তারাপুর চা বাগান

সিলেটের প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার দেবোত্তর সম্পত্তি প্রতারণার মাধ্যমে দখল করে নিয়েছিলেন বিতর্কিত শিল্পপতি রাগীব আলী। ২০১৬ সালে উচ্চ আদালতের এক রায়ের প্রেক্ষিতে রাগীব আলীর দখল থেকে চা বাগানের ভূমি উদ্ধার করা হয়। সেসময় আদালত নির্ধারিত সেবায়েত পঙ্কজ কুমার গুপ্তকে ওই বাগান বুঝিয়ে দেওয়া হয়।

তবে এবার উচ্চ আদালতের রিভিউ রায়ের প্রেক্ষিতে আলোচিত এই সম্পত্তি ব্যবস্থাপনার কর্তৃত্ব হারিয়েছেন পঙ্কজ গুপ্ত। এই সম্পত্তি দেবতার নামে দানকারী পরিবারের সদস্য ছিলেন পঙ্কজ। রিভিউ রায়ে সম্পত্তি সংরক্ষণ ও তদারকির জন্য একটি ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠনের নির্দেশনা দেওয়া হয়। এই নির্দেশনার প্রেক্ষিতে সিলেটের জেলা প্রশাসক ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করেন। গত বৃহস্পতিবার (১৪ জানুয়ারি) নতুন কমিটি তারাপুর চা বাগানের দায়িত্ব গ্রহণ করেছে।

গত ২৭ সেপ্টেম্বর রিভিউয়ের এই পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। এতে বাগান পরিচালনার লক্ষ্যে ৫ বছরের জন্য ১১ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠনের নির্দেশ দেন হাই কোর্ট। ব্যবস্থাপনা কমিটির মাধ্যমে চা বাগানের সম্পত্তি পরিচালনার পাশাপাশি বাগান দখল করে রাগীব আলী ও তার স্ত্রীর নামে গড়ে তোলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ সকল স্থাপনা অপসারণের নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে স্থাপনাগুলো এখনো সরানো হয়নি। আদালতের নির্দেশে গঠিত ১১ সদস্যের ব্যবস্থাপনা কমিটির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে রয়েছেন সিলেট সিটি করপোরেশনের ১৩ নং ওয়ার্ড কাউন্সিরল শান্তনু দত্ত সন্তু।

তিনি বলেন, উচ্চ আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়ন করাই আমাদের মূল লক্ষ্য। আমরা কাগজে-কলমে দায়িত্ব পেয়েছি। আগামী ২৩ জানুয়ারি আমরা প্রথম বৈঠকে বসবো। বৈঠকে বাগানের ভেতরের স্থাপনাগুলো সরানোর ব্যাপারে আলোচনা হবে। এ ব্যাপারে আদালতের নির্দেশনা যাছাই বাছাই করে আমরা প্রশাসনের সহযোগিতা চাইবো।

এ ব্যাপারে সিলেটের জেলা প্রশাসক এম. কাজী এমদাদুল ইসলাম বলেন, আদালতের নির্দেশে ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করে তাদের কাছে তারাপুর চা বাগানের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন স্থাপনাগুলো অপসারণে এই কমিটি উদ্যোগ নেবে। এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন তাদের সহযোগিতা করবে। রায়ে এমনটিই বলা হয়েছে। আমরা আদালতের নির্দেশনা অনুসারে কাজ করছি।

সিলেট নগরের পাঠানটুলা এলাকার প্রায় ৪২৩ একরের তারাপুর চা বাগান দেবোত্তোর সম্পত্তি। প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার এই সম্পত্তি ১৯৯০ সালে জালিয়াতি ও প্রতারণার মাধ্যমে দখল করে নেন শিল্পপতি রাগীব আলী। এরপর ১৯৯৫ সালে বাগানের ৮.২২ একর জায়গার চা গাছ ধ্বংস করে নির্মাণ করেন প্রায় এক হাজার শয্যার জালালাবাদ রাগীব রাবেয়া মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল। মেডিকেল কলেজের পাশে আরও অনেক জায়গাজুড়ে নিজের স্ত্রীর নামে রাবেয়া খাতুন নার্সিং কলেজ, মেডিকেলে কলেজের ছাত্রদের জন্য ছাত্রাবাসসহ বেশিকিছু স্থাপনা গড়ে তুলেন রাগীব আলী। এছাড়া বাগান ধ্বংস করে গড়ে ওঠেছে আরও অসংখ্য স্থাপনা। জেলা প্রশাসনের হিসেবে জানা গেছে, চা বাগানের ভেতরে অবৈধভাবে মোট ৩৩৭টি স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে। এরবেশিরভাগই বহুতল আবাসিক স্থাপনা।

প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসাইনের নেতৃত্বে ৭ সদস্যের আপীল বেঞ্চ রিভিউ রায়ে পঙ্কজ কুমার গুপ্তের সেবায়েত দাবি নিয়ে প্রশ্ন তুলে আদালত বলেন, শ্রী শ্রী রাধা কৃষ্ণ জিউ দেবতার বিগ্রহ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব যুগলটিলা আখড়া কমিটির কাছে হস্তান্তর করে সপরিবারে ১৯৮৮ সালে দেশ ত্যাগ করেন পঙ্কজ। এর পর থেকে এই বিগ্রহের দায়িত্বে রয়েছে চৈতন্য কালচারাল সোসাইটি। পরবর্তীতে পংকজ কুমার গুপ্ত সরকারী অনুমতি সাপেক্ষে ১৯৯০ সালে তারাপুর চা বাগানের দখল লিজমূলে আব্দুল হাইর কাছে হস্তান্তর করেন। এরপর কখনোই পঙ্কজ কুমার গুপ্ত উক্ত লিজ দলিলটি জাল বা ভুয়া বলে কোথাও কোন অভিযোগ করেননি বা হস্তান্তরিত সম্পত্তি পুণরুদ্ধারেরও কোন উদ্যোগ নেননি। কোন সেবায়েত কোন সম্পত্তি সরকারের অনুমতি নিয়েও কারো কাছে হস্তান্তরের অধিকার রাখেন না। অথচ, পঙ্কজ কুমার গুপ্ত তাই করেছেন।

আদালত বলেন, পঙ্কজ কুমার গুপ্ত ১৯৮৮ সালে দেবতার সম্পত্তি শাসন, সংরক্ষণ না করে দেবতার সেবা ও পূজার ভার যুগলটিলা আখড়া কমিটির কাছে ন্যস্ত করে অন্য দেশে চলে যান। তিনি বর্তমানে ভারতীয় নাগরিক। তাই তিনি বাংলাদেশের কোন কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করতে পারেন না। তিনি দেবতার সমুদয় সম্পত্তি রাগীব আলীর পুত্র আব্দুল হাই এর কাছে হস্তান্তরের জন্য ৯৯ বছরের জন্য অবৈধ চুক্তি করেছেন। তার সেবায়েত হওয়ার দাবিরও বৈধতা নেই।

তারাপুর চা বাগানের দায়িত্ব ব্যবস্থাপনা কমিটির কাছে হস্তান্তর প্রসঙ্গে পঙ্কজ কুমার গুপ্ত বলেন, ২০১৬ সালে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে আমাকে সেবায়েত হিসেবে নির্ধারণ করে আমার কাছে দেবোত্তর সম্পত্তি হস্তান্তর করা হয়েছিলো। কিন্তু রিভিউ পিটিশন রায়ে অনেক কিছু পরিবর্তন করা হয়েছে। এ রায়ে হঠাৎ করে পারিবারিক দেবোত্তর সম্পত্তিকে পাবলিক দেবোত্তর দেবোত্তর সম্পত্তি বলা হয়েছে। আমাকে ব্যবস্থাপনা কমিটিতেও রাখা হয়নি। এবিষয়ে আইনি প্রক্রিয়ায় লড়ে যাওয়ার কথা জানান তিনি।

সিলেটের জেলা প্রশাসক কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, আদালতের নির্দেশনার প্রেক্ষিতে গত ১১ জানুয়ারি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) বন ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নারায়ণ চন্দ্র সাহাকে সভাপতি করে ৯ সদস্যের ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিতে আরও ৩ জন সদস্যকে অন্তভর্’ক্ত করা হবে।

কমিটির অন্য সদ্যসরা হলেন- সহ সভাপতি এডভোকেট নিলেন্দ্র দে, সাধারণ সম্পাদক সিটি কাউন্সিলর শান্তনু দত্ত শন্তু, সহ-সাধারণ সম্পাদক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (জকিগঞ্জ সার্কেল) সুদীপ্ত রায়, কোষাধ্যক্ষ শ্রী শ্রী জগবন্ধু সুন্দর ধামের অধ্যক্ষ বন্ধুপ্রীতম ব্রহ্মচারী, সদস্য সিলেট যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সিনিয়র সহকারি জজ নির্জন কুমার মিত্র, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সিলেট বিভাগের সাবেক পরিচালক ডা. বনদ্বীপ লাল দাস, চৈতন্য কালচারাল সোসাইটির অধ্যক্ষ শ্রীমদ ভক্তি অদ্বৈত নবদ্বীপ স্বামী মহারাজ, সিলেট মুরারিচাঁদ (এমসি) কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ অধ্যাপক নন্দলাল শর্মা। কমিটিতে প্রয়াত বৈকুন্ঠ চন্দ্র গুপ্তের একজন উত্তরাধিকারী  ও সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির একজন হিন্দু সদস্যকে রাখা হবে বলে জানা গেছে।

তারাপুর চা বাগানের মালিক বৈকুন্ঠ চন্দ্র গুপ্ত ১৯১৫ সালের ২ জুলাই তারাপুর চা বাগানসহ তার সকল স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি শ্রী শ্রী রাধাকৃষ্ণ জিউড় দেবতার নামে রেজিস্ট্রি দানপত্র করে দলিল করে দেন। বৈকুণ্ঠ গুপ্তের ছেলে রাজেন্দ্র গুপ্ত ও তার তিন ছেলে শহীদ হন। তার তিন মেয়ে ধরে নিয়ে নির্যাতন করে পাক সেনারা। ১৯৮২ সালে রাজেন্দ্র গুপ্তের ছেলে পঙ্কজ গুপ্ত ভারতে চলে যান। এসময় পাশ্ববর্তী মালনীছড়া চা বাগানের সত্ত্বাধিকারী রাগীব আলীকে তারাপুর চা বাগান দেখভালের দায়িত্ব দিয়ে যান। এরপর পাওয়ার অব এটর্নি মূলে দেবোত্তোর সম্পত্তিটির সেবায়েত বনে যান দেওয়ান মেস্তাক মজিদ। যিনি রাগীব আলীর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। তিনি রাগীব আলীকে ৯৯ বছরের জন্য বাগনটি লিজ প্রদান করেন। ১৯৯০ সালে বাগানটির দখল নেন শিল্পপতি রাগীব আলী।

২০১৬ সালের ১৯ জানুয়ারি তৎকালীন প্রধান বিচারপতির সুশেন্দ্র কুমার (এসকে) সিনহার নেতৃত্বে হাই কোর্টের আপিল বিভাগের একটি বেঞ্চ দেবোত্তোর সম্পত্তি তারাপুর চা-বাগান রাগীব আলীর দখল করাকে প্রতারণামূলক আখ্যা দিয়ে পুরো বাগান সেবায়েত পঙ্কজগুপ্তকে বুঝিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে বাগান দখল করে গড়ে ওঠা সব স্থাপনা ছয় মাসের মধ্যে সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়। এই নিদের্শনার পর ওই বছরের ১৫ মে জেলা প্রশাসন রাগীব আলীর দখল থেকে চা বাগানের ভূমি উদ্ধার করে সেবায়েত পঙ্কজ গুপ্তকে বুঝিয়ে দেয়। বাগানের ৪২২.৯৬ একর ভূমির মধ্যে ৩২৩ একর ভূমি সেদিন সেবায়েতকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। তবে বাগানের ভেতরে জালালাবাদ রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, নার্সিং কলেজসহ রাগীব আলীর নির্মিত সকল স্থাপনা বহাল থাকে। মেডিকেল কলেজসহ স্থাপনাগুলো না সরাতে উচ্চ আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদন করেন রাগীব আলী। তবে এই আবেদনও খারিজ হয়ে গেছে।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn