দ্বিতীয়বার সংসার না করায় টুম্পা হত্যা
রুদ্র মিজান |
ভালোবেসে সুখী হতে চেয়েছিলেন রোকসানা আক্তার টুম্পা (২৬)। মা-বাবার অজান্তেই প্রেম করে ঘর বেঁধেছিলেন। কয়েক মাস যেতে না যেতেই শুরু হয় ঝড়। সেই ঝড়েও স্বামী-সংসার আঁকড়ে ধরেছিলেন এই তরুণী। কিন্তু সুখী হওয়া হয়ে উঠেনি। ঝামেলাহীন একলা পথ বেছে নেন তিনি।সেই পথে হাঁটতে গিয়েও বারবার বাধার মুখোমুখি হন। বাধা হয়ে দাঁড়ায় তার প্রাক্তন স্বামী। শেষ পর্যন্ত ভালোবাসার এই মানুষটি কিলার হিসেবে সামনে আসে তার। আপ্রাণ চেষ্টা করেও তার হাত থেকে বাঁচতে পারেননি টুম্পা। প্রকাশ্যে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করা হয়েছে তাকে। হত্যাকাণ্ডের পুরো দৃশ্য ধরা পড়েছে সিসি ক্যামেরার ফুটেজে।
প্রত্যক্ষদর্শী ও ফুটেজ অনুসারে পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে, টুম্পার হত্যাকারী তার প্রাক্তন স্বামী সবুজ শেখ (২৯)। ঘটনার পর থেকে তাকে গ্রেপ্তার করতে তৎপরতা চালাচ্ছে পুলিশ। গত ১৫ই অক্টোবর সকাল সাড়ে ১০টার দিকে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের রাজিয়া সুলতানা রোডের নব্য নামক বুটিকসের দোকানে ঘটে ঘটনাটি। দোকানের ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, সকাল ১০টার পরে দোকানে ঝাড়ু দিচ্ছিলেন টুম্পা ও আরেক তরুণী। তারা দু’জনেই ওই দোকানের সেলসগার্ল। ১০টা ১১ মিনিটে ওই দোকানে ঢোকে বিধ্বস্ত চেহারার এক যুবক। ওই যুবকই টুম্পার প্রাক্তন স্বামী সবুজ। দোকানে ঢুকেই টুম্পার সঙ্গে কথা বলে সে। কথা বলার একপর্যায়ে দু’জনকে উত্তেজিত দেখা যায়। একপর্যায়ে টুম্পার মোবাইল ফোনটি কেড়ে নিতে চেষ্টা করে সবুজ। টুম্পা বাধা দেন। শুরু হয় দু’জনের মধ্যে ধস্তাধস্তি। মুহূর্তের মধ্যেই প্যান্টের পকেট থেকে একটি ছুরি বের করে টুম্পাকে আঘাত করে সবুজ। পরপর তিনটি আঘাত। দু’টি বাম ঘাড়ে, একটি আঘাত ঠেকাতে গিয়ে হাত রক্তাক্ত হয়। একপর্যায়ে রক্তাক্ত টুম্পা দোকানের মেঝেতে নিস্তেজ পড়ে থাকেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ঘটনার সময় দোকানে থাকা অপর সেলসগার্ল বাইরে গিয়ে চিৎকার করে আশপাশের লোকজনের সহযোগিতা চেয়েছেন। লোকজন এগিয়ে যাওয়ার আগেই সবুজ পালিয়ে যায়। টুম্পার পিতা ভোলা জেলা সদরের কাঁঠালী গ্রামের আবুল বাশার জানান, বিয়ের আগে মা-বাবার সঙ্গে সাভারে থাকতেন টুম্পা। ওই এলাকাতে ছিল সুবজের ভগ্নিপতি চান মিয়ার বাসা। চান মিয়া মাঝে-মধ্যে আসা-যাওয়া করতেন টুম্পাদের বাসায়। সেই সুবাদে সবুজের সঙ্গে টুম্পার পরিচয়। তারপর প্রেম। স্বজনরা মনে করেন, প্রেমে মগ্ন হওয়ার কারণেই ২০১১ সালে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেননি টুম্পা। ওই বছরই পরিবারের সবার অজান্তে সবুজকে বিয়ে করেন। সবুজ একটি কাপড়ের দোকানে চাকরি করেন। বিয়ের পর ঢাকায় বাসা নিয়ে থাকেন তারা।
বেশ কিছুদিন পর মেয়ের সন্ধান পান টুম্পার পিতা আবুল বাশার। তিনি জানান, ওই সময়েই জানতে পারেন তার মেয়ে যাকে বিয়ে করেছে তার আগের এক স্ত্রী রয়েছে। ফোনে টুম্পাকে তা জানালেও তিনি তা বিশ্বাস করেননি। পরে খোঁজ নিয়ে টুম্পা নিশ্চিত হন, মিরপুরে প্রথম স্ত্রী ও দুই সন্তান রয়েছে সবুজ শেখের। এ নিয়ে সবুজ ও টুম্পার মধ্যে শুরু হয় দ্বন্দ্ব। প্রায়ই বাকবিতণ্ডার একপর্যায়ে মারধর করা হতো টুম্পাকে। সিদ্ধান্ত নেন সতীনের সংসার করবেন না টুম্পা। তিনি বাবার বাড়ি চলে যান। কিন্তু সবুজ তাকে নিয়ে সংসার করতে চায়। বারবার নিজের ভালোবাসা প্রকাশ করে সে। স্বজনরা বোঝান যা হওয়ার তা হয়েছে সংসার করো। একপর্যায়ে টুম্পা ফিরে আসেন। কিন্তু এবার টুম্পার প্রতি সন্দেহ বাড়ে সবুজের। কারও সঙ্গে কথা বললেই সন্দেহ হতো। সবুজের ধারণা, তার সুন্দরী স্ত্রী অন্য কারও সঙ্গে সম্পর্কে জড়াচ্ছে। এ নিয়ে নতুন করে শুরু হয় কলহ। অনেকটা বাধ্য হয়ে প্রায় ৮ মাস আগে সবুজকে ডিভোর্স দেন টুম্পা। নিজের উপর নির্ভরশীল হতে চেয়েছিলেন টুম্পা। এরই অংশ হিসেবে সেলসগার্লের চাকরি নেন মোহাম্মদপুরের নব্য বুটিকসে।
টুম্পার স্বজনরা জানান, ডিভোর্স মেনে নিতে পারেনি সবুজ। ডিভোর্সের পর গ্রামের বাড়ি ভোলাতে গিয়েও টুম্পাকে বিরক্ত করেছে। হত্যাকাণ্ডের আগের দিন সাভারের বাসায় গিয়ে নতুন করে সংসার করার প্রস্তাব দিয়ে সবুজ বলেছে, ‘তোমার যা লাগে সব দেবো। তুমি ফিরে এসো। আমরা নতুন করে সংসার করব।’ সেদিন টুম্পা ছাড়া বাসায় কেউ ছিলেন না। টুম্পার স্বজনরা জানান, টুম্পা অসম্মতি জানালে তাকে সেখানে মারধর করে সবুজ। সবুজ মনে করতো তাকে ডিভোর্স দিয়ে নতুন কোনো সম্পর্কে জড়িয়েছে টুম্পা। ঘটনার দিন মোহাম্মদপুরের ওই দোকানে ঢুকেই তার মোবাইলফোনটি কেড়ে নিতে চায় সবুজ। টুম্পা বাধা দেন। তারপরই তাকে ছুরিকাঘাত করা হয়। রক্তাক্ত অবস্থায় টুম্পাকে শেরে-বাংলানগরস্থ সোহ্রাওয়ার্দী হাসপাতাল নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। খবর পেয়ে লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
এ ঘটনায় টুম্পার পিতা বাদী হয়ে সবুজ ও তার পরিবারের সদস্যদের আসামি করে মামলা করেছেন। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মোহাম্মদপুর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) হাফিজুর রহমান মানবজমিনকে বলেন, দ্বিতীয়বার সংসার করতে ব্যর্থ হয়ে পরিকল্পিতভাবে টুম্পাকে হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তার করতে আমরা তৎপরতা চালাচ্ছি। শিগগিরই জড়িতদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হবে বলে জানান তিনি। এ ঘটনায় জড়িত টুম্পার প্রাক্তন স্বামী সবুজ শেখ পিরোজপুর জেলার নাজিরপুরের বড়ই বুনিয়া গ্রামের মনসুর আলী শেখের পুত্র।