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায় ছিলো এসআই আকবরের নিত্যদিনের কাজ।

অবৈধ উপায়ে মাসে লাখ লাখ টাকা উপার্জন করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আশুগঞ্জ উপজেলার বেড়তলা বগইর গ্রামের আকবর হোসেন ভূঁইয়া খুব অল্পদিনেই ‘আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন’। গ্রামের বাড়িতে গড়ে তুলেছেন রীতিমতো রাজপ্রাসাদ।  জানা গেছে, তার এলাকায় যে-ই জমি বিক্রি করতেন সেই জমি কিনে নিতেন এস.আই আকবর। যেন গুপ্তধনের সন্ধান পেয়েছিলেন এই পুলিশ কর্মকর্তা।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn