বালিকার প্রেমে পরা বালকের মতোন এ শহর আমাকে টানে! কেন এত টানে! এত মায়া? বাবা ১৯৫৫ সালে সুনামগঞ্জ শহরের এ বাড়িটি কিনেছিলেন মায়ের চাপে। বাড়িটির দাম ছিলো ৯শ টাকা। বাড়ির গাছগাছালি সব মায়ের হাতের লাগানো। ফলজ এমন কোনো বৃক্ষ নেই যা বাড়িতে ছিলোনা। তেতুল, চালতা গাছ ঝড়ে উপড়ে গেছে। শহর থেকে একমাইল দূরেই আমাদের দাদার বাড়ি। বাড়িতে প্রবেশে ডানে মসজিদ বামেই কবরস্থান। পারিবারিক। সেটিও বৃক্ষশোভিত। কবরে পূর্বপুরুষরা শুয়ে আছেন। বাবা মা দুই ভাইও শুয়ে আছেন। আপা কেবল বার্মিংহামে চিরনিদ্রায়।

বাবা যখন বাড়ি কিনে, মা আপা ও দুই ভাই নিয়ে এ বাড়িতে পার হলেন তখন শহরের চারদিকে হাওর, নদী খাল। বিস্তীর্ণ জলরাশি। বধূরা বাপের বাড়ি, মামার বাড়ি নাইওর যেতেন পানসি নৌকায়, ছৈয়াআলা নাওয়ে। কামারখালি খরস্রোতা খালটি কালিবাড়ি ছিলো। আমাদের ছেলেবেলায়ই তা দেখলে ভয় লাগতো। এখান থেকেই নৌকায় নাইওর যেতেন মায়েরা। সেই খাল এখন কেউ খুঁজে পাবেননা! কবে ভরাট হয়ে গেলো। শহরজুড়ে ছিলো গাছ আর গাছ। সেই মায়ার শহর বদলে গেছে। কত পুকুর ভরাট হয়ে গেছে! বর্ষায় তুফানে নৌকাডুবির ডর ভয় নিয়ে দোয়াদরুদ পরেই এ মধুরযাত্রা করতেন। গ্রামীণ শহর। চেনা চেনা সব বাড়ি। সরু রাস্তাঘাট, বিদ্যুত অপ্রতুল। রিক্সার টুংটাংশব্দ। সাদাকালো সিনেমার সেই যুগ।

আমাদের ছেলেবেলায়ও শহর ছিলো ছবির মতোন সাজানো। সব বাড়ি সব মানুষ চেনা জানা। বাবা মা, ৮ ভাই বোনের টানাপোড়েনের সংসার! তবু বাড়িতে সুখ উপচে পরতো। মা ভালো বাসতেন বৃক্ষ ও বাগান। বাবা পরিচ্ছন্নতা। ভোরের স্নিগ্ধতায় ঘুম ভাঙতো মা বোনের সুরেলা কোরআন তেলাওয়াতে। ফজরের নামাজ পরে, হেটে এসে বাবা তেলাওয়াত শেষে গোটা বাড়ি ঝাড়ু দিতেন নিজ হাতে।

ডিসিপ্লিন জীবন। তাই শতায়ু হয়েছিলেন। গাছের পাতা নীচে থাকতে দিতেননা। মা জোছনা রাতে বারান্দা উঠোনে হাঁটতেন। তার কাছেই প্রকৃতি ও নক্ষত্রের পাঠ নেওয়া। রাতে কিসসা শোনিয়ে ঘুম পাড়াতেন। আমাদের শৈশব থেকে কৈশোর, দলবেধে স্কুল, খেলার মাঠ, স্কাউট, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড, লুকিয়ে রাত গভীরে যাত্রা, পালাগান উপভোগ। বাংলোঘর থেকে শহরের সব পথে, নদীরঘাটে তারুণ্য পর্যন্ত অাড্ডাই আড্ডা। ধুলোমেখে জোছনায় ভিজে বৃষ্টিতে গা ধুয়ে ঘরে ফেরার সে কি সুখ। বাড়ির পিছনে পুকুর ভরাট হয়ে গেছে। ছেলেবেলায় অবাধ্য দুপুরে সাঁতার কাটা। পাড়া মাতিয়ে দুরন্তপনা! ঘুড়ি উড়ানো! নষ্টালজিক জীবন কত সুন্দর! এখনো বাড়ি যাই, বাবা মা, দুই ভাই আপা নেই। দুই বোন নিজেদের সংসারে। তবু ভালোলাগে। বারান্দায় ঘরে আড্ডা, জোছনা ও বৃষ্টি উপভোগ! আর বর্ষায় টানা মুষলধারে নামা বৃষ্টির রাতে টিনের চালে তার দাপাদাপি, কি সুমধুর সুর তন্দ্রাচ্ছন্ন করে রাখে। যেমন জোছনা প্লাবিত রজনী গাছগাছালি ঘেরা বাড়িতে নৈসর্গিক সৌন্দর্য্যই নয়, রহস্যের মায়াজালেও বাধে।

এখন পুকুর পার জুড়ে লেবু নেই। নেই বাংলোঘর। সময় বদলেছে। শহর পাল্টেছে। উন্নয়নের সড়কে রাস্তাঘাট বড়োসড়ো হয়েছে। ড্রেজারে হাওর জলাশয় ভরে বসতি গড়ে উঠছে। অনেকটাই অচেনা লাগে। মূল্যবোধের অবক্ষয়ে রাজনীতি ও সমাজে কত রোগ। তবু সামাজিক সাম্প্রদায়িক সেই সম্প্রীতির চিত্র না থাকলেও অনেকটাই আছে। ভালোতো আছে। অসুস্থ প্রতিযোগিতায় অঢেল বিত্তবৈভবে ভোগবিলাসে ডুবেছে লোভীরা। তবু আদর্শবান মানুষ আছে।

তবু শহর এখনো কবিতা প্রেম আড্ডা গান জল জোছনা বৃষ্টির। তবু এ শহর আমাকে টানে। তবু এ বাড়ি আমাকে টানে। বৃষ্টিমুখর রাতে বাড়ির শয্যা গভীর ঘুমে ডুব দিতে ডাকে। পাখিরা ডাকে, কোকিল প্রাণ আকুল করা ডাক দেয়। তবু ডাকে নদী, হাওর।

জোছনায় জলে ভাসতে বলে। এ শহর, এ বাড়ি তবু আমাকে টানে। প্রেমে পরা বালক যেমন বালিকার টানে ছুটে চলে! জলে নামে ভুল করে। তেমনি আমাকেও টানে এ বাড়ি ও শহর। জন্ম আর ধুলোবালি মাখা জোছনা বৃষ্টিতে ভিজে বেড়ে ওঠার ঋনে।

লেখক: পীর হাবিবুর রহমান, সিনিয়র সাংবাদিক (ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে)

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn