পারভীনকে কেন রাস্তায় সন্তান প্রসব করতে হলো?
হাবীবাহ্ নাসরীন :
পারভীনের প্রসব বেদনা উঠেছে, মেয়েটির চারকূলে কেউ নেই। ফুটপাতেই তার বসবাস। কিশোরী মেয়েটির গর্ভে সন্তান। সেই সন্তান পৃথিবীতে আসার জন্য ছটফট করছে। আর পারভীনের তখন অসহ্য যন্ত্রণা। সন্তান প্রসবের কষ্ট শুধু মায়েরাই জানেন। অন্য কারও পক্ষে তার বর্ণনা দেয়া সম্ভব নয়। একজন স্বাভাবিক মানুষ সর্বোচ্চ ব্যথা সহ্য করতে পারে ৪৫ ইউনিট পর্যন্ত। সেখানে মা যখন সন্তান প্রসব করেন তখন তার ব্যথার পরিমাণ থাকে ৫৭+ ইউনিট। পারভীন সেই ব্যথায়ই কাতরাচ্ছিলেন। কেউ তার পাশে ছিল না। কে আর থাকবে, তার যে কেউ নেই! অবশেষে এক পথচারীর দয়া হলে তিনি এগিয়ে আসেন। পারভীনকে নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান। সেখানে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা জানান, পারভীনের সন্তান স্বাভাবিকভাবে পৃথিবীতে আসছে না। প্রয়োজন পড়বে সিজারের। কিন্তু সিজারের জন্য প্রয়োজন টাকা, তার ওপর রয়েছে ওষুধ-পথ্য কেনার খরচ। ‘প্রায় দুই দশক আগে এরকম একটি দৃশ্য আমি চোখের সামনে দেখেছি। আমার ছোট ভাইয়ের জন্মের সময় যখন আম্মুর সঙ্গে আমিও হাসপাতালে গিয়েছিলাম।’
পথচারী লোকটির সঙ্গে টাকা নেই। তিনি নিজেও হয়তো দরিদ্রই। ঢাকা মেডিকেলের স্টাফরা বললেন, পারভীনকে মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে যেতে। কিন্তু সেখানেও চিকিৎসা মেলে না হতদরিদ্র পারভীনের। দেড় হাজার টাকা দিতে না পারায় সেখান থেকে বিনা চিকিৎসায় চলে আসতে হয় পারভীনকে। পথচারী লোকটি এবার তাকে নিয়ে যান আজিমপুর মাতৃসদন ও শিশুস্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানে। কিন্তু কার্ড কিংবা রেজিস্ট্রেশন না থাকার অজুহাতে সেখানেও ভর্তি করা হয়নি তাকে। জ্বি পাঠক, ঠিকই পড়ছেন- প্রসব যন্ত্রণায় কাতর পারভীনকে টেনে হিঁচড়ে বের করে দেয়া হয় হাসপাতালের গেট থেকে! ব্যথায় কাতর পারভীন রাস্তায়ই প্রসব করেন তার সন্তান। আর জন্ম নেয়ার মিনিট খানেকের মধ্যেই মারা যায় নবজাতক। এরপর অবশ্য এলাকাবাসী ও পথচারীদের ক্ষোভের মুখে পড়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ পারভীনকে প্রসব পরবর্তী চিকিৎসা দেয়ার জন্য ভেতরে নিয়ে যান। কিন্তু মাত্র দেড় হাজার টাকার অভাবে জন্মের পরপরই মৃত্যুবরণ করতে হয় পারভীনের সন্তানকে!
আমরাই না সারা বিশ্বের কাছে মানবতার গৌরব করি? বন্যার্তদের পাশে দাঁড়িয়ে, লাখো রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে মানবতার জয়গান গাই! আর আমাদের বোন পারভীনই কিনা তিনটি হাসপাতাল ঘুরেও একটি সন্তান প্রসবের ঠাঁই পায় না! আমাদেরই বোন পারভীনের সন্তানটি কিনা আমাদের নিষ্ঠুরতা সইতে না পেরে জন্মের মিনিট খানেকের মধ্যেই মরে যায়! সন্দেহ নেই আমরা সাধারণ মানুষরা কমবেশি মানবিক। আমরা যদি মানবিকই না হতাম, দরিদ্র পথচারীটি পারভীনের পাশে দাঁড়াতেন না, নিরাপদে সন্তান প্রসবের জন্য এ হাসপাতাল থেকে ও হাসপাতালে ছুটে যেতেন না! আমরা যদি মানবিকই না হতাম, তবে পারভীনের খবর পড়ে আমার মতো নাদান এক কবির চোখ বেয়ে জল গড়াতো না। কিন্তু আমাদের রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিরা কি আমাকে জবাব দেবেন কেন একজন মাকে রাস্তায় সন্তান প্রসব করতে হলো!
প্রায় দুই দশক আগে এরকম একটি দৃশ্য আমি চোখের সামনে দেখেছি। আমার ছোট ভাইয়ের জন্মের সময় যখন আম্মুর সঙ্গে আমিও হাসপাতালে গিয়েছিলাম। সেখানে এক দরিদ্র মায়ের সিজারের টাকা জোগাড় হয়নি বলে পেটের ভেতরেই মারা গিয়েছে তার সন্তান। আমার এখনও মনে আছে মৃত মায়ের পেটের ভেতর শিশুটির ছটফট করতে থাকা সেই দৃশ্য। সাদা কাপড়ে ঢাকা লাশটির ভেতরে তখনও একটি জীবন পৃথিবীর আলো দেখার আকাঙ্ক্ষায় ডানা ঝাপটে যাচ্ছিল! বিশ বছরে এত যে ‘উন্নতি’ হলো হে রাষ্ট্র, একজন মায়ের নিরাপদে সন্তান জন্মদানের ব্যবস্থা হলো না কেন! কেন পারভীনের ছেলেকে হত্যা করার অপরাধে এইসব হাসপাতালের কর্তাব্যক্তিরা খুনির তালিকাভুক্ত হবে না! আমি সরকারি হিসাব বুঝি না, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা বুঝি না, আমি উন্নয়ন বুঝি না, উন্নয়নশীলতা বুঝি না হে রাষ্ট্র! আমি শুধু জানতে চাই আমার বোন পারভীনকে কেন রাস্তায় সন্তান প্রসব করতে হলো। কেন তার সন্তানটি মরে গেল!