গত বছরের প্রথম তিন মাসে ইতালিতে অবৈধভাবে পাড়ি জমানো শরণার্থীদের মধ্যে মাত্র একজন ছিল বাংলাদেশি, ২০১৭ সালে তা ২ হাজার ৮০০ জনে গিয়ে ঠেকেছে। এর মধ্য দিয়ে ইউরোপে শরণার্থীদের উৎসস্থল হিসেবে একক দেশ হিসেবে সিরিয়া, আফগানিস্তান, ইরাককে ছাড়িয়ে বাংলাদেশ এখন শীর্ষে বলে যুক্তরাজ্যের দৈনিক ইন্ডিপেন্ডেন্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। এই শরণার্থীরা মূলত লিবিয়া হয়ে ইতালিতে ঢুকেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ থেকে দুবাই হয়ে লিবিয়ায় পাড়ি জমায় এই শরণার্থীরা, এরপর ভূমধ্য সাগরে নৌকা ভাসায় ইতালির লক্ষ্যে। ইউরোপে শরণার্থীদের রুট ও জনমিতির মানচিত্র বদলের এই তথ্য উঠে এসেছে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) কর্মকর্তাদের কথায়। তবে অবৈধভাবে ইউরোপে পাড়ি জমানো বাংলাদেশিদের এই সংখ্যাধিক্যের পেছনে রোহিঙ্গারাও একটি কারণ বলে মনে করছেন গবেষকরা। সেইসঙ্গে বাংলাদেশে রাজনৈতিকভাবে চাপের মুখে থাকা জামায়াতে ইসলামীর কর্মীরাও এই সংখ্যা বাড়িয়ে তুলেছে বলে তাদের ধারণা।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন শরণার্থীদের ঢল সামলাতে কয়েক বছর আগে তুরস্কের সঙ্গে চুক্তির পর আজিয়ান সাগরের রুটটি দিয়ে অনুপ্রবেশ কমে গেলে ভূমধ্য সাগর হয়ে ইতালিতে পাড়ি জমানো বেড়ে যায়। সক্রিয় হয়ে ওঠে যুদ্ধবিধ্বস্ত লিবিয়ায় মানবপাচারকারীরাও। আইওএম কর্মকর্তা ফ্লাভিও দি গিয়াকোমো ইন্ডিপেন্ডেন্টকে বলেন, “গত বছর মার্চ নাগাদ তিন মাসে ইতালিতে ঢোকা বাংলাদেশির সংখ্যা ছিল একজন। এই বছরে ওই সময়ে এই সংখ্যাটি দাঁড়িয়েছে ২৮৩১ জনে। এই তথ্যটি শরণার্থীদের জাতীয়তার পরিবর্তনের বিষয়টি মেলে ধরে। ভূমধ্য সাগর পাড়ি দিয়ে ইতালিতে ঢোকার অবৈধ পথটি বেশ বিপদসঙ্কুল। সেখানে নৌকাডুবিসহ নানা কারণে এই এবছরই প্রায় ১১০০ জনের মৃত্যু হয়েছে। ইতালিতে যেতে নৌকায় ওঠার আগে বাংলাদেশ থেকে দুবাই কিংবা তুরস্ক হয়ে লিবিয়ার মাটিতে নামা বিমানেই হয়।

এজন্য ১০ হাজার ডলারের বেশি অর্থ পাচারকারীদের দিতে হয়েছে বলে ডুবে যাওয়া নৌকা থেকে উদ্ধার বাংলাদেশি কয়েকজন দাতব্য সংস্থা ও মানবাধিকার কর্মীদের জানিয়েছেন। এর মধ্যে ১০ হাজার ডলারের মতো দিতে হয় লিবিয়া পৌঁছানো পর্যন্ত, এরপর নৌপথের জন্য ৭০০ ডলার। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের লিবিয়া বিষয়ক গবেষক হানান সালেহ ইন্ডিপেন্ডেন্টকে বলেন, আমার জানা মতে দুবাই থেকে ত্রিপলির (লিবিয়ার রাজধানী) কোনো সরাসরি ফ্লাইট নেই। দুবাই থেকে তিউনিস হয়ে আসতে হয়। ইতালির সিসিলি ও অ্যাপুলিয়ায় পৌঁছনো বেশ কয়েকজন মানবাধিকারকর্মীদের বলেছেন, ওয়ার্কিং ভিসার জন্য তাদের ৩ থেকে ৪ হাজার ডলার দিয়েছেন ‘এজেন্টকে’।

হানান সালেহ বলেন, আমার কাছে তথ্য আছে যে লিবিয়ায় বিমান থেকে নামার পরপরেই এই শরণার্থীদের অনেকের কাছ থেকে সব কাগজপত্র নিয়ে তাদের একটি স্লিপ ধরিয়ে দেওয়া হয়, যা পরবর্তীতে তাদের কাছ থেকে আরও অর্থ নেওয়ার পথ তৈরি করে। লিবিয়ায় মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে অপসারণের পর বর্তমান অস্থির পরিস্থিতি মানব পাচারকারীদের বড় সুযোগ করে দিয়েছে।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক গবেষক নিকোলাস ম্যাকগিহান ইন্ডিপেন্ডেন্টকে বলেন, ঢাকা থেকে দুবাই পর্যন্ত রুটটিতে অসাধু জনশক্তি রপ্তানিকারকদের দৌরাত্ম্য রয়েছে। তারা (জনশক্তি রপ্তানিকারক) অনেক যুবকের কাছে স্বপ্ন বিক্রি করে, কিন্তু সেই যুবকদের স্বপ্ন বেশিরভাগ সময় খান খান হয়ে যায়। রেমিটেন্সে আশায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সরকার জনশক্তি রপ্তানিতে এই অনিয়মের বিষয়ে উদাসীন বলে তার মন্তব্য।

মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো বাংলাদেশের বড় শ্রম বাজার হলেও ইউরোপমুখে তাদের সংখ্যাধিক্যের কারণ ব্যাখ্যা করে যুক্তরাজ্যভিত্তিক দি রয়াল ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের গবেষক গ্যারেথ প্রাইস ইন্ডিপেন্ডেন্টকে বলেন, মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিমরাও বাংলাদেশ হয়ে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। এছাড়া জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের যুদ্ধাপরাধে ফাঁসিতে ঝোলানোর পর দলটির অনেকে বিদেশে রাজনৈতিক আশ্রয় চাচ্ছেন। ইউরোপ সেক্ষেত্রে ভাল গন্তব্য। আর কেউ যদি কেউ একটা রুট তৈরি করতে পারে, তারপর মানুষের ব্যবহারে দ্রুতই তা জমজমাট হয়ে ওঠে বলে মন্তব্য করেন প্রাইস।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn