আহ্সান কবীর:প্রবাসে ঈদ স্মৃতি নিয়ে কেউ প্রশ্ন করলে আমার একটা গল্প মনে পড়ে। বাজারে পানির দরে ইলিশ বিক্রি হচ্ছে। এক ছোট ছেলে বাজারে এসেছে বাবার সঙ্গে। বাবা, ইলিশ মাছ নেওনা কেন? খালি চাপিলা আর পাঙাশের ভাগা কিনছো দেখি! বাবারে, ইলিশ মাছ অনেক দাম! কিসের অনেক দাম- একদম সস্তায় বেঁচতেছে তো। ওই যে লোকটা নিল কতো বড় ইলিশ তিন শ টাকায়! না বাপজান, আইজকা ইলিশের দাম বেশিই। বাবা, তুমি তো অনেক বোকা! ইশ্শ, কী সস্তায় কিনছে মানুষ ইলিশ… বাবা ছেলেকে অনেকটা জোর করে টেনে নিয়ে চলে আসেন মাছের বাজার থেকে। কিছুদিন পর ফের বাবা-ছেলে একত্রে বাজারে গেল। ইলিশের দাম এদিন ছিল আকাশ ছোঁয়া। বাপ এক হালি ইলিশ কিনে ফেললো কয়েক হাজার টাকায়।  ছেলে চেঁচিয়ে উঠলো: বাবা করছো কী তুমি! এত দামে ইলিশ কেনার দরকার নেই। ফেরত দাও। না, বাবা! আজ ইলিশ সস্তা মনে হচ্ছে। আমি তো চাই আরও কয়েকটা কিনতে।

বাবা! হয়েছে কী তোমার? সেদিন পানির দরে ইলিশ বিক্রি হলো তুমি কিনলে না ‘অনেক দাম’ বলে। আর আজ আগুনের দামে কিনে বলছো- ইলিশ সস্তা মনে হচ্ছে! বাবা, তোমার আসলে কী হয়েছে? বাবা স্মিত হেসে জবাব দিলেন, কিছু হয়নি। আমি সুস্থ আছি। পকেটে টাকা থাকলে ইলিশ সস্তাই লাগেরে, বাপ। প্রবাসে ঈদ প্রসঙ্গটাও আমার কাছে ওপরের গল্পটার মতোই। অর্থাৎ, প্রবাস জীবনে যখনি কোনো সুখের বা খুশির উপলক্ষ সৃষ্টি হয় তখনি ‘ঈদ ঈদ আনন্দ’ হয়। এর বাইরে প্রবাসে আড্ডাবাজ মজারু স্বভাবের বাঙালির ঈদ আসলে ঠিক ঈদের আনন্দকে উপভোগ করতে দেয় না। সাধারণ শ্রমিক শ্রেণির সিংহভাগ প্রবাসী বাংলাদেশির কাছে ঈদের মহৎ আনন্দ অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ আবেগ-অনুভূতির অনুরণন ঘটায়- তবে প্রবাস নামক ‘জেলখানায়’ তাদের কাছে ওই ঈদের আনন্দটা মনে হয় পলিথিনে ভরে রসগোল্লা চোষার মতো। ওই রসগোল্লার রসদার মজার কিছুই যেমন টের পাওয়া যায় না এতে তেমনি প্রবাসে ঈদের আনন্দও মোটেই ১০০% উপভোগ্য নয়।

আমি নিশ্চিত, আমার সঙ্গে সিংহভাগ প্রবাসী একমত হবেন যে আত্মীয়-পরিজন ছাড়া প্রবাসের ঈদ বে-শক পানসে স্বাদের হয়। তাই একদা ‘ঘরকুনো’বলে পরিচিত বাঙালি হাল আমলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ছে সত্য, কিন্তু ঈদ-পূজায়-বৌদ্ধপূর্নিমায়-বড়দিনে প্রবাসে তাদের ধর্মীয় উৎসবগুলো পানসেই থেকে যায়। এখানে ঈদের দিনের না হলেও প্রবাসে ‘ঈদের আনন্দ’জাগানিয়া একটি ঘটনা বলছি। আমি তখন উপসাগরীয় ছোট্ট দেশ কুয়েতের আলী আল সালেম এয়ার বেস-এ চাকরিরত। মাগুরার ছেলে কামরুল ছিল আমার সহকর্মী। একটু বোকাসোকা তবে জেদী স্বভাবের কামরুল আমাকে পছন্দ করতো, মান্যগণ্য করতো। ভালমন্দ বিষয়ে আসতো পরামর্শ নিতে। সেই কামরুল ছুটি কাছিয়ে আসায় একটি সনি টিভি কিনে আনলো। প্রবাসে প্রায় সবাই তাই করতো তখন। টিভিটা এনে ছুটির তারিখ ঘনিয়ে আসার আগ পর্যন্ত চালিয়ে দেখা হবে। এরমধ্যে কোনো সমস্যা দেখা দিলে তা বদলে আনা হতো।

তো কামরুলের টিভিতে সমস্যা ধরা পড়লো। সাউন্ড ঠিকমতো আসে না। কামরুল পরের সপ্তাহেই টিভি নিয়ে ছুট লাগালো কুয়েত সিটির জমজমাট বিপণী এলাকা মুরগাব-এ। কিন্তু নির্দিষ্ট দোকানে গিয়ে তাকে হতাশ হতে হলো খুব। সেলসম্যান  কিছুতেই টিভি বদলে দেবে না। একগুঁয়ে জেদি স্বভাবের কামরুল যথেষ্ট বিনয় দেখালো এবং অনুনয় করলো, মিনতি করলো- কিন্তু ইন্ডিয়ান সেলসম্যানের মন গললো না। তার বক্তব্য হচ্ছে, এক সপ্তাহ পরে টিভি বদলানোর নিয়ম নেই। সত্যি সমস্যা  থাকলে পরের দিনই আসা উচিৎ ছিল। এতদিন পর সমস্যার জন্য তারা দায়ী হবে কেন… ইত্যাদি ইত্যাদি বাঁকা-ট্যারা যত কুযুক্তি আছে তার সবই সে খাড়া করলো।

একগুঁয়ে জেদি স্বভাবের কামরুলের পক্ষে তা মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। তবে ঠিকমতো জবাব দিতে পারলো না। না আরবি বোঝে, না হিন্দি। নয়মাস কুয়েতে পার করেও আরবি শেখা হয়নি কামরুলের। আমরা প্রায় আড়াইশ বাঙালি একসেঙ্গে থাকতাম। কর্মস্থল আর বাসস্থান সর্বত্রই বাঙালির আধিক্য। তাই, অন্যদের ক্ষেত্রে যেমন দেখা যায় যেই দেশে থাকে সেই ভাষা তো শেখেই সঙ্গে অন্য কোনো প্রবাসী ব্যক্তির কাছ থেকে তার দেশের ভাষাটাও কিছুটা শিখে ফেলে, কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে তা সম্ভব ছিল না। আমি এমনও দেখেছি  প্রায় বছর পাঁচেক কুয়েতে কাটিয়ে দেয়ার পরও ‘জেন মানে ভাল আর ‘মো-জেন’ মানে ভাল না- এই ধরনের দুই চারটি শব্দ ছাড়া আরবি বোঝেন না- এমন গুরুরাও বহাল তবিয়তে চাকরি করে গেছেন। কারণ, আশপাশে সবই বাংলাদেশি ভাই-ব্রাদার। যাহোক, আসল কথায় ফিরি। সেলসম্যান কামরুলকে সাফ জানিয়ে দিল, টিভি ফেরত হবে না কারণ টিভি নষ্টের জন্য ‘ক্রেতাই দায়ী’।

কামরুল দশাসই শরীরের ছিল এবং বেশ শক্তিমানও ছিল। তার ওপরে তার বাড়ি বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় এলাকায়। একটি বিখ্যাত আরবি প্রবাদের বাংলাটা মনে পড়লো (আরবিটা জানা নাই, ইংরেজি ভার্সন শুনেছিলাম এটার)- অচেনা জায়গায় সিংহও কাপুরুষতা দেখায় (এ লায়ন ইজ অ্যা কাওয়ার্ড ইন অ্যা স্ট্রেঞ্জ ল্যান্ড)। সেই বাস্তবতায় কামরুল দোষযুক্ত টিভিসহ ফেরত এল ব্যারাকে। এ পর্যায়ে সে তার সমস্যা নিয়ে এল আমার কাছে।

টিভির সমস্যা কি?

সাইন্ডে ডিস্টার্ব।

জবাব শুনে আমি অন্য চিন্তায় মগ্ন হলাম। সহকর্মীরা মাঝেমধ্যেই কানাঘুষা করে, কামরুল কানে কম শোনে। এই কথনের সত্যমিথ্যা যাচাই করা হয় নাই আর এখন সেই কামরুল এসে আমাকে বলছে তার টিভিতে সাউন্ড কম! আমি মামলায় মনোযোগ দেওয়ার আগে টিভিটায় সতি সত্যি সমস্যা আছে কি না জেনে নেওয়ার চেষ্টা চালালাম। নাহলে হয়তো দেখা যাবে সমস্যাহীন যন্ত্র নিয়ে গিয়ে দোকানদারের কাছে উল্টো ‘মামু’ বনে আসতে হবে।  নির্ভরযোগ্য ‘গোয়েন্দারা’পাক্কা খরব দিলেন, আসলেও টিভিটায় সমস্যা আছে, সাউন্ডে একটু ডিসটার্ব তারাও খেয়াল করেছেন। আর বসে থাকা যায় না। আমি কামরুলকে বললাম, পরের বিষুদবার সাপ্তাহিক ছুটির দিনে টিভি বদল অভিযানে বের হবো।

সৌদি আর ইরাকি সীমান্তের জাহারা স্টেটে আমাদের ডেঁরা। সেখান থেকে টিভি নিয়ে কুয়েত সিটির মুরগাবে এসে গাড়ি থেকে নামলাম। সংশ্লিষ্ট দোকানে গিয়ে বিষয় উপস্থাপন করতেই চরম অসহযোগী রূপ দেখা গেল সেলসম্যানের। তার এককথা, টিভিতে যদি সমস্যাই ছিল তবে পরদিনই আসলে না কেন? ভাই, ওতো সরকারি চাকরি করে, থাকে অনেক দূর, সেখান থেকে পরদিনই আসা সম্ভব ছিল না। সেটা তোমাদের বিষয় (বো তুমহারা আপ্পুনকা মামলা হ্যায়) বলে সেলসম্যান আমাদের অবজ্ঞা শুরু করলো। তাকে ইংরেজিতে, ভাঙা আরবিতে এমনকি তার রাষ্ট্রীয় ভাষা হিন্দিতে যথেষ্ট বোঝানোর চেষ্টা করা হলো। কিন্তু সে ‘শত বোঝালেও বুঝবো না’মুড ধরে চেহারায় কঠোর একটা ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো আমাদের সামনে। একটু পর হয়তো বলবে- এবার বের হও দোকান থেকে।

কুয়েতের একটি সরড়কের পাশের দোকানপাট

আমি ফের আলোচনার সূত্রপাত করি- ভাই, টিভিটা বদলে দিলে তো তোমার কোনো সমস্যাই নাই। এত বড় কোম্পানি, আর তোমরা তো তাদের ডিলার মনে হচ্ছে, এমন বিষয় তো হয়েই থাকে- অনেকগুলো সেটের মাঝে দুয়েকটা নষ্ট থাকেই। সেটটা চালু করে দেখলেই তো বুঝতে পারবে যে এটায় সমস্যা আছে… এখন এটা দেখার সুযোগ নেই। সমস্যা থাকলে জিনিস নিয়ে পরদিনই আসতে হয়।

এটা কোথাকার নিয়ম, ভাই?

এটা কুয়েতের নিয়ম।

আমি কিছুটা উত্তেজিত হয়ে বলি- যে লোক মাত্রই কুয়েতে এসেছে, বা কেনাকাটা করে নাই কখনো এদেশে, সে এসব নিয়ম কী করে জানবে? এটা কি কোনো নিয়ম হলো? এটা তোমাদের বিষয়। তোমরা না জানলে আমার করার কিছু নেই! এই পর্যায়ে আর পারলাম না। তবে ঝগড়া বা মারপিট নয়, আস্তে করে কামরুলকে ইশারা করে বের হয়ে এলাম। বললাম, এখানে কাজ হবে না। লোকটা দুষ্ট প্রকৃতির। চলো… কামরুলের চেহারায় স্পষ্ট হতাশার ছাপ। সে আমতা আমতা করে বললো, স্যার… তাইলে এই টিভি নিয়াই…

না, টিভি বদলেই যাবো। তবে তার আগে থানায় যাবো।

থানায় কেন?

চল, গেলেই বুঝবে। এই বলে আমি ট্যাক্সি ক্যাব থামাই। কামরুল চেহারায় অসন্তুষ্ট ভাব নিয়ে উঠে বসে আমার সঙ্গে। মুরগাব থানার সামনে এসে গাড়ি থামতেই কামরুলকে টিভিসহ থানায় ঢুকতে বলে ব্যস্ত হয়ে ভেতরে ছুটি। আমি শুনেছিলাম এদেশে পুলিশ প্রশাসন খুব শক্ত। মোটকথা পুলিশকে সেখানে তখনো অপরাধীরা যমের মতো ভয় পেত। ওসি কোথায় বসেন জিজ্ঞেস করতেই সামনে থাকা পুলিশটি ইশারা করলো ভেতরের দিকে। ভেতরের রুমে দেখলাম থানা প্রধান পুলিশের এক ক্যাপ্টেন তার আসনে বসে আছেন আর সামনে কয়েকজন লোক দাঁড়িয়ে। বোঝা গেল কোনো বিবাদের ফয়সালা হচ্ছে। এখানে অনেক সমস্যাই থানা প্রধান তাৎক্ষণিক সালিশ বসিয়ে মীমাংসা করে দেন। ভেতরে তেমনি এক সালিশ চলছিল।

আমাদেরকে অপেক্ষা করতে বলা হলো। কিছুক্ষণ পর দুই পক্ষ চলে গেল। আমাদের ডাক পড়লো। আমি সালাম জানিয়ে ভেতরে ঢুকেই আমার পরিচয় জানালাম এবং ডিফেন্স মিনিস্ট্রির আইডি কার্ড বের করে এগিয়ে দিলাম তার দিকে। জবাবে ক্যাপ্টেনও সালাম দিয়ে স্মিত হেসে বসতে বললো। বিষয় কী? ক্যাপ্টেনের সঙ্গে আমার কথাবার্তা চলছিল ইংরেজিতে। আমি কামরুলকে দেখিয়ে বললাম, আমার এই বন্ধু টিভি কিনেছে… এরপর পুরো ঘটনা সংক্ষেপে বয়ান দিলাম। পুলিশ কর্তার চেহারায় বিস্ময় ফুটতে দেখলাম। সে আমাকে এবার আরবিতে বললো, ফি ওরাগা? অর্থাৎ দোকানের রিসিট/ক্যাশ মেমো আছে?

রাতের বেলায় কুয়েত সিটির মনোরম দৃশ্য

আমি এই আরবিটুকু বুঝতে পারিনি এটা বুঝতে পেরে সে ফের ইংরেজিতে বললো- ইউ হ্যাভ দ্য বেবার্স (পেপার্স)? আরবি বর্ণে ‘পি বা ‘প’বর্ণ  না থাকায় তারা পেপারকে বলে বেবার। আমি সঙ্গে সঙ্গে রিসিট খুলে এগিয়ে ধরলাম তার দিকে। ক্যাপ্টেন একহাতে রিসিট নিয়ে আরেক হাতে ফোনের বোতাম টিপলো। বোঝা গেল অপরপ্রান্তে ফোন তুলেছে কেউ। থানাওয়ালা শুধু দুটো শব্দ উচ্চারণ করলো- তা’ল মকফর (অর্থাৎ থানায় আয়) এবং ঝট করে রিসিভার রেখে দিল। এরপর তোমরা কোথায় থাক, কতদিন কুয়েতে আছ, কেমন লাগছে এমন তুই চার কথার মাঝে মিনিট দুয়েক সময়ের মধ্যেই দেখা গেল ত্রস্ত পায়ে অনেকটা দৌড়ের ভঙ্গিতে লম্বু এক মূর্তি ঢুকলো ঘরে। লম্বা দিলদাশা (জুব্বা) গায়ে দেওয়া এই সিরীয় (পরে জেনেছিলাম) ওই দোকানের মালিক।

পুলিশ তার দিকে তাকিয়ে ক্রুদ্ধ ভঙ্গি আর স্বরে শুরু করলো কঠিন আরবি ঝাড়ি। বিষয়টার জন্য আমরা প্রস্তুত ছিলাম না। সিরীয়র মুখচোখ শুকিয়ে পাংশু। কামরুলের দিকে ফিরে পুলিশ জিজ্ঞেস করলো- এর কাছ থেকেই টিভি নিয়েছিলে। না! প্রশ্ন না বুঝলেও সঠিক উত্তরই দিল কামরুল এবার সিরীয়র দিকে ফিরে ফের আরবি ঝাড়ি শুরু করলো পুলিশ বাবু। অর্থ যতটুক বুঝলাম তা হলো- হারামি কোথাকার! কুয়েতে এসে বাটপারি শুরু করেছিস? এক্ষনি তোর দোকানে তালা লাগিয়ে দেব (জানা মতে ওই সময় পর্যন্ত এ ধরনের ঘটনার ক্ষেত্রে কোনো দোকানে যদি পুলিশ তালা লাগিয়ে দিত তবে তা ফের খুলতে পঞ্চাশ হাজার দিনার জরিমানা গুণতে হতো। কুয়েতি পঞ্চাশ হাজার দিনারে কতো টাকা হয় এটা আশা করি সবাই অবগত)।

জানা গেল, দোকানের ওই ইন্ডিয়ানটা তার কর্মচারী। পুলিশের ঝাড়ির জবাবে সিরীয় মিনমিন করে সাফাই গাইলো এবং প্রতিশ্রুতি দিল, জিন্দেগানিতে এমন অপকর্ম আর হবে না। যদি এমন আর শুনি… সিরীয় চেহারায় চরম আতঙ্ক নিয়ে জবাব দিল- আর কক্ষনো হবে না হেন গোস্তাখি। এবার আমাদের দিকে ফিরে পুলিশ বললো- এখন তোমরা কী চাও? টিভিটা বদলে একই রকম আরেকটা টিভি চাও, নাকি অন্য কোনো মডেল চাও? কিংবা মাল ফেরত দিয়ে টাকাটা ফিরিয়ে নিতে পার? কেইফেক ইনতা (অর্থাৎ তোমাদের মর্জি)। আমি কামরুলকে বিষয়টি অনুবাদ করে শোনালাম। ঘটনার পরম্পরা আর চমকে ও ইতোমধ্যে যাকে বলে ‘টাসকি খেয়ে গেছে’।

বেসামালভাবে ও ক্যাপ্টেনের দিকে তাকিয়ে কোনোমতে শুধু বললো- আমি এই টিভিই অন্য আরেকটা চাই। তবে কথাটা সে সম্পূর্ণ বাঙলায় বললো। ক্যাপ্টেন অপ্রস্তুত হয়ে আমার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো। আমি তা অনুবাদ করলাম। এবার পুলিশকর্তা সিরীয়র দিকে ঘুরে বললো, এক্ষুনি এই টিভি বদলে দিবি। না হলে…

সিরীয় তড়োবড়ো করে ঘাড়-মাথা নেড়ে শতভাগ সম্মতি জানালো। সে এখান থেকে বেরোতে পারলে বাঁচে এটা বোঝা যাচ্ছে। এবার আমাদের দিকে ফিরে থানেদার ফের বললো, ও যদি এরপর কোনো উল্টাপাল্টা করে শুধু আমাকে একটা ফোন দিবা… আমরা তাকে অনেক ধন্যবাদ-কৃতজ্ঞতা জানিয়ে মাথা উঁচু করে থানা থেকে বের হয়ে এলাম বিজয়ী বেশে। কামরুলের পুরো বিষয়টা এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না। ওদিকে থানার বাইরে এসেই সিরীয় ক্ষণে ক্ষণে কামরুলকে জড়িয়ে ধরে চকাস করে একের পর এক গালে চুমু খেয়ে বলছে- হাবিবি, ইন্তা মুসলিম আনা মুসলিম… লেশ তা’লে মকফর, মুমকিন তেলিফুন… মানে বন্ধু তুমিও মুসলমান আমিও মুসলমান, কেন থানায় আসতে গেলা। আমারে একটা ফোন যদি করতা… এরপর আমাকেও জড়িয়ে ধরে তালগাছ… চুমু দিতে গেলে আমি অবশ্য পিছিয়ে যাই।

সিরীয় তার গাড়িতে তুলে আমাদের অন্য একটি দোকানে নিয়ে গেল এবং জানালো এটা তার আরেকটা দোকান। তখন পুলিশওয়ালার মতো সেও আবার জিজ্ঞেস করলো আমরা ওই টিভিই চাই নাকি অন্য কোনো পছন্দ আছে! তবে কামরুল একই লাইলি প্রেমে দিওয়ানার মতো ওই একই মডেলেই স্থির রইলো। কিন্তু বাক্স খুলে নুতুন টিভি বের করে সাউন্ড পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখা গেল- সেটাতেও প্রবলেম। এরপর আরেকটা। শেষমেষ হলো। তবে আমার ধারণা হলো, বাক্স খুলে বের করা প্রথমটার সাউন্ড আর যেটা আমরা শেষ পর্যন্ত নিলাম সেটার সাউন্ড একই ছিল। যাক, এটা আর কামরুলকে বোঝানো গেল না। সে এবার অনেকটাই আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছে। রীতিমতো সিরীয়কে ঝাড়িঝুড়ি মেরে কো বলছে। সিরীয়র মুখভঙ্গি পরাজিত পাকিস্তানি জেনারেল নিয়াজীর মতো। যত দ্রুত আত্মসমর্পণ পর্ব শেষ হয়- ততো বাঁচোয়া।

কিন্তু কামরুল গোঁ ধরলো যে দোকান থেকে টিভি কিনেছিল সে দোকানে যাবে। সিরীয় কাঁকুতি মিনতি করে বললো- ওইখানে আর তোমরা গিয়ে কী করবে! টিভি তো ফেরত পেলে, ভাই। ওই ইন্ডিয়ান সেলসম্যানকে আমি এক্ষুণি না করে দিচ্ছি গিয়ে। বোঝা গেলে ত্যাঁদর লোকটা বেয়াড়াপনা করে তার কফিলকেও বিরক্ত করে রেখেছিল।

শেষতক আমরা অনেকটা যেন দয়া দেখিয়ে সিরীয়কে বিদায় জানিয়ে টিভিসহ গাড়িতে উঠলাম। আস্তানায় ফিরতেই সবাই ঘিরে ধরলো আমাদের আর কামরুল যতটা না ঘটনা ঘটেছে তার চেয়ে কয়েকগুণ বাড়িয়ে-ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে আমাকে সুপার হিরো বানিয়ে বয়ান দিতে লাগলো সবার কাছে। সবার চোখে উৎফুল্ল ভাব। বিশ্বকাপে ইন্ডিয়া-পাকিস্তানকে হারানোর আনন্দ, যেন ঈদের আনন্দ। কেউ কেউ মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে কামরুলকে ছেড়ে এসে আমার কাছে ঘটনার সত্যাসত্য যাচাই করে গেল। প্রবাসে সাধারণত এমন ঘটনা ঘটে না। যাহোক, প্রবাসে বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে উপমহাদেশীয় অপর দুই দেশ ভারত আর পাকিস্তানিদের প্রকাশ্য-গোপন শত্রুতার মুখে পড়েননি এমন বাংলাদেশি কম আছে- এটা সবাই স্বীকার করবেন। মাঝে মাঝে কিছু ব্যতিক্রমী ঘটনা ঘটে অবশ্য যেখানে দেখা যায় তারা আমাদের সহযোগিতা করছে। কিন্তু গড়পরতা বাংলাদেশিদের সঙ্গে উল্লেখিত দুটি দেশের সিংহভাগ প্রবাসী সৎমায়ের মতোই আচরণ করে থাকে- কেন এর ব্যাখ্যা মনস্তত্ত্ববিদরা ভাল দিতে পারবেন। এমন ঘটনার দুই একটা ফিরিস্তি পরের বারে আবার দেওয়া যাবে। আজ এখানেই রাখি। সবাইকে ঈদ মোবারক।

 

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn