দ্বন্দ্ব-সংঘাতে অস্বস্তিতে আওয়ামী লীগ
মেহেদী হাসান-
দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছে আওয়ামী লীগ। শতাধিক আসনে আওয়ামী লীগের শত্রু এখন আওয়ামী লীগ। গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে এ কোন্দল দূর করার চেষ্টা চলছে; কিন্তু সুফল মিলছে না। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে, এ অবস্থায় দলের ভেতরের দ্বন্দ্ব-সংঘাতে অস্বস্তিতে রয়েছে ক্ষমতাসীন দলটি। গত বছরের অক্টোবরে দলের ২১তম জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। দল পুনর্গঠন শেষে বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদকদের কোন্দল দূর করতে বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া হয়। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও বিভিন্ন এলাকার নেতাদের ডেকে কথা বলছেন; কিন্তু দ্বন্দ্ব-কোন্দল যে মিলিয়ে যায়নি, নেতাদের বক্তব্যের ভেতরের উদ্বেগ-উত্কণ্ঠায় তা স্পষ্ট হচ্ছে। সংবিধান অনুযায়ী আগামী বছরের শেষ দিকে অথবা ২০১৯ সালের শুরুতে হবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। তিনশ আসনে সাড়ে তিন হাজার প্রার্থী আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী। সবাই সমানভাবে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। আর এক্ষেত্রে নেতাকর্মীরা আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বিভিন্ন সময় বিবাদে জড়িয়ে পড়ছেন। অনেক ক্ষেত্রে তা রূপ নিচ্ছে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে। প্রত্যেক পক্ষই তাদের পাল্লা ভারী করার চেষ্টা করছেন। আবার অনেক স্থানে দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশীরা বর্তমান সংসদ সদস্যের রোষানলের শিকার হচ্ছেন। আবার কিছু আসনে বর্তমান এমপিকে ঘায়েল করতে ‘রাজনৈতিক গেম’ চালানো হচ্ছে।
অভ্যন্তরীণ কোন্দলের দুইটি বড় বহিঃপ্রকাশ দেখা যায় অতি সম্প্রতি। এর একটি ঘটে রাজধানীর আজিমপুরে, অন্যটি ফেনীতে। ঘটনা দুইটি দলের ইমেজ ক্ষুণ্ন করেছে, হাই কমান্ডকে বিব্রত করেছে।গত ১৬ নভেম্বর রাজধানীর আজিমপুরে আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের বিভেদে দলীয় কর্মসূচি বানচাল করতে এক পক্ষ অনুষ্ঠানস্থলের সামনে কয়েক ট্রাক ময়লা ফেলে রাখে। এ নিয়ে সংঘর্ষে জড়ায় দুই পক্ষ। অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম নেতা-কর্মীদের সতর্ক করে দিয়ে বলেন, দলের মধ্যে এ রকম বিভেদ চলতে থাকলে আগামীতে আর সরকারে ফেরা হবে না আওয়ামী লীগের। ওই অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা. দীপু মনির প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকার কথা ছিল; কিন্তু দুই পক্ষের সংঘর্ষের মধ্যে তার গাড়িতে ঢিল পড়ে। পরে দীপু মনি চলে যান। গত ২৮ অক্টোবর ফেনীতে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলার জন্য ক্ষমতাসীন দল দায়ী করেছিল বিএনপিকেই। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের অভিযোগ করেছেন, ‘বড় নিউজ’ তৈরির জন্যই এই কাজ করেছে বিএনপি। অথচ দলের এ অবস্থানের মধ্যে ফেনী আওয়ামী লীগের এক নেতা আজহারুল হক ঘটনার প্রায় এক মাস পর গত মঙ্গলবার রাজধানীতে সংবাদ সম্মেলন করে দাবি করেছেন- এই ঘটনাটি ফেনীতে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারী ঘটিয়েছেন। তবে এর সপক্ষে তিনি কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেননি।
জানা গেছে, ফেনী আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যেও দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিনের। নিজাম হাজারী ও আজহারুল হক দুইটি আলাদা বলয়ে অবস্থান করেন। এই বিভেদে আজহারুল হক বিএনপির হাতে একটি অস্ত্র তুলে দিয়েছেন এবং এ কারণে তার ওপর বিরক্ত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা। গতকাল বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, সংবাদ সম্মেলন করে ফেনী জেলার আওয়ামী লীগ নেতারা হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিয়েছেন। অনুসন্ধানে জানা গেছে, শতাধিক এমপি ও তাদের গুণধর পুত্র এবং স্বজনদের ‘বিশেষ লীগে’ সর্বনাশ হচ্ছে তৃণমূল আওয়ামী লীগ। কোনো কোনো এমপি নিজেদের গ্রুপ ভারী করার জন্য কাছে টানছেন বিএনপি-জামায়াতকে, দূরে ঠেলে দিচ্ছেন দুঃসময়ের ত্যাগী কর্মীদের। এমপিদের বিরুদ্ধে কথা বলে হামলা মামলার শিকার হয়ে এলাকা ছাড়া হয়েছেন অনেক নেতাকর্মী। এলাকায় অনেকটা গডফাদারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালানো, নির্বাচনী এলাকার জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক না রাখা ও এলাকায় খুবই কম যাওয়া, নিজস্ব বলয় সৃষ্টির মাধ্যমে গ্রুপিং করে তৃণমূলে নেতাকর্মীদের বিভক্ত করে রাখা, স্বজনপ্রীতি ও অযোগ্যদের দলে গুরুত্বপূর্ণ পদ দেওয়া, বিএনপি-জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের দলে ভিড়ানো, চাকরি দেওয়ার কথা বলে নেতাকর্মীদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা নিয়ে চাকরি না দেওয়া, টাকাও ফেরত না দেওয়া, বিরুদ্ধে বললেই হামলা-মামলা দিয়ে হয়রানি বা পঙ্গুত্ববরণ অথবা জীবন নিয়ে নেওয়া, ত্যাগী নেতাকর্মীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার এবং বিদ্যুতের লাইন দেওয়ার নাম করে জনসাধারণের কাছ থেকে বাড়তি টাকা নেওয়া— এমন অভিযোগ শতাধিক আসনের এমপিদের বিরুদ্ধে। আর এমপিদের এমন আচরণে অনেক ক্ষেত্রে দ্বন্দ্ব ও সংঘাত বাড়াচ্ছে। সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গত ১১ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজারে দলের এক প্রতিনিধি সভায় বলেন, আওয়ামী লীগের শত্রু যেন আওয়ামী লীগ না হয়। নিজ ঘরে শত্রু থাকলে শত্রুতা করার জন্য বাইরের শত্রুর দরকার হয় না। আজিমপুরের ঘটনায় ওবায়দুল কাদের বলেন, এ বছর আমরা অনৈক্য অ্যাফোর্ড করতে পারব না। আওয়ামী লীগের জন্য সমর্থনের কোনো কমতি নেই; কিন্তু দলের ভেতর কিছু সমস্যা আছে। সেগুলোকে সমাধান করার জন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি। দলের বিভেদ মেটানোর পরামর্শ দিয়ে এমন সতর্ক বার্তা দেন তিনি।
জানা গেছে, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই দলের ভেতর নেতৃত্বে আসতে দ্বন্দ্ব প্রকাশিত হয়। নানা স্থানীয় নির্বাচনে এটা স্পষ্ট হয়। ২০১৪ সালে বিএনপি-জামায়াত জোটের বর্জনের মধ্যে কঠিন পরিস্থিতিতে জাতীয় নির্বাচনেও ২০টির বেশি আসনে দলের প্রার্থীর বিরুদ্ধে লড়েছেন নেতারা। তাদের বেশ কয়েকজন বিজয়ীও হন। জাতীয় নির্বাচনের পর উপজেলা, ইউনিয়ন পরিষদ আর পৌরসভা নির্বাচনে বহু আসনে দলের প্রার্থীদের হারিয়ে দিয়েছেন বিদ্রোহী প্রার্থীরা। বারবার হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও এই প্রবণতা থামেনি। চলতি বছর কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এই বিভেদ স্পষ্ট হয়। আর দলের কোন্দলে নৌকার প্রার্থী আঞ্জুম সুলতানা সীমার পরাজয়ের বিষয়ে দলের শীর্ষ পর্যায়ে প্রতিবেদন গেছে; কিন্তু বিভেদ আরো উস্কে যেতে পারে আশঙ্কায় ব্যবস্থা নেয়নি কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ। আসন্ন রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পেতে আগ্রহী ছিলেন ১০ নেতা। এদের মধ্যে বর্তমান মেয়র শরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টুকে মনোনয়ন দিয়েছে আওয়ামী লীগ; কিন্তু অন্য নয় নেতার বেশ কয়েকজন এই সিদ্ধান্ত মানতে পারছেন না। নানাভাবে তারা তাদের মনোভাব প্রকাশও করেছেন। এদিকে ৩০ মে পাবনার বেড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে আলিম খাঁ নামের এক কর্মী নিহত হন। দলের গঠনতন্ত্রে না থাকলেও রংপুরে একটি ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের ৩৪ কমিটি রয়েছে। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ জানান, ‘আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে বিভিন্ন এলাকায় ছোটখাটো যেসব দ্বন্দ্ব রয়েছে তা আমরা উদ্যোগ নিয়েই দ্রুত সমাধান করব।’ আওয়ামী লীগের একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য জানান, শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তার একটি বড় অংশ পাবে এমপি প্রার্থীরা। তবে শতাধিক বর্তমান এমপির অজনপ্রিয়তায় সে পার্সেন্টেজ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা চিন্তার বিষয়। কর্মীদের মাঠে নামানোর জন্য যোগ্য জনপ্রিয় নেতাদের মনোনয়ন দেওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।