সিলেটে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। কমতে শুরু করেছে বন্যার পানি। তবে পানি কমার সাথেসাথে বাড়ছে বন্যা কবলিতদের দুর্ভোগ।খাবার ও কাজ না থাকায় অসহায় অবস্থায় রয়েছে আট উপজেলার ১৮ হাজার পরিবারের প্রায় দেড় লাখ মানুষ। ফেঞ্চুগঞ্জের উত্তর ইসলামপুর গ্রামের আছদ্দর আলীর পরিবার পানিবন্দি হয়ে আছে গত দুই মাস ধরে। আগাম বন্যায় তলিয়েছে তার ১০ বিঘা জমির বোরো ধান। এখন বর্ষায় ডুবছে ভিটেবাড়ি। ঘরে খাবারও নেই। ৮০ বছরের আছদ্দর আলী বলেন, কুশিয়ারা নদীর তীরে বাড়ি হওয়ায় নদী উপচে বাড়িতে পানি উঠেছে। দুই মাস ধরে পানির সঙ্গে সংগ্রাম করেই জীবন-সংসার চালাচ্ছি। একই উপজেলার গয়াসী গ্রামের অরুণা বিশ্বাসের বাড়িও এক মাস ধরে ঘিরে রেখেছে কুশিয়ারার পানি। বাইরে থৈ থৈ বানের জল, ঘরের মধ্যে হাঁটু পানি। অরুণার স্বামী দিন মজুর। চারদিকে পানি থাকায় কাজ নেই। অরুণা বলেন, ঘরে পানি উঠায় মাচাং বেঁধে রান্না-বান্না করছি। পরিবারের ছয় সদস্য। হাতে টাকা-পয়সা নেই তাই চড়া সুদে মহাজনের কাছ থেকে নেওয়া ঋণই এখন শেষ ভরসা। একমাসে একবার ত্রাণ হিসেবে পেয়েছেন পাঁচ কেজি চাল। এ চাল শেষ হয়েছে চার বেলা রান্না করেই। এখন একবেলা সামান্য খেলে আরেক বেলা থাকতে হচ্ছে উপোষ, বলেন অরুণা।

জেলা প্রশাসনের হিসাব অনুযায়ী, বন্যায় সিলেটের আট উপজেলার এক লাখ ৩৮ হাজার ৭৫৫ জন লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। দুর্গতদের সাহায্যে জেলা প্রশাসনের পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক সংগঠনের পক্ষ থেকে ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) শহীদুল ইসলাম চৌধুরী জানান, সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ, বালাগঞ্জ, গোলাপগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, ওসমানীনগর, কোম্পানীগঞ্জ, দক্ষিণ সুরমা, জকিগঞ্জ উপজেলার ২৪টি ইউনিয়নের ৪৬৬ গ্রাম বন্যা কবলিত হয়েছে। তাছাড়া চার হাজার ৪৯১টি ঘরবাড়ি বন্যায় ক্ষতি হয়েছে। বন্যার কারণে বন্ধ রয়েছে ২০০ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠদান। বেশি বন্যা কবলিত তিন উপজেলার ১১টি আশ্রয়কেন্দ্রে ৬২৯ জন মানুষ আশ্রয় নিয়েছিলেন। পানি কমায় অনেকে বাড়ি চলে গেছেন বলে জানান তিনি। সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সিরাজুল ইসলাম বলেন, কুশিয়ারা ও সুরমা নদীর পানি গত চার দিন ধরে কমছে। শনিবার ৫টি পয়েন্টে পানি কমেছে ৬ থেকে ১০ সেন্টিমিটার। তবে এখনও বিপদসীমার উপরে রয়েছে নদীর পানি।

ভারি বৃষ্টি না হলে আর নতুন করে পাহাড়ি ঢল না নামলে বন্যা পরিস্থিতির আরও উন্নতি হবে বলে জানান তিনি। বিয়ানীবাজারের সাদীমাপুর গ্রামের কৃষক সিরাজ মিয়া। দুই দফা বন্যায় নষ্ট হয়ে গেছে তার সব ফসল। ঘরে পানি উঠায় স্ত্রী নিয়ে আশ্রয় কেন্দ্রে গিয়েছিলেন। এখন পানি কিছুটা কমায় ঘরে ফিরলেও শঙ্কায় আছেন কখন ভেঙে পড়ে কাঁচা ঘর। শুধু কৃষক সিরাজ মিয়ার ঘর নয় দমকা বাতাস এলে যে কোনো সময় ধসে পড়তে পারে আট উপজেলার সহস্রাধিক কাঁচা বাড়িঘর। ওসমানী নগরের সাদীপুর ইউনিয়নের সুরিকোনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেওয়া আয়শা আক্তার বলেন, সাত জনের সংসার। মাত্র একদিন পাঁচ কেজি চাল সাহায্য পেয়েছি। দুই দিনেই চাল শেষ। বন্যাদুর্গতরা ত্রাণ পাচ্ছেনা বলে অভিযোগ করছেন বেশ কয়েকদিন ধরেই। সরকারিভাবে জেলার প্রায় এক লাখ ৩৯ হাজার মানুষের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে নগদ ১২ লাখ টাকা ও ৮০০ মেট্রিক টন চাল। দুর্গত এলাকায় জেলা প্রশাসন যে ত্রাণ দিয়েছে তার হিসেবে জনপ্রতি ছয় কেজি চাল ও নগদ অর্থ ভাগে পড়েছে ৮ টাকা ৬৪ পয়সা করে।

এ প্রসঙ্গে সিলেটের জেলা প্রশাসক রাহাত আনোয়ার বলেন, নিয়মিত ত্রাণ আসছে। এ হিসেব আরও বাড়বে। দুর্গত সবাই গরীব নন। অনেকে স্বাবলম্বী ত্রাণ নিচ্ছেন না। জনপ্রতি নয় দরিদ্র পরিবার ভিত্তিক ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, ত্রাণ তৎপরতা সুষ্ঠুভাবে সমন্বয় করে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির হাতে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। এদিকে পানি কমতে শুরু করায় নানা পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে দুর্গত এলাকায়। ওসমানীনগরের সাদীপুর ইউনিয়নের পূর্ব তাজপুর গ্রামের আরিফ মিয়া জানান, বন্যায় পানিবন্দি মানুষেরা বাধ্য হয়েই নোংরা পানিতে চলাফেরা করছেন। তাই নানা ধরণের চর্মরোগ দেখা দিয়েছে অনেকের। এছাড়াও জলাবদ্ধ হয়ে থাকা এলাকার শিশুরা নানা ধরণের রোগে ভুগছেন বলেও জানান তিনি।

গোলাপগঞ্জ উপজেলার ভাদেশ্বর গ্রামের রিনা বেগম বলেন, বন্যার কারণে বাড়ি-ঘর ও নলকূপ পানিতে ডুবে যাওয়ায় ডায়রিয়ার প্রকোপ বেড়ে গেছে। তার ছেলেও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত ছিল। তাকে দুই দিন হাসপাতালে রাখতে হয়েছে। বন্যায় স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবেলায় কাজ করছেন জানিয়ে সিলেটের সিভিল সার্জন হিমাংশু লাল রায় জানান, বন্যাদুর্গত এলাকায় চিকিৎসা সেবায় কাজ করছে ৭৮টি মেডিকেল টিম। পানিবাহিত অসুখ মোকাবেলায় মজুদ রাখা হয়েছে পর্যাপ্ত পরিমাণ ওষুধ।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn