নিষেধাজ্ঞার জালে আটকে গেল বাংলাদেশও
দীন ইসলাম ও মিজানুর রহমান:
যুক্তরাষ্ট্র ও বৃটেনে চলাচলকারী মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক বেশকিছু আন্তর্জাতিক ফ্লাইটে ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস বহন নিষিদ্ধে উদ্বিগ্ন বাংলাদেশি যাত্রীরা। ঢাকা থেকে ফ্লাইট পরিচালনাকারী বিমান সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিরাও এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, এই নিষেধাজ্ঞা শিথিল করা না হলে তালিকার বাইরে থাকা দেশগুলো বিশেষত বাংলাদেশের যাত্রী পরিবহন কমে যাবে। যদিও নিষেধাজ্ঞার ওই তালিকায় বাংলাদেশের নাম নেই। কিন্তু বাংলাদেশের যাত্রীরা যুক্তরাষ্ট্র ও বৃটেন যাতায়াতে সাধারণত যেসব ফ্লাইট ব্যবহার করেন নিষিদ্ধের তালিকায় সে সব বিমান প্রতিষ্ঠান রয়েছে। আর ওই তালিকায় থাকা অন্তত ৪টি প্রতিষ্ঠানের প্রতি সপ্তাহে ঢাকা থেকে ফ্লাইট রয়েছে। ঢাকা থেকে প্রতিদিন যাতায়াতকারী এমিরেটস ও ইত্তিহাদ নিষেধাজ্ঞার তালিকায় থাকায় বেশি উদ্বেগ ছড়িয়েছে।
বাংলাদেশ সরকারের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা অবশ্য এ নিয়ে এখনই প্রকাশ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাতে চাইছেন না। তারা আপাতত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণেই জোর দিচ্ছেন। এক কর্মকর্তা গতকাল মানবজমিনের সঙ্গে আলাপে বলেন, নিষেধাজ্ঞার তালিকায় যেসব দেশের বিমানবন্দর এবং বিমান সংস্থার নাম রয়েছে তাদের প্রতিক্রিয়া বা অবস্থান কি হয়, সেটি দেখার পরই আমাদের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া সমীচীন হবে। যুক্তরাষ্ট্র গমনে ঢাকা থেকে বিমানের কোনো ফ্লাইট নেই। সহজে দেশটিতে যাতায়াত মধ্যপ্রাচ্য হয়ে চলাচলকারী ফ্লাইটই বাংলাদেশি যাত্রীদের ভরসা। ওই কর্মকর্তা অবশ্য স্বীকার করেন যে, সেই সব ফ্লাইটে যাতায়াতকারী যাত্রীদের ঢালাওভাবে তল্লাশি করা হলে বাংলাদেশিদেরও দুর্ভোগ পোহাতে হবে। ঢাকা থেকে বৃটেনে যাতায়াতে বাংলাদেশিরা এখনো বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের সুবিধা পান। তারপরও ভ্রমণকারীদের বড় অংশ এমিরেটস ও ইত্তিহাদে যাতায়াত করেন। রাজনীতিক, আমলা, ব্যবসায়ী এবং কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি- কে নেই সেই তালিকায়। নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকলে এবং তালিকার বাইরে থাকা দেশগুলোর নাগরিকদের জন্য স্বতন্ত্র ব্যবস্থা না থাকলে বাংলাদেশিদের হয়রানি থেকে মুক্তির পথ মোটেও সহজ হবে না বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
উল্লেখ্য, জঙ্গি হানার আশঙ্কা থেকে প্রথমে যুক্তরাষ্ট্র ও পরে বৃটেন ৮টি দেশের ব্যাপারে ওই নিষেধাজ্ঞা জারি করে। নিষেধাজ্ঞায় বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র ও বৃটেনের উদ্দেশে যাত্রা করলে ল্যাপটপ, ট্যাবলেট, ডিভিডি প্লেয়ার, ক্যামেরা, প্রিন্টার ও কিংডল হাতে করে নেয়া যাবে না। এভিয়েশন সিকিউরিটি ইন্টারন্যাশনাল ম্যাগাজিনের সম্পাদক ফিলিপ বাম যুক্তরাষ্ট্রের পথ ধরে বৃটিশ সরকারের একই রকম নিষেধাজ্ঞা জারির সিদ্ধান্তের কড়া সমালোচনা করেছেন। নিষেধাজ্ঞা বলবৎ হলে এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলো থেকে মধ্যপ্রাচ্য হয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও বৃটেনে যাতায়াতকারী যাত্রীদের নানা দুর্ভোগ ও হয়রানির আশঙ্কা করেছেন তিনি। বিমানবন্দরগুলোতে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে বলেও আশঙ্কা ওই বিশেষজ্ঞের। বৃটিশ সরকারের এমন সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে ফিলিপ বাম বলেন, যে ল্যাপটপে বিস্ফোরক (আইইডি) বহন করা হচ্ছে ২০১৭ সালে এসেও যদি তা চিহ্নিত করা না যায় তাহলে আমাদের স্ক্রিনিং প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিতে পারে। বেসামরিক বিমান চলাচল বিষয়ক ওই বিশেষজ্ঞ মনে করেন, যে মানুষগুলো বিমানে যাতায়াত করেন লাগেজে তাদের ল্যাপটপ ও অন্য সরঞ্জাম চেক করার কাজে উৎসাহিত করা খুবই কঠিন ও চ্যালেঞ্জিং হবে। তবে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার স্পষ্টিকরণের বিষয়টি সামনে এনেছেন। যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, যে সব ডিভাইসের মাধ্যমে বোমা বা বিস্ফোরক বহন করে হামলা চালানো হতে পারে তারা কেবল সেটিই নিষেধাজ্ঞার আওতায় এনেছেন। এ নিয়ে স্পষ্ট বক্তব্য এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগের তরফে। অবশ্য গত বছর সোমালিয়ার একটি অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটে একই প্রক্রিয়ায় বোমা হামলার যে উদাহরণ দেয়া হয়েছে তার তীব্র সমালোচনা করেছেন ওই বিশেষজ্ঞ। তার মতে, সোমালিয়ার মোগাদিসু থেকে জিবুতি যাচ্ছিল ডালো এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটটি। তাতে বোমা হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল ল্যাপটপকে। সেই ল্যাপটপ চেক করা হয়েছিল। চেকআপের পর তা যাত্রীর কাছে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছিল। তাহলে কি চেকআপ করা হয়েছিল সেই প্রশ্নও রাখেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্র তার নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনে নি এমন দুটি দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মরক্কোকে বৃটেন কেন তাদেরকে এ তালিকায় রেখেছে তা নিয়ে স্পষ্ট কোনো বক্তব্য বা ব্যাখ্যা না দেয়ায় চরম হতাশা প্রকাশ করেছেন ওই বিশেষজ্ঞ। তার মতে, যে বিমানবন্দরগুলোতে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে প্রতিদিন তা ব্যবহার করেন প্রায় ৫ হাজার মানুষ। তাদের চলাচলের সময় বাড়তি পরীক্ষা, চেকআপে অতিরিক্ত সময় লাগবে। এতে কাজের গতি শ্লথ হয়ে পড়বে।
সাময়িক ক্ষতির আশঙ্কায় বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো: যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের ট্যাব, ল্যাপটপ নেয়া সংক্রান্ত নিষেধাজ্ঞায় সাময়িক ক্ষতির আশঙ্কা করছে এমিরেটস, ইত্তিহাদ ও তার্কিশসহ কয়েকটি এয়ারলাইন্সের বাংলাদেশ অফিস। তারা বলছেন, ট্রানজিট সয়য় শেষে যাত্রীদের ওই দেশে ৮-১৪ ঘণ্টা সময় জার্নি করতে হয়। এই দীর্ঘ সময় আইপেড, ল্যাপটপ না থাকলে যাত্রীদের অনেক অসুবিধা হবে। তারা প্রয়োজনীয় যোগাযোগেও ব্যর্থ হবেন। অনেক যাত্রী তার পছন্দের গান, ভিডিও ট্যাবে ল্যাপটপে ডাউনলোড করে নিয়ে যান। মোবাইলে এত জিনিস লোড করার সুযোগ খুব কম। ইত্তিহাদ এয়ার লাইন্সের বাংলাদেশে কান্ট্রি ম্যানেজার হানিফ জাকারিয়া মানবজমিনকে বলেন, নিরাপত্তার ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে যে কথা বলেছে সেটা আমাদের মানতে হবে। কারণ কোনো ধরনের অঘটন ঘটলে তার দায়-দায়িত্ব এয়ারলাইন্স নেবে না। তিনি বলেন, আমরা আমাদের যাত্রীদের সতর্ক সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য এরমধ্যে পৌঁছাতে শুরু করেছি। এদিকে, ইত্তিহাদ এয়ারলাইন্স সূত্রে জানা গেছে, এরমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যগামী যাত্রীদের নিজের সঙ্গে ট্যাব ও ল্যাপটপ বহন না করার অনুরোধ করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এর পাশাপাশি এমিরেটসসহ অন্যান্য এয়ারলাইন্স এরইমধ্যে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করছে। মনিটর সম্পাদক ও এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ ওয়াহিদুুল আলম মানবজমিনকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যর এ নতুন এ নিষেধাজ্ঞায় বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো আপাতত সমস্যায় পড়বে। তবে এটা কাটতে কতদিন লাগবে তা সময়ই বলে দেবে বলে মনে করেন তিনি।এমজমিন