বিপুল হাসান-লিখবো বলে একাধিকবার চেষ্টা করেছি, লেখা আসেনি। আসবে কীভাবে? টুকরো টুকরো এতো যে ঘটনা, আজকে সবই স্মৃতি! দুই দশকের পেশাগত জীবনে সবচেয়ে বেশি যার সান্নিধ্য পেয়েছি, তিনি পীর হাবিবুর রহমান।কেবল সান্নিধ্যই নয়, পেয়েছি তার স্নেহ-মমতা আর প্রবল আস্থা। সামান্য বিচ্যুতিতে রগচটা ওই মানুষটার তুমুল গর্জনে মনে মেঘ জমেছে বার বার। দূরে সরে গেছি অন্তত: চারবার। কিন্তু তিনিই ফের কাছে টেনে নিয়েছেন। ডেকে দিয়েছেন কঠিন কঠিন দায়িত্বভার। শেষে বুঝতে পারি, উনার প্রকৃতিই অমন। রাগি হাবভাব আসলে তার বাইরের আবরণ, ভেতরে কোমল দাগহীন ভালো্বাসার ধারা বহমান।
সাংবাদিকতা করবো আর পীর হাবিবুর রহমানকে চিনবো না, তার লেখা পড়বো না; তা হয় না। এ পেশায় আসার শুরু থেকেই এই জাঁদরেল রিপোর্টারকে চিনতাম নামে ও লেখায়। আলোর মুখ না দেখা দৈনিক নতুনধারায় কাজ করতে গিয়ে তাকে দেখি। যেমন তার টান টান লেখা, তেমনই উদ্ধত চালচলন। আর গালে টোল পড়া সেকি প্রাণখোলা হাসি। সবই দূর থেকে দেখা। তার সংস্পর্শ পাই দশ বছর পর।
২০১৫ সালের শেষের দিকের ঘটনা। খেয়ালি পীর হাবিবুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনের নির্বাহী সম্পাদকের পদ ছেড়ে ঠিক করলেন, নিজেই একটা সংবাদমাধ্যম দাঁড় করাবেন। অনলাইন নিউজপোর্টাল পূর্বপশ্চিমে যুক্ত হলাম এটিএন নিউজের সতীর্থ সেজুঁল হোসেনের মাধ্যমে। এত জাঁকজমকে বাংলাদেশে কোনো নিউজপোর্টালের যাত্রা শুরু কখনো হয়নি। শীর্ষ দৈনিকের প্রথম পাতায় বিজ্ঞাপন, টিভি চ্যানেলে বিজ্ঞাপন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অতিথি হয়ে এলেন কলকাতার খ্যাতিমান অভিনেতা প্রয়াত সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও বরেণ্য সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। অনুষ্ঠানে ঢল নেমেছিল শীর্ষ রাজনীতিক, মন্ত্রী-আমলা, শিল্পী-সাহিত্যিক ও মিডিয়া ব্যাক্তিত্বদের। অন্তত ১০ জন প্রভাবশালী মন্ত্রী যোগ দিয়েছিলেন অনুষ্ঠানে।
পীর হাবিবুর রহমান তার পূর্বপশ্চিম.নিউজে ৪৮ জন সংবাদকর্মীকে নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলেন, আর সারাদেশে প্রতিটি জেলায় প্রতিনিধি তো ছিলোই। কিন্তু যেভাবে ঝলকানি দিয়ে নিউজপোর্টালটি যাত্রা শুরু করেছিল, কাঙ্খিত আঙিনায় সেইভাবে ফুলকি ছড়াতে পারেনি। এর কারণ পীর হাবিবের বেহিসেবি পরিকল্পনা। পূর্বপশ্চিমের বার্তা বিভাগের শীর্ষপদগুলোতে তিনি মোটা বেতনে অভিজ্ঞ সাংবাদিকদেরই বেছে নিয়েছিলেন, তবে তাদের সিংহভাগই ছিলেন প্রিন্টমিডিয়ার।মাঠপর্যায়ে কাজ করে ওঠা আসা পীর হাবিবুর রহমান অনলাইন আর প্রিন্টভার্সনের কাজের ধারা যে ভিন্ন তা ধর্তব্যে আনেননি। এই সীমাবদ্ধতায় পূর্বপশ্চিম কাঙ্খিত পর্যায়ে পৌঁছাতে পারেনি। তবু নিউজপোর্টালটি যতটুকু আলো ছড়ায় তা পীর হাবিবের লেখনির গুণেই। পূর্বপশ্চিমে প্রকাশিত তার লেখা রাজনৈতিক বিশ্লেষণধর্মী কলামগুলোতে হাজার হাজার শেয়ার তার প্রমাণ। অবলীলায় পীর হাবিবুর রহমান দিয়েছেন বহু রাজনৈতিক পূর্বাভাস।
পরে তিনি পূর্বপশ্চিমের প্রধান সম্পাদকের দায়িত্ব ছেড়ে ফের বাংলাদেশ প্রতিদিনের স্বপদে বহাল হন, তবে নিজের প্রতিষ্ঠিত পোর্টালটির খোঁজখবর নিতেন সবসময়ই।
আমার দেখা এক আশ্চর্য মানুষ পীর হাবিবুর রহমান। কী দুর্দান্ত ছিল তার কানেকটিভিটি, সর্বত্র ছড়ানো তার শত শত সোর্স। যাদের নাম শুনলে আমাদের জিহ্বায় জড়তা ভর করে, রাষ্ট্রযন্ত্রের ভেতরে ও বাইরে সেইসব প্রভাবশালী মানুষের সঙ্গে যখন তখন অবলীলায় তাকে কথা বলতে দেখেছি। সর্বত্র সবার কাছে মনোযোগ পেতে দেখেছি। অনেক তার লেখাকে পক্ষপাতের কাঠগড়ায় দাঁড় করান। পক্ষপাত পীর হাবিবের অবশ্যই ছিল, সেটা বঙ্গবন্ধু আর মুক্তিযুদ্ধের প্রতি। তিনি ক্ষমতাসীনদের যেমন সমালোচনা করেছেন, তেমনি বিরোধীদের নিয়েও কথা বলেছেন। আমাদের অনেকেই তার লেখার ধরন না বুঝে তাকে দোষারোপ করি। যেমন: খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসা প্রসঙ্গে তার কলামের একটা লাইন- মানবতার বাতিঘর শেখ হাসিনা যদি তাঁকে বিদেশ পাঠিয়ে দেন অবাক হব না।’ উনি কিন্তু বিএনপি চেয়ারপারসনের বিদেশে চিকিৎসার অনুমতির পাওয়ার পক্ষেই লিখেছেন, যা হয়তো আমরা অনেকে ধরতেই পারিনি।
জীবনে বহুবার পীর হাবিবকে নোংরা সব ষড়যন্ত্রের শিকার হতে হয়েছে। কিন্ত বিপদের মুখেও দেখেছি অবিচল তাকে। তিনি বলতেন, মিথ্যা দিয়ে কখনো কাউকে ঢেকে ফেলা যায় না।
নিজের মনের ভাবনাপ্রকাশের নির্ভীক ক্ষমতা ছিল পীর হাবিবুর রহমানের। আর কোনো অনুমান বা ধারনার ভিত্তিতে নয়, তিনি লিখতেন সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে। আমি নিজেই স্বাক্ষ্য দিতে পারি, রাত দুপুরে বহুবার পেয়েছি পীর হাবিবের ফোন। কোনো ব্যক্তি বা ঘটনা সম্পর্কে ডিটেইল জানতে চান। কঠোর আদেশ, ১০ মিনিটের মধ্যে জানাও সব। বুঝতাম, তিনি লেখার ঘোরে আছেন। যতোটা সম্ভব বিস্তারিত জানানোর চেষ্টা করেছি সবসময়। তিনি যে জেনে বুঝে লিখতেন তা আমার চেয়ে আর কেউ বেশি ভালো জানে না।
পীর হাবিবুর রহমান ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মুম্বাই জাসলুক হাসপাতালে ভর্তি, এর আগেই তার সঙ্গে আমার যে কোনো কারণেই হোক তৈরি হয় দুরত্ব। বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্টেশনের অপারেশনে যাওয়ার আগের দিন হোয়াটস আপে কল দিলেন। বললেন, পূর্বপশ্চিমকে ভুলে গেলা? কি সব করতেছে ওরা খবর রাখবা।আর দৈনিকটার কি করলা? লেগে থাকবা। … ব্যাস, এতটুকুই। প্রায় তিনমাস পর রোগশয্যা থেকে ফোন দিয়ে তিনি এটুকুই বললেন। তার কণ্ঠস্বরে এমন কিছু ছিল এবং এমন কিছু থাকতো যা পালন আমার জন্য ছিল অনিবার্য, আমি তার অধীনে চাকরি করি আর নাই করি! তিনি বলতেন, অধিকার ও বিশ্বাস নিয়ে। তা পালন না করে আমি কি থাকতে পারি! ক্যানসারকে জয় করে ফেরার পর অনেকদূর এগিয়েছিল দৈনিক পূর্বপশ্চিমের কাজ। ডিক্লেয়ারেশন আগেই পাওয়া, ধ্রুব এষ তৈরি করে দেন লগো। ডামির কাজ শুরুর আগেই ফের অসুস্থ হয়ে পড়েন পীর হাবিব। আবারও থমকে যায় কাজ এবং এখনো থমকানোই আছে।
সংবাদের মধ্যে জীবনের শেষমুহূর্তেও আপদমস্তক ডুবে ছিলেন পীর হাবিবুর রহমান। দেশ-রাজনীতির সর্বশেষ গতিপ্রকৃতির দিকে ছিল তার দৃষ্টি, এমনকি করোনা আক্রান্ত হয়ে ল্যাবএইড চিকিৎসাধীন অবস্থাতেও। হাসপাতাল থেকে ফোন দিয়ে তিনি বললেন, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে কি হচ্ছে ডিটেইল জানাও। সব তথ্য নখদর্পনে নিয়ে তিনি লিখলেন, জীবনের শেষ কলাম। প্রকাশিত হলো বাংলাদেশ প্রতিদিনে ও পূর্বপশ্চিমে। সেখানে তিনি সরাসরি বললেন, ‘ভিসি ফরিদ সরে দাঁড়ান, নয় সরানো হোক।
সরাসরি এভাবে পীর হাবিব ছাড়া আর কি কেউ বলতে পারে!
করোনামুক্ত হলেও কিডনি জটিলতায় পীর হাবিবুর রহমান ভর্তি হলেন বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। তিনি ফোন করে পরদিন সকালে ল্যাপটপসহ যেতে বললেন, যেন যে বিষয়ে লিখবেন সেটার ডিটেইল তথ্য সার্চ করে তাকে দিতে পারি। ৩ ফেব্রুয়ারি সকালে বিএসএমএমইউ’র ৬১১ নং কেবিনে গেলাম। কিন্তু উনার শারীরিক অবস্থা তখন এতটাই নাজুক যে ভালোভাবে কথাই বলতে পারছিলেন না। শরীরটা ভালো লাগলে পরে ডাকবেন বলে জানালেন। পীর ভাইয়ের সঙ্গে সেটাই ছিল আমার শেষ দেখা।
পরে উনার পরিবারের মুখে শুনেছি ওইদিন বিকেলে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে অচেতন অবস্থায় যাওয়ার আগে পীর ভাই আমাকে খোঁজ করছিলেন, বিপুল আসছে… বিপুল আসছে? সেদিন তিনি কী বিষয়ে লিখতে চাইছিলেন, কী তথ্য জানতে চাইছিলেন? জানা হলো না, জানা হবে না কোনোদিনই। আর শুনবো না দরদমাখা কণ্ঠে পীর ভাইয়ের সেই হুকুম, দশ মিনিটের মধ্যে ডিটেইল আমাকে জানাও। লেখক: বিপুল হাসান. বার্তা প্রধান, পূর্বপশ্চিমবিডি.নিউজ
সংবাদ টি পড়া হয়েছে :
২৭৯ বার