ঢাকা: “অটোলাইক শেখানো হয় বা নিজের পোস্টে ইচ্ছা মতো লাইক নিয়ে দেয়া হয়”। বিবিসির ফেসবুক পাতার একটি খবরে এমন কমেন্ট করেছেন এক ব্যক্তি। তিনি নিজেকে ‘লাইকের রাজা’ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন এবং ফোন নম্বরটিও দিয়ে দিয়েছেন, যাতে তার সাথে ‘অটোলাইক’ শিখবার জন্য যোগাযোগ করা যায়। আরেকজন লিখেছেন, ১৮ ঘণ্টা ‘এক্টিব’ থাকি আর সব সময় লাইক কমেন্ট করার চেষ্টা করি। চাইলে ‘এড’ করতে পারেন।সোশ্যাল মিডিয়া জায়ান্ট ফেসবুক সম্প্রতি একটি শুদ্ধি অভিযান শুরু করেছে, যেখানে ফেক বা ভুয়া একাউন্ট তারা বাতিল করছে।  এই সপ্তাহেই জানা গেছে সংখ্যার দিক দিয়ে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ফেসবুক ব্যবহারকারীর শহর ঢাকা।

কিন্তু ফেসবুক কর্মকর্তা শবনম শেখের বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা এএফপির খবরে বলা হয়েছে বিশ্বের যেসব দেশে ভুয়া ফেসবুক অ্যাকাউন্টের প্রাচুর্য সবচাইতে বেশী, তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বিবিসি বাংলার ফেসবুক পাতার এক একটি পোস্টে একসময় এই ‘লাইকের রাজা’ বা ১৮ ঘণ্টা ‘এক্টিব’-এর মতো বহু কমেন্ট দেখা যেত, কিন্তু আজ এ ধরনের অপ্রাসঙ্গিক এবং বিজ্ঞাপনী কমেন্ট কিছু কম পাওয়া গেল। বোঝাই যাচ্ছে, শুদ্ধি অভিযানের কিছুটা প্রভাব এখানে আছে। কিন্তু কোন কোন ক্ষেত্রে ‘ভাল’ একাউন্টও এই শুদ্ধি অভিযানের কবলে পড়ছে বলে জানা যাচ্ছে। ধানমন্ডির তাসলিমা চৌধুরী গত শনিবার দুপুরে আবিষ্কার করেন তার দশ বছরের পুরনো ফেসবুক অ্যাকাউন্টটি গায়েব হয়ে গেছে।

আজ তিন দিন ধরে বহু চেষ্টা করছেন তিনি, কিন্তু উদ্ধার করতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত না পেরে নতুন একটি অ্যাকাউন্ট খুলেছেন। তাসলিমা চৌধুরী বলছিলেন, “২০০৭ সাল থেকে অ্যাকাউন্টটা আছে। অনেক পুরনো মেমোরিজ। অনেক ছবি। সব নেই হয়ে গেলো। এটাই খারাপ লাগছে”। একই দিনে তার স্বামী তাজুল ইসলামও খুইয়েছেন তার সাত বছরের পুরনো ‘আসল’ ফেসবুক অ্যাকাউন্টটি। তিনিও বাধ্য হয়েছে নতুন অ্যাকাউন্ট খুলতে। কিন্তু বহাল তবিয়তে আছে ‘লাইকের রাজা’র অ্যাকাউন্ট। তার কমেন্টে উল্লেখিত নাম্বারটিতে ফোন করি। অপর প্রান্তে ফোন তুলেই এক ব্যক্তি শুধালেন, “অটোলাইক শেখার জন্য ফোন দিয়েছেন?” জবাবে হ্যাঁ বলতেই তিনি গড়গড় করে অটোলাইক কিভাবে করতে হয়, এর সুবিধা-অসুবিধা-ব্যয় ইত্যাদি আমাকে বলে গেলেন। তিনি বলছিলেন, তাকে বিকাশের মাধ্যমে মোটে দেড়শ টাকা পাঠিয়ে দিলেই তিনি ওয়েবসাইটের একটি টুল বানিয়ে দেবেন, যে টুলটি ব্যবহার করার পর ফেসবুকে কোন স্ট্যাটাস কিংবা ছবি দিলেই তাতে বৃষ্টির মতো ‘লাইক’ পড়তে শুরু করবে। তিনি বলছিলেন, এগুলো সব আসল অ্যাকাউন্ট থেকেই আসবে এবং এর কোন সীমা থাকবে না।

জানতে চাই এই লাইক পেয়ে লাভ কি? জবাবে তিনি বলেন, লাভ এটুকুই আপনার একটা ছবিতে দশ-বিশ হাজার লাইক থাকবে, যখন অন্য কারো ছবিতে থাকবে দশ-বিশ-একশটা। তিনি আরো বলছিলেন, আজ এখন পর্যন্ত তিনজন গ্রাহককে ‘অটোলাইক’ শেখানোর সেবা দিয়েছেন। গত একমাসে তার গ্রাহক ছিল ছয় শতাধিক। তিনি আরো বলছিলেন, এই ফেসবুক অ্যাকাউন্টটি তার নয়, তার বড় ভাইয়ের। তারা রাজশাহীতে থাকেন এবং দুভাই মিলে এই একটি অ্যাকাউন্ট দিয়ে ব্যবসা চালান। তার নিজের নামে কোন ফেসবুক অ্যাকাউন্ট নেই, তবে অনেকগুলো ‘ভুয়া’ অ্যাকাউন্ট রয়েছে তার। তার ভুয়া অ্যাকাউন্ট কতগুলো? জানতে চাইলে বলেন, “আইডির হিসেব নাই। আমি নিজেও কইতে পারব না”। তবে একটা ধারণা দিলেন যে তার ভুয়া আইডির সংখ্যা এক থেকে দেড়শ’র মধ্যে হতে পারে। তিনি বলছিলেন, “আমার এই অ্যাকাউন্টগুলো ফেসবুক বন্ধ করতে পারবে না। বন্ধ করলেও রিকভার করতে পারবো। কারণ প্রতিটি অ্যাকাউন্টের স্বপক্ষে তথ্য প্রমাণ আছে। আর প্রমাণ দাখিল করলেই ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ফিরিয়ে দিতে বাধ্য”। ফেসবুক বলছে, শুদ্ধি অভিযানের মাধ্যমে তারা ভুয়া অ্যাকাউন্ট পরিচালনার একটি আন্তর্জাতিক চক্রের কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করেছে, যারা বাংলাদেশকেও তাদের প্লাটফর্ম হিসেবে ব্যবহার করতো। এই ‘লাইকের রাজা’ও এই চক্রের সদস্য কি না, সেটা নিশ্চিত নয়, কিন্তু লাইক কেনা-বেচা বা অটোলাইক বাণিজ্য করে এমন বহু মানুষ বাংলাদেশে রয়েছে, যাদের বিজ্ঞাপনী কমেন্ট বিভিন্ন ফেসবুক পোস্টেই পাওয়া যায়। ফেসবুকে অনেক ই-কমার্স পাতা কিংবা সেলেব্রিটিরা তাদের লাইকের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য এদের সাহায্য নেয় বলে প্রচলিত আছে। ফেসবুকের মাধ্যমেও লাইক সংগ্রহ করা যায়, কিন্তু এই ‘ফেসবুক বুস্ট’ সেবা ব্যবহার করার জন্য যে পরিমাণ ডলার খরচ করতে হয়, সেটা অনেকেই এড়াতে চান এবং শরণাপন্ন হন স্বল্প ব্যয়ের ‘লাইকের রাজা’র। আর এই সুযোগে বাংলাদেশের হাজারো ‘লাইকের রাজা’ ফেসবুকে খুঁজে নিয়েছেন অবৈধ এবং বিকল্প এক কর্মসংস্থান।–বিবিসি।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn