ফেসবুকজুড়ে ফরহাদ মজহারকে উদ্ধারের দাবি
কবি, কলামিস্ট ফরহাদ মজহারের অপহরণের ঘটনায় ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে। সুস্থভাবে তাকে তার পরিবারের সদস্যদের হাতে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি করেছেন ফেসবুক ব্যবহারকারীরা। ঘটনার জন্য কেউ কেউ আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর দিকে আঙুল তুলেছেন। আবার ফরহাদ মহজারকে উদ্ধারে অনেকেই এই বাহিনীর সক্ষমতার ওপর আস্থাও প্রকাশ করেছেন। ফরহাদ মজহারের সঙ্গে মতের মিল কিংবা অমিল প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে সার্বিকভাবে তার মুক্তি দাবি করেছেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার লোকজন। অপহরণকারীদের বিচার চেয়ে কবি, লেখক, চিন্তক ফরহাদ মাজহারের অপহরণের প্রতিবাদ জানিয়েছেন অনেকে।
৩ জুলাই সোমবার সকালে ফরহাদ মজহারকে অপহরণ করা হয়েছে এই অভিযোগ করে তার পরিবারের সদস্যরা জানান, ভোর চারটার দিকে ফোন আসলে তিনি বাসা থেকে বেরিয়ে যান। এরপর থেকে আর তার সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না।
তার নিখোঁজের খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে ফেসবুকে।
যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক আলী রীয়াজ লিখেছেন,
ফরহাদ মজহারকে উদ্ধারের দায়িত্ব সরকার ও রাষ্ট্রের- এর ভিন্ন আর কিছু বলা এই অপহরণের প্রতি পরোক্ষ সমর্থন| এই অপহরণের ঘটনা কেবল উদ্বেগের বিষয়ই নয় এটি হচ্ছে বাংলাদেশে স্বাধীন চিন্তা প্রকাশের পথে যে ভয়াবহ বাধা উপস্থিত তার সর্বশেষ প্রমাণ৷ ‘অপহরণ’, ‘গুম’ ও বিচার বহিৰ্ভূত হত্যা স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হওয়ার কারণেই এই ‘অপহরণের’ ঘটনা সম্ভব হয়েছে৷
ফরহাদ মজহারের ‘অপরহণ’র প্রতিবাদ জানিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক আবদুল্লাহ আল মামুন লিখেছেন,
একমাত্র দাবি হওয়া উচিত: গুমখুন বন্ধ করেন, ফরহাদ মজহারকে ফেরত দেন। মুক্তিপণ দাবি বা উদ্ধার চেষ্টার গল্প একেবারেই ফালতু কথা- এসব গল্পে কান দেবার অর্থ আপনি এখনও নির্বোধ আছেন। আর মজহারের সাথে ‘মতের মিল ছিল না’ বা ‘পছন্দ করতাম না’- এইরকম ইতর গল্প দেওয়াও আপনারা বন্ধ করেন। কারণ আমরা মতের মিল ও অমিলের পরিসেরই সবসময় বসবাস করি।
সাংবাদিক মাসকাওয়াথ আহসান লিখেছেন,
২০১৭ সালে ভিন্নমতের মানুষকে তুলে নিয়ে যায় যারা; বা এই খবরে পুলকিত হয় যারা; এদের অপরাধটা ১৯৭১ সালের মানবতাবিরোধী অপরাধের মতোই।
প্রথম আলোর ডেপুটি ফিচার এডিটর জাহীদ রেজা নূর লিখেছেন,
কোনো অপহরণের ঘটনাই সুসংবাদ নয়।
পক্ষ কিংবা বিপক্ষ নয়, সকল চিন্তার স্বাধীনতা দাবি করে সাংবাদিক রাখাল রাহা ফেসবুকে লিখেছেন,
আমি আমার চিন্তার পক্ষের শুধু নয়, চিন্তার সকল প্রতিপক্ষের জীবনের নিরাপত্তা চাই। পক্ষ-বিপক্ষ নির্বিশেষে সবার সব ধরনের অপরাধের আইনি প্রক্রিয়ায় বিচার চাই। আমি কবি, লেখক, চিন্তক ফরহাদ মাজহারের অপহরণের প্রতিবাদ জানাই। একজন লেখক ও সাধারণ নাগরিক হিসাবে আমি তার আশু মুক্তি দাবি করি।
‘সরকারি বাহিনী ফরহাদ মজহারকে ‘অপরহণ’ করতে পারে বেশিরভাগ মানুষের এমন সন্দেহ আছে’ উল্লেখ করে আইনজীবী ইমতিয়াজ মাহমুদ ফেসবুকে লিখেছেন,
ফরহাদ মজহারকে কি সরকারের লোকজন তুলে নিয়ে গেছে? বেশিরভাগ মানুষের সন্দেহের তীর সেদিকেই। এবং এইরকম সন্দেহের সঙ্গত কারণ আছে। কারণ ভিন্নমতের লোকজনকে হেনস্তা করা, তুলে নিয়ে যাওয়া, গুম করে দেওয়া এইসব ঘটনা এই সরকারের সময় ঘটেছে। এটা যদি সত্যি হয়- সে বড় ভয়ংকর ঘটনা হবে। আর এটা যদি সত্যি নাও হয়, তবুও সরকারের স্বার্থেই সরকারের উচিৎ সকল শক্তি প্রয়োগ করে ফরহাদ মজহারকে উদ্ধার করা।
সরকার করুক আর যেই করুক, ভিন্নমতের জন্যে হোক বা মুক্তিপণের জন্যেই হোক- একজন চেনাজানা বিশিষ্ট লোক এইরকম কিডন্যাপ হবে এটা দেশের জন্যে কোনো ভালো চিত্র না। ফরহাদ মজহারকে উদ্ধার করুন, প্লিজ।
সাংবাদিক শরীফুল হাসান ফেসবুকে লিখেছেন,
রাখ-ঢাক না করেই বলি ফরহাদ মজহার সাহেবকে অামি অপছন্দ করি। তাই বলে তার নিখোঁজ হওয়াটা মেনে নিতে পারি না। অাশা করি পুলিশ দ্রুত তাকে উদ্ধার করবে।
বাংলাদেশের আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি আস্থা এবং সক্ষমতার কথা জানিয়ে সাংবাদিক প্রভাষ আমিন লিখেছেন,
বাংলাদেশের পুলিশের দক্ষতার ওপর আমার আস্থা আছে। জনকণ্ঠের সামনে মধ্যরাতে দামি গাড়ি থেকে ছোঁড়া গুলিতে দুই নিম্নবিত্তের মৃত্যুর প্রায় ক্লুলেস ঘটনার রহস্য উদঘাটন করেছে তারা কোনো চাপ ছাড়াই। বনানী ঘটনার আসামিদের ধরেছে দ্রুতই। পুলিশের বিভিন্ন বাহিনী র্যাব, সোয়াত, কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের নানা সাফল্যের গল্প সবার মুখে মুখে। এই সাফল্যে কাহিনী আরো লম্বা হোক চাই। চাই ফরহাদ মজহারের সুস্থ স্বাভাবিক প্রত্যাবর্তন। মত-ভিন্নমত, পক্ষ-বিপক্ষ সব মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের।
বিএনপি নেতা ওয়াহিদুজ্জামান ফেসবুকে লিখেছেন,
ফরহাদ মজহারকে মুক্তিপণের জন্য কিডন্যাপ করা হয়েছে’ এমন গল্প বিশ্বাস করতে হলে অবশ্যই ছদ্মবেশী বা প্রকাশ্য আওয়ামী লীগার হতে হবে। মলম পার্টিও মুক্তিপণের জন্য উনার মতো একজন সাধারণ বেশভুষার মধ্যবিত্ত কবি-সাহিত্যিককে কিডন্যাপ করবে না এবং কিডন্যাপ করে এত বেশি পরিমাণ টাকা দাবি করবে না। যারাই এই কিডন্যাপের প্লট সাজিয়েছে, তাদের স্ক্রিপ্ট খুবই দুর্বল; বন্দুকযুদ্ধের মতোই।
অশিক্ষিত মলম পার্টির লোকজনও কাউকে কিডন্যাপ করলে তার মোবাইল প্রথমে বন্ধ করে দেয়, যেন সেই মোবাইল দিয়ে তাদের ট্র্যাক করা না যায়। ফরহাদ মজহারের মোবাইল খোলা ছিল তাকে অপহরণের পরও। সেই মোবাইল থেকে তাকে দিয়ে কল করিয়ে ৩৫ লাখ টাকা মুক্তিপন চাওয়া হয়েছে। যেন বিষয়টা মুক্তিপনের জন্য সাধারণ কিডন্যাপ হিসেবে রঙ দেয়া যায়। এরপর সেই মোবাইল শেষ পর্যন্ত খুলনায়; যেখানে র্যাব-পুলিশ অভিযান চালাচ্ছে কিন্তু পাচ্ছে না।
অথচ সেই একই মোবাইল থেকে সর্বশেষ ঘণ্টা খানেক আগেও ফরহাদ মজহার ফরিদা আপাকে ফোন দিয়ে কথা বলেছেন। জানিয়েছেন যে সারাদিন তার চোখ বেঁধে রাখা হয়েছিল এবং সন্ধ্যার পর খুলে দেয়া হয়েছে। জানতে চেয়েছেন, টাকা জোগাড় হয়েছে কিনা।
এভাবে বারবার কথা বলার পরও পুলিশ সেই ফোন ট্র্যাক করে অপহরণকারীদের ধরতে পারছে না? নাকি ইচ্ছে করেই ধরছে না? কেবলমাত্র বিষয়টিকে ‘মুক্তিপনের জন্য অপহরণ’ এই থিওরিকে বিশ্বাসযোগ্যতা দেবার জন্য। সারাদিনের সময়ক্ষেপণ কী কেবলই উনাকে অপহরণকারীদের সুযোগ করে দেবার জন্য, যেন অপহরণকারীরা উনাকে সন্ধ্যার পর তাদের কাঙ্খিত গন্তব্যে নিয়ে যেতে পারে।