পুরুষতন্ত্র বলতে কেন পুরুষ বোঝে?-বিথী হক
বিথী হক-
নিজের বাবা-ভাইকে ভাল প্রমাণ করতে হলেও নারীদের মানতেই হয়, ভাল পুরুষ অবশ্যই পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। নিজের ঘরের নারীদের যারা ডানা বিছিয়ে সকল অনিষ্ট থেকে নিষ্ঠার সাথে বুকের ভেতর লুকিয়ে রাখে। সব পুরুষরাই যে খারাপ নয় সে কথা তবে নারী ছাড়া ভাল আর কেই বা জানে! এই নারীরাই তো ছোটবেলা থেকে এক পুরুষকে বাবা বলে ডাকে, আরেক পুরুষকে দাদা ডাকে। এই পুরুষরাই তো ছোটবেলায় নারী যখন নারীই হয়ে ওঠে না তখন থেকেই চোখে চোখে রাখে। আদর করে লাল জামা গায়ে চড়িয়ে বিকেলবেলা নিয়ে হাঁটতে বের হয়। নতুন করে তাই ভাল পুরুষদের ভাল কাজ সমূহের কোন তালিকা করা ঠিক হবে কী না সে বিষয়ে সংশয় থাকতে পারে।
কিন্তু একইসঙ্গে ভাল পুরুষ ও খারাপ পুরুষের সহাবস্থান তো মেনে নিতে আমাদের কষ্ট হচ্ছে না। তাহলে এক নারী তার ‘স্বামী কালো হওয়ায় কুপিয়ে খুন’ করল বলে হৈ হৈ রৈ রৈ রবে নারীজাতিকে ফাঁসিকাষ্ঠে তুলে দিয়ে উপর্যুপরি শূল দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে জাতি হিসেবে নারীকে ‘প্রভু-অভক্ত’ বা অমানবিক বিশ্বাসঘাতক পোষাকুকুর বা কেউটের দলে ফেলে দেওয়া এখনও পর্যন্ত আমাদের কাছে এতখানি যৌক্তিক কেন মনে হয়?
যৌক্তিক কি এই জন্যই মনে হয় যে পুরুষের অপকর্ম তো প্রচুর, এতই প্রচুর যে ‘পুরুষ’ বললেই সব পুরুষ বুকে হাত রেখে ইয়া নফসি, ইয়া নফসি জপতে থাকে; তাই কয়েকটি নারী কর্তৃক সংঘটিত অপকর্ম আলোর মুখ দেখলে পাল্টা আঘাতে অন্তত নারীকেও ক্ষতবিক্ষত করা যায়? তীর-ধনুক হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা তীব্র পুরুষতন্ত্র এই একসময় এসে ‘অপকর্মে নারী-পুরুষের সমান অবদান’ খুঁজতে থাকে। তারাও তখন বিশ্বাস করতে থাকেন পুরুষরাই শুধু অপকর্ম করে না, নারীরাও এসব পারে (!)।
ভাল কাজের সংবর্ধনার জন্য ভাল পুরুষ, খারাপ কাজের জন্য খারাপ পুরুষ; এই বিভাজন সচেতনভাবে আমরা মেনে নিলেও নারীকে আমাদের সমাজ এখনো স্বেচ্ছায় ভাল বা খারাপ হওয়ার অধিকার দেয় না। ঘরের চৌকাঠে চেপে রাখা সিগারেট খাওয়ার ঘটনা ফাঁস হলে ‘ছেলেরা তো একটু আধটু খাবেই’ বলে স্বীকৃতি দিয়ে ফেলা ছেলের দিকে তখনও পুরুষতন্ত্র চোখ পিটপিট করে আড়চোখে তাকায় না। কিন্তু নারীদের সিগারেট খাওয়ার ঘটনা বাজারে বিকোনোর মতো অত্যন্ত রসালো আইটেম।
বন্ধুদের আড্ডায় একটা মেয়ের হাতে মদের গ্লাস যতখানি চাউর হয়, ততখানি কোন ছেলের যৌনপল্লীতে যাবার ঘটনায়ও হয় না। কেন হয় না? ভাল বা খারাপ দু’ধরণের পুরুষই পৃথিবীতে বিদ্যমান বলে যারা বুলি আওড়ান তখন একজন নারী আনাড়ি কার-পার্ক করলেই কেন বলা হয় ‘মাইয়া মাইনষের পার্কিং বোঝাই যায়, সব কাজ কী আর সবার জন্য!’ কেন একজন নারী খারাপ করলে তার দায় সব নারীকে নিতে হয়? কেন তখন কেউ বলে না, সব নারীই এক নয়!
সকল অধিকার ঝোলায় পুরে পুরুষতন্ত্র শুধু পুরুষকেই সবকিছু ঘটানোর অনুমতি কেন দিয়েছে? তারা পুরুষতন্ত্রকে নিজেদের ‘পুরুষ’ পরিচয়ের পুরুষকেই ধার দিয়েছে বলে? পুরুষতন্ত্র এতই বলশালী যে ছাতার মতো নিজেকে মেলে ধরে পুরুষের সকল অপকর্ম ঢেকে পুরুষকে শুধুমাত্র পুরুষরূপেই অধিষ্ঠিত করেছে। তাই একজন নারীর অপকর্ম পুরো নারীজাতির কাঁধে তুলে দিয়ে নির্ভার লাগে? খারাপ নারীদের কৃতকর্মে খারাপ বলার চেয়ে খাপখুলে শর-বাণে বিদ্ধ করতে পারলেই প্রকৃত বিজয়োলব্ধি ঘটে।
ছোটবেলায় সামাজিক বিজ্ঞান খুলে ফাইনাল পরীক্ষার রাতে ‘উপমহাদেশের সমাজব্যবস্থা পুরুষতান্ত্রিক’ মুখস্থ করতে যাদের একটুও খারাপ লাগেনি আজ তারাই নারীদের মুখে ‘পুরুষতন্ত্র’ শব্দ কানে আসা মাত্র হিংস্র হয়ে যায়? পুরুষতন্ত্র শুনলেই কি তার মানে এখন আর ছোটবেলার মতো অত্যন্ত নিরীহ একটা সমাজব্যবস্থার চিত্র অন্তর্চক্ষু দেখতে পায় না? এখন কি শুধুই নারী নির্যাতন দেখা যায়? নারীর অধিকার ছিনিয়ে নেওয়া মস্তবড় শকুনের পেটে বন্দী খাপখোলা নারীদের দেখা যায়? নাকি দেখা যায়, যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে ঢাল-তলোয়ার নিয়ে নারীরা শুধু পুরুষের মুণ্ডুচ্ছেদ করছে? কি দেখা যায় আসলে?
সত্যকে সত্য বলার মধ্যে এক ধরণের সাহসিকতা ঘাপটি মেরে থাকে, তবে সবার মধ্যে থাকে না। একে ধারণ করতে সাহস লাগে, শক্ত খোলস থাকা লাগে, নির্লজ্জ একসেট স্বরযন্ত্র লাগে। আমাদের আশেপাশের বেশিরভাগ পুরুষ যতই পুরুষসিংহ হিসেবে গোঁফে তা দিয়ে চুল স্পাইক করে পুরুষ সাজেন না কেন, সাহসী পুরুষ হতে এখনো বহুদূরের পথ বাকি।
নিজের মেয়েকে, ঘরের বউকে ঘরের বাইরে ঠেলে দিয়ে নিজের খুব চেনা পৃথিবীর পথ চিনিয়ে দিতে সাহস লাগে, শ্রদ্ধাবোধ থাকা লাগে, বিশ্বাস লাগে। পুরুষতন্ত্র পুরুষকে সাহস-শক্তি আর সামর্থ্য দিয়ে সমৃদ্ধ করেছেন ঠিকই কিন্তু নারীকে না থামিয়ে, তাদের চলার পথের চোরাবালি না হয়ে থাকার মতো দুঃসাহস মানসিক শক্তি দেননি।
বিথী হক : সাংবাদিক।