দেশে ফিরতে না পেরে উদ্বিগ্ন লেবানন প্রবাসী বাংলাদেশিরা
জসিম উদ্দীন সরকার-গত এক বছর ধরে চলা রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক মন্দা, ডলার সংকট, রাজধানী বৈরুত পোর্টে ইতিহাসের ভয়াবহ বিষ্ফোরণসহ নানা কারণে ধ্স নেমেছে লেবাননের ব্যবসা-বাণিজ্যে। পাশাপাশি মরণ ঘাতক করোনাভাইরাসের আক্রান্তের সংখ্যাও আগের চেয়ে দিন দিন বেড়ে চলেছে। একদিকে করোনাভাইরাসের সঙ্গে যুদ্ধ, অন্যদিকে সরকার গঠন নিয়ে টালমাটাল অবস্থা, সব মিলিয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে হাঁটছে লেবানন। আর এই অনিশ্চয়তার বিশাল প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশি প্রবাসীদের উপর। কর্ম হারিয়েছেন ৫০ হাজারেরও বেশি প্রবাসী বাংলাদেশি। তাই বাধ্য হয়ে দেশে ফিরছেন হাজারো প্রবাসী। দূতাবাস ও অন্যন্যা সূত্র মতে, লেবাননে দেড় লাখেরর বেশি বাংলাদেশি পুরুষ ও মহিলা কর্মী রয়েছে। এক সময় লেবাননে যে বিমানবন্দরে প্রতিদিন বাংলাদেশি কর্মীদের আসতে দেখা যেত, এখন সেই বিমানবন্দরে প্রতিদিন তাদের ফিরে যেতে দেখা যায়।
কেউ স্বইচ্ছায় দেশে ফিরছেন, আবার অনেক কোম্পানি বেতন দিতে না পেরে বিদেশি শ্রমিকদের নিজ নিজ দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে এ পর্যন্ত ৫ হাজারের অধিক বৈধ কাগজপত্র থাকা বাংলাদেশি প্রবাসী দেশে ফিরেছেন। তবে বৈধ কাগজপত্র থাকা প্রবাসীরা সহজে দেশে ফিরতে পারলেও কঠিন অবস্থা অবৈধ ও কাগজপত্রবিহীন প্রবাসীদের। দেশে ফিরতে না পেরে উদ্বিগ্ন সবাই, দেশ থেকে ভিটেমাটি বিক্রি করে হলেও দেশে ফিরতে চান অনেকে। জানা গেছে, ২০১৯ সালের শেষে দিকে ও ২০২০ সালের শুরুতে দেশে ফিরতে দূতাবাসে নাম নিবন্ধন করেন ৭ হাজারের অধিক প্রবাসী। চলতি বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত দূতাবাস নিবন্ধকৃত ১ হাজারের বেশি প্রবাসীদের দেশে পাঠানো গেলেও করোনাভাইরাসের প্রাদূর্ভাবে বিমান চলাচল বন্ধ হয়ে গেলে বন্ধ হয়ে যায় প্রবাসীদের দেশে ফেরার কর্মসূচি। এর মধ্যে জটিল থেকে জটিলতর অবস্থায় ধাবিত হয় লেবাননের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। এর মধ্যে কাজ না থাকায় দেশে ফিরতে না পেরে অতিষ্ট হয়ে উঠেন বাংলাদেশি কর্মীরা। বিমান চলাচল কিছুটা স্বাভাবিক হলে দেশে ফিরতে শুরু করেন তারা।
লেবাননের ডলার সংকট, চাকরি না থাকা দেশে ফেরার মূল কারণ বলে জানিয়েছেন দেশে ফিরতে ইচ্ছুক প্রবাসীরা। তারা জানান, ডলারের এতই সংকট যে, ৩২ হাজার টাকার বেতন এখন ৮ টাকা হয়ে গেছে। লেবানিজরা নিজেরা সংকটে ভুগছে। সেখানে প্রবাসীদের কে দেখবে, তাই দেশে ফেরাই উত্তম মনে করেন অনেকে। গত ৩রা অক্টোবর লেবাননের আনসার স্টেডিয়ামে ৪৯৭ প্রবাসীর হাতে বিমানের টিকেট তুলে দেন লেবাননের বাংলাদেশ দূতাবাস। বিমান টিকেট হাতে পেয়ে তারা দূতাবাসের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তারা জানান, লেবাননে চাকরি নাই, অনেকে কর্মহীন ১ বছরেরও বেশি সময় ধরে। প্রবাসীরা আরো জানান, এখন কোথাও ৬-৮ লাখ (লেবানিজ পাউন্ড) লিরার উপরে চাকরি পাওয়া যায় না। আগে দেড় লাখ লিরায় ১০০ ডলার হতো, এখন ১০০ আমেরিকান ডলার কিনতে ৮ লাখ লিরার উপরে খরচ হয়। লেবাননের কোন মালিক এখন ডলারে বেতন দেয় না। তাহলে ১০০ ডলারের কম মাসিক বেতনে লেবাননে বসবাস করে কি করব। বাসা ভাড়া দিতেই হিমশিম খাচ্ছি। নিজে খাবো কি, আর দেশে পরিবারের জন্য পাঠাবো কি?
তারা আরো বলেন, লেবানন এমন অবস্থা থেকে কবে বের হয়ে আসবে তা কেউ বলতে পারছে না। এভাবে চলতে থাকলে দেশে পরিবারের নিকট টাকা পাঠানো দূরের কথা, দেশ থেকে টাকা এনে চলতে হবে। এক প্রবাসী বলেন, তিনি গত ৬ মাস ধরে দেশ থেকে টাকা এনে চলছেন। বিমান টিকেটের টাকাও তিনি দেশ থেকে এনেছেন। তাই এমন পরিস্থিতিতে কেউ আর লেবাননে থাকতে চান না। লেবাননের বিভিন্ন স্থানে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কর্ম না থাকায় অনেক প্রবাসী বাধ্য হয়ে দেশ থেকে টাকা এনে চলছেন। দূতাবাসের প্রথম সচিব (শ্রম) ও দূতালয় প্রধান আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, মোট ৭৬৩৪ জন প্রবাসী দেশে ফিরতে নাম নিবন্ধন করেছেন। তাদের মধ্যে ৪৩টি ফ্লাইটে ৭২২৮জন প্রবাসীকে এ পর্যন্ত দেশে পাঠানো হয়েছে। বাকিদের মামলাসহ কিছু সমস্যা রয়েছে। পর্যায়ক্রমে সমস্যা সমাধানের পর তাদেরকেও দেশে পাঠানো হবে। বিমান টিকেট পাওয়া প্রবাসীদের নিয়ে ৫ই অক্টোবর রোববার বিকালে বাংলাদেশ বিমানের একটি বিশেষ ফ্লাইটে বৈরুত ছাড়ে। ৬ই অক্টোবর মধ্যরাতে বিমানটি হযরত শাহ জালাল অন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। এদিকে নিবন্ধনকৃত প্রবাসীদের দেশে পাঠানো হলেও এখনো দেশে ফিরতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে হাজার হাজার প্রবাসী বাংলাদেশি। লেবাননের এ সকল প্রবাসীরা সংশ্লিষ্ট দপ্তরের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।