নিরাপদ থাক মানুষ ও দেশ
পীর হাবীব-(ফেসবুক থেকে)-
চৈত্র সংক্রান্তি বা ঋতুরাজ বসন্তের শেষ সূর্যাস্ত ঘটে গেছে। বিদায় হয়েছে ঘটনাবহুল বাংলা ১৪২৪ সাল। রাত পোহালেই পহেলা বৈশাখ ১৪২৫ সাল। শুভ নববর্ষ। বাঙালি জাতির উৎসবের মহানন্দের দিন। প্রাচীন বাংলার রাজা শশাঙ্কের আমল থেকে বাংলা সন গণনার কাজ শরু হলেও তা পূর্ণতা পায় সম্রাট আকবরের শাসনামলে। তার আমলেই ইংরেজি ১৫৫৬ সালের ১১ এপ্রিল বাংলা বর্ষ পঞ্জি তৈরি হয়। মোঘল আমলেই বাংলা বর্ষ পঞ্জিকে সরকারি মর্যাদা দেয়া হয়। ১৯১৭ সালে নববর্ষ উদযাপনের সূচনা ঘটলেও তার নবজাগরণ ঘটে ১৯৬৭ সালে রমনার বটমূলে ছায়ানটের অনুষ্ঠান দিয়ে। আজ বাংলা নববর্ষ এই জাতির জীবনের সবচেয়ে বড় আনন্দ-উৎসবে পরিণত। পহেলা বৈশাখ বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনায় আাবেগ-ভালবাসা উৎসারিত আনন্দের বর্ষ বরণের দিন। ভোরের ¯স্নিগ্ধ, পবিত্র হাওয়া গায়ে মেখে সবার ঘুম ভাঙে এই দিন। সাতসকালে রমনার বটমূলে ছায়ানটের গানের সুরের মূর্ছনায় এই উৎসব নগর থেকে লোকালয়ে ছড়িয়ে পড়বে, আনন্দে আত্মহারা জাতিকে এক মোহনায় মিলিত করে। চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা থেকে পথে পথে নানা স্থানে নগর থেকে শহর হয়ে গ্রামে ছড়িয়ে পড়া এই উৎসব নাগরদোলা, বাউলের গান আর বাঁশির সুরে সুরে ভেসে যাবে। শিশু-কিশোর-তরুণ ও পুরুষরা পায়জামা-পাঞ্জাবিতে আর শিশু কন্যা, কিশোরী তরুণী ও রমণীরা লাল-সাদা শাড়িতে রেশমী চুড়ি, কপালে টিপ, খোঁপায় ফুল নিয়ে বাঙালি সাজে সজ্জিত হয়ে নেমে আসবে এই আনন্দ-উৎসবে।
ঘরে-বাইরে সবখানে পান্তা ভাতই নয়, বাহারি ভোজন বিলাসীদের জন্য বাঙালি খাবারের মহাআয়োজন থাকবে। কালবৈশাখী ঝড় আসুক বা না আসুক কায়মনোবাক্যে সবার প্রার্থনা বাঙালি জাতির সম্প্রীতির এই বন্ধন উৎসবে আরো সুদৃঢ় হোক। আনন্দময় হোক। সকল হতাশা-বেদনা বিষাদ কেটে যাক। একদিন ছায়ানটের বর্ষ বরণের রমনার বটমূলে অন্ধকার কালো শক্তি যে বোমা নিক্ষেপ করে রক্তপাত ঘটিয়েছিল, তারাও আলোর পথে ফিরে আসুক। জাতিগত সম্প্রীতির এই মহোৎসব ধর্ম-বর্ণ, গরীব-ধনী নির্বিশেষে সকল নাগরিকের, সকল মানুষের মহানন্দেও উৎসব। নববর্ষ বরণের এই মহোৎসবের আনন্দ বন্যায় ভেসে যাক, আমাদের সকল মানসিক দারিদ্রতা, কুসংস্কার, সাপের বিষের মতো মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, বিদ্বেষ, ঈর্ষা, সাম্প্রদায়িকতা ও যৌন বিকারগ্রস্ত ধর্ষককামী বিষাক্ত হিংস্র নখ । কারো ভালো লাগুক বা না লাগুক, ধর্মের নামে হোক, রাজনীতির নামে হোক জাতীয় ঐক্যের চেতনাগত বিচ্ছুরিত-আলোকিত বর্ষবরণের আনন্দ উৎসবের বর্ণাঢ্য চরিত্র নিয়ে কোনো ফতোয়া দিতে আসবেন না। এটি কোনো ধর্মান্ধ দেশ নয়।
সকল ধর্ম-বর্ণ, শ্রেণি-পেশার জনগণের বুকের রক্ত আর মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত জাতির স্বাধীন রাষ্ট্র। এই রাষ্ট্র জন্মগতভাবেই সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমের দেশ হলেও আদর্শ ও চেতনাগত জায়গা থেকে অসম্প্রাদায়িক ও গণতান্ত্রিক শোষণমুক্ত মানবিক সমাজের অঙ্গীকার নিয়ে লাখো লাখো শহীদের রক্তের কাছে ঋণে বাঁধা। মহল বিশেষের কুসংস্কার ও ধর্মান্ধ রাজনৈতিক চেতনার কাছে রাষ্ট্র তার জাতিগত অসম্প্রদায়িক চেতনাকে পরাস্ত হতে দিতে পারে না। এই নর্ববর্ষ বরণের মধ্য দিয়ে আমাদের মন আলোকিত হোক। আমাদের চিন্তা প্রসারিত হোক। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে মানুষের মানবিক সমঅধিকার প্রতিষ্ঠিত হোক। সকল মানুষ ও নাগরিকের প্রাপ্য মর্যাদা ও পাওনা রাষ্ট্র পরিশোধ করুক। গেল বছরে অকাল বন্যায় হাওরের বিস্তৃর্ণ অঞ্চলের যে কৃষকের ফসল তলিয়ে গেছে, তার বুক ভাঙা কান্না চোখজুড়ে থাকা বিষাদ দেখেছে বাংলাদেশ। এবারের বোশেখে ধান কাটার মহানন্দে সেই বেদনা মুছে যাক। তাবৎ রোগ-শোক, বিপদ-আপদ, বালা-মুছিবত থেকে সকল মানুষ মুক্তি পাক। একটি গণতান্ত্রিক ও অসম্প্রদায়িক রাজনৈতিক সংস্কৃতির সুবাতাস নিয়ে জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে মানুষের ঘরে ঘরে আনন্দ আসুক। অশান্ত-অস্থির সময় তিরোহিত হোক। নববর্ষের আনন্দ মঙ্গল শোভাযাত্রার মধ্য দিয়ে মানুষের ভিতরে বাস করা নীতিহীন, মূল্যবোধহীন, লোভ-লালসা ও দুর্নীতির বিষ কালবেশেখীর ঝড়ের হওয়ায় উপড়ে যাক। আমাদের কৃষকেরা ধান তোলার মহানন্দে নববর্ষকে বরণ করুক।
কূলবধূরা লাজ-নম্র দৃষ্টি নিয়ে বাপের বাড়ি নাইওর আসুক। জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদ, রাজিনৈতক প্রতিহিংসা, দমন-পীড়নের কালো অধ্যায়ের চির অবসান ঘটুক । মানুষে মানুষে সামাজিক-সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধই নয়, গভীর দেশপ্রেম ও জাতীয় ঐক্যের মিলিত মোহনায় কাতারবন্দী হোক। সমাজ জীবন সকল অমাবস্যার অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আলোকিত হোক, অভিশাপমুক্ত হোক। নতুন প্রজন্মের জন্য নিরাপদ আবাসভূমি হয়ে উঠুক প্রিয় স্বদেশভূমি। গানে গানে, সুরে সুরে, প্রেমে প্রেমে মানবিক চিন্তায় মানুষের চিত্ত প্রফুল্ল হোক। অতীতের সকল ভুলভ্রান্তি, অন্যায় পাপাচারের অত্মবিশ্লেষণ করে আত্মশুদ্ধির পথে আত্মসমালোচনা ও অনুশোচনার দহনে পুড়ে প্রতিটি মানুষ বিশুদ্ধ হোক। একটি মানবিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র উপযোগী অসম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনায় বিশ্বাসী মানুষের নবজাগরণ ঘটুক। সমাজ থেকে সকল অন্যায়-অবিচার বিতাড়িত হোক। রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে তৃণমূল পর্যন্ত মানুষে মানুষে ধর্মের নামে, রাজনীতির নামে সকল ভেদাভেদ ও দ্ব›দ্ব-সংঘাতের অবসান হোক। আমাদের পূর্বসুরিরা রাষ্ট্রীয় ও সমাজ জীবনে যে মূল্যবোদ, আদর্শ ও নির্লোভ চরিত্রের দার্শনিকদের মতো আলোর পথ রেখে গেছেন, শুভ চিন্তার দরজা খুলে গেছেন, অনাগত প্রজন্মের জন্য আমরা সেই মহান পথকেই অনুসরণ করার শপথ নেই।
নববর্ষের এই শুভলগ্নে প্রার্থনা এই যে, কালবোশেখীর ঝড়ের সঙ্গে মুষলধারে বৃষ্টি নামুক। সেই বৃষ্টিতে ধুয়ে মুছে যাক আমাদের সকল লজ্জা ও গ্লানি। আমাদের সন্তানেরা যেন থাকে দুধে ভাতে, সুখে-শান্তিতে, প্রিয় স্বদেশভূমি থাকে নিরাপদ, মানুষের জানমালের যেন নিরাপত্তা দিতে পারে রাষ্ট্র। নর্ববর্ষ ঘিরে গোটা দেশজুড়ে নর-নারী উৎসবের মহানন্দের যে প্রস্তুতি নিয়েছেন, ব্যবসায়ীরা যে হালখাতা খুলেছেন তার সবকিছুর নেপথ্যে যে মঙ্গল বাসনা, যে শুভ চিন্তা ও ভালবাসা-প্রেম, মানুষের আনন্দ শ্রোতে তা উৎসারিত হোক। এই সমাজ, রাষ্ট্র, জগৎ সংসার সকল অশুভ শক্তি থেকে নিরাপদ থাক। সকল মানুষেরা গভীর প্রেম ও সম্প্রীতির বন্ধনে মানবিক হৃদয় নিয়ে নতুন করে মিলিত হোক। দুর্নীতি, সন্ত্রাস, ধর্ষণ, হত্যা, নির্যাতন, গুম-খুন থেকে মুক্তি পাক এই সমাজ। সকল মত-পথের মানুষেরা জাতীয় সংস্কৃতির মহোৎবের এই শুভলগ্নে, এই শুভ নববর্ষে সকল ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ভ্রাতৃত্বের নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে জগৎ সংসারকে আলোকিত করুক। শুভ চিন্তা ও স্বপ্ন মনের সকল কালিমা দূর করে শুভ শক্তির বিজয় ঘটাক। কবি গুরু রবী ঠকুরের মতো গভীর আকুতি জানিয়ে বলি, “মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা, অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।”