প্রাথমিক শিক্ষক অনুপস্থিতি : বছরে ৯০০ কোটি টাকা অপচয়
সরকারি প্রাথমিক শিক্ষাপর্যায়ের অনিয়ম ও দুর্নীতির ব্যাপক অভিযোগ জমা পড়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)। একই ধরনের অভিযোগ জমা আছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদফতরের কাছেও। শিক্ষকদের ক্লাসে অনপুস্থিতি, বদলি ও অবসর-ভাতা তুলতে কর্মকর্তাদের ঘুষ ও শিক্ষা মানের অবনতিসহ নানা অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিষয়টি স্বীকার করে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেন, ‘বিভিন্ন সময়ে চাকরির কর্মস্থল বদলি, অবসর-ভাতা তুলতে ঘুষ চাওয়াসহ নানা অভিযোগ এসেছে দুদকের কাছে।’ প্রতিকার হিসেবে অভিযুক্তদের ‘সংশোধনের’ জন্য ‘সতর্কতামূলক তিন মাস সময়’ দেয় দুদক। অন্যথায় নিয়ম অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দেন প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান।
অনুসন্ধানে জানা যায়, শিক্ষকদের বদলিতে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের দুর্নীতি ও অনিয়ম ঠেকাতে বদলির ক্ষমতা নিজ হাতে তুলে নেয় মন্ত্রণালয়। কিন্তু চলতি বছরের ৩ জানুয়ারি থেকে মন্ত্রণালয়ের সেই ক্ষমতা স্থগিত করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা ‘দি ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অন ফিন্যান্সিং গ্লোবাল এডুকেশন অপরচুনিটি’র (দি এডুকেশন কমিশন) প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষকদের গড়ে শতকরা ১৬ ভাগ বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থাকেন। এতে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ বছরে প্রায় ৯০০ কোটি টাকা। এতে প্রতি বছর গড়ে ২০ শতাংশ শিক্ষাঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। শিক্ষা খাতে বরাদ্দের বড় অংশই ব্যয় হয় শিক্ষকদের বেতন-ভাতা বাবদ। অথচ শিক্ষক অনুপস্থিতি ঠেকানো যাচ্ছে না নজরদারির অভাবে।’
শিক্ষা খাতে সুষ্ঠু বিনিয়োগ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন দেশে কাজ করে দি এডুকেশন কমিশন। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানসহ বিশ্বের ১৭টি নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশের প্রাথমিক শিক্ষা খাতের ওপর গবেষণা করে ‘দ্য লার্নিং জেনারেশন : ইনভেস্টিং ইন এডুকেশন ফর অ্যা চেঞ্জিং ওয়ার্ল্ড’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন সংস্থাটি প্রকাশ করে।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব (ভারপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ আসিফ-উজ-জামান বিদেশে থাকায় এ বিষয়ে তার বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। বক্তব্য জানতে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক আবু হেনা মোস্তফা কামালকে গতকাল বৃহস্পতিবার কয়েকবার ফোন করলেও তিনি ধরেননি।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী মনে করেন, ‘শিক্ষকদের বিদ্যালয়ে না আসার অন্যতম কারণ জবাবদিহির অভাব। এই অনুপস্থিত থাকাটা নতুন কিছু নয়। সমস্যাটা দীর্ঘদিনের। একে উদ্বেগজনক হিসেবে অভিহিত করেন তিনি।’
জানতে চাইলে প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ শামছুদ্দীন প্রতিদিনের সংবাদের কাছে দাবি করেন, ‘শিক্ষকদের শ্রেণিকক্ষে অনুপস্থিত থাকার জরিপটি সত্য নয়। কোনো শিক্ষক ডেপুটেশনে থাকলে তাকে অনুপস্থিত হিসেবে দেখানো যায় না।’
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর সূত্র জানায়, সুনামগঞ্জের ধরমপাশা উপজেলার খালিসাকান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আছিয়া খাতুন ছুটি না নিয়ে গত ১১ মাস ধরে বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত আছেন। দুবার কারণ দর্শানোর নোটিস দেওয়া হলেও তিনি এর কোনো জবাব দেননি। এতে ওই বিদ্যালয়ের পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে। এ রকম চিত্র দেশের অনেক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের।
গাজীপুর মহানগরীর উধুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় চলছে মাত্র দুজন শিক্ষক দিয়ে। বাকি দুজনের মধ্যে প্রধান শিক্ষক উম্মে নাজমা ও ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক জিনাত তাজমিন ছয় মাস ধরে বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত। মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, শিক্ষকদের অনিয়মের প্রশ্রয়দাতা জেলা ও উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা। মংলা উপজেলার শিক্ষা কর্মকর্তা শামসুন নাহার ও সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা গুরুদাস বিশ্বাসের বিরুদ্ধে এ রকম অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ আছে। ওই উপজেলার ৭০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। এগুলোর প্রায় দশজন শিক্ষক মাসের পর মাস ধরে অনুপস্থিত। শিক্ষকদের অনুপস্থিত থাকতে সহায়তাকারী সেখানকার দুই শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ঘুষ দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ আছে। প্রায় ১৫টি বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বদলির নামে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে।
পাবনার সাঁথিয়া উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কার্যালয়ের দুর্নীতির অভিযোগও আছে। উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার সঙ্গে যোগসাজশে কয়েক শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে অনুপস্থিত থাকেন বলে জানা গেছে। এ ছাড়া শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে প্রাক-প্রাথমিকের উপকর কেনা, টয়লেট মেরামত, পিআইডিপি-৩-এর আওতায় ছোটখাটো মেরামত, বই পরিবহন, বিদ্যুৎ বিল, টাইমস্কেল, শিক্ষক প্রশিক্ষণার্থী পাঠানো, শিক্ষক বদলিসহ বিভিন্ন খাত থেকে উৎকোচ নেওয়ার অভিযোগও উঠেছে তার বিরুদ্ধে।
অন্যদিকে গণসাক্ষরতা অভিযানের এক গবেষণা জরিপ মতে, পঞ্চম শ্রেণি সম্পন্ন করার পরও ৩২ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী সাক্ষরতা অর্জন করতে পারছে না। ‘এডুকেশন ওয়াচ প্রতিবেদন-২০১৬’ শিরোনামে এ গবেষণার ফল প্রকাশ করে সংস্থাটি। ‘অ্যানুয়াল প্রাইমারি স্কুল সেন্সাস’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদনে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর জানায়, প্রাথমিক শিক্ষা খাতে প্রতি ৪৬ শিক্ষার্থীর বিপরীতে একজন শিক্ষকের উপস্থিতি নিশ্চিত করা গেছে দেশের ৬১ দশমিক ৮ শতাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এখনো পর্যাপ্তসংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া যায়নি দেশের ৩৮ শতাংশ বিদ্যালয়ে। অধিদফতরের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, সারা দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রায় দুই কোটি শিক্ষার্থীর বিপরীতে শিক্ষক আছেন পাঁচ লাখের মতো।