অরুণ কুমার বিশ্বাস

আমাদের রকিবুল বিশিষ্ট ফেসবুক বিশেষজ্ঞ, অন্তত নিজেকে সে তাই মনে করে। এই বস্তুর মন-মগজ নাড়ি-নক্ষত্র সব তার মুখস্থ। শুরুটা অবশ্য তার ঘোল খেয়েই হয়েছিল। জনৈক চালিয়াত ফেসবুকে তাকে নুন-মসলা ছাড়া ঘোল খাইয়েছে। প্রোফাইলে রগরগে চিত্তাকর্ষক মেয়েলি ছবি দেখে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায় রকিবুল। অমনি সাথে সাথে অনুরোধ লুফে নেয় সেই যুবতী। রাত জেগে সে যুবতীর সাথে মেসেঞ্জারে টুঙ টুঙ কথোপকথন করে। দিন যায়, ফেসবুকে কেস খেতে থাকে রকিবুল। ছবির মেয়ে তাকে সুপারসনিক স্পিডে টানে, দিশেহারা হয়ে যায় রকিবুল। সে দেখা করতে চায়, কিন্তু মেয়েটি চায় না। উঁহু এখন নয়, পরে। রহস্য কী! কিছুই না, মহিলা পর্দানশীল, পরপুরুষের মুখ দেখা বারণ। হঠাত্ ছবির মেয়ে বলল, তুমি বরং এক কাজ করো। ভাড়া বাবদ কিছু টাকা পাঠাও। দেখি আসতে পারি কিনা। দুম করে হার্টবিট মিস হয় রকিবুলের। সে আসছে। সে বুল বা ষাঁড়ের মতো হন্যে হয়ে টাকা খোঁজে। গাড়ি ভাড়ার টাকা পাঠালে মেয়ে এবার সাজুগুজুর টাকা চায়। অর্থাত্ পারলার খরচ। বিকাশ নম্বরে একের পর এক টিউশনের টাকা জমা হয় রকিবুলের। কামায় সে, খায় অন্যে। অবশেষে হাজারদশেক নিকাশ করার পর হঠাত্ জানতে পারে ছবির মেয়েটি মেয়ে নয়, সে ছেলে। ফেসবুকে কেস খেয়ে রকিবুলের সেই যে শিক্ষা হলো, এখন আর পারতপক্ষে সে ওই পথ মাড়ায় না। ভারচুয়াল জগত্ মানে মিথ্যার ফুলঝুরি এটুকু সে বুঝে গেছে। কিন্তু রকিব বুঝলেও আমরা এখনো অনেকেই নাদান রয়ে গেছি। এমনও কিছু আপদ জুটেছে যে তাদের স্ট্যাটাসের অত্যাচারে ফেসবুকে ঢোকাই মুশকিল। সাতসকালে উঠেই দেখি একজন স্ট্যাটাস ছেড়েছে- ভীষণ দাঁতে ব্যথা। আরে ভাই তোমার দাঁতে ব্যথা তো আমি কী করবো!
রকিবুল এখন বেশ চালাক। ফেসবুক সে পছন্দ করে না, কিন্তু ছেড়েও থাকতে পারে না। একেলা মন, নীড়হারা পাখি বা বোলতার কামড় টাইপ ফেসবুক আইডি থেকে রিকোয়েস্ট এলে সে ভুলেও গ্রহণ করে না। আবার কেউ কেউ প্রোফাইল পিকচার হিসেবে নিজের ছবি না দিয়ে ফুল, পাখি বা নায়ক-নায়িকার জড়াজড়ি করা ছবি দেয়। এদের থেকেও কুড়ি হাত দূরে থাকে রকিবুল। সে জানে এগুলো ফেক আইডি। একটা কথা এখন প্রায়ই শোনা যায়, ফেসবুকে ভাইরাল। মানে ভাইরাসের মতো সবখানে ছড়িয়ে পড়ছে খবর। এতে ভালো-মন্দ দুটোই হয়। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী জনতা যেমন গর্জে ওঠে, তেমনি কোনো কোনো ক্ষেত্রে আসল ঘটনা না জেনেই প্রতিবাদী পাবলিক কারো কোমর থেকে পাতলুন খুলে নেয়। ক্যামেরা ট্রায়ালের মতো একে বলে ফেসবুক-ট্রায়াল। এর পরিণাম ভয়াবহ। অপমান সইতে না পেরে কেউ কেউ আত্মহনন অব্দি করে ফেলে।
মগজে ঘিলু না থাকলে ফেসবুকে ঠকে যাবার সম্ভাবনা উজ্জ্বল। যারা কিনা এখন দুগ্ধপোষ্য শিশুর মতন সরল তারাই কেস বেশি খায়। প্রোফাইল ছবি দেখে প্রেমে পড়লে কাম তামাম। ম্যাক্সিমাম ছবি এডিটিং হয়ে আসে, তার আগে নাকে-মুখে উত্তমরূপে চুনকাম। পারলার আর এডিটিং রুম হয়ে যেসব ছবি বেরোয় তার টোয়েন্টি পারসেন্ট খাঁটি মানলেও ধরা খাবার সম্ভাবনা থাকে। আর নাদান যারা তারা তো মেয়ের প্রো-পিক দেখেই বেমক্কা প্রেমে পড়ে যায়। তারপর যদি কখনো মুখোমুখি দেখা হয়, তখন চক্ষু ছানাবড়া। তারপর ধরুন পোস্ট এলো, তিনি অমুক সময় ফেসবুকে লাইভ থাকবেন! সঙ্গে থাকবেন অমুক এন্ড তমুক। তার মানে এতক্ষণ তিনি মৃতপ্রায় ছিলেন বা কফিনে! সদ্য জেগে উঠে ফেসবুকে এলেন। এসব লাইভ কাহিনি না যায় দেখা, না টপকানো। চোখের সামনে তাদের উদ্ভট কর্মকাণ্ড গায়ে শুধু জ্বালা ধরায় না, বিবমিষার উদ্রেক করে। ফেসবুক পেজে যাচ্ছেতাই ছবি আপলোড করা স্বাস্থ্যের পক্ষে হানিকর। অনেকেই এমনভাবে ঘর-গৃহস্থালির ছবি দেয় যেন এটা একটা গারবেজ। যা খুশি তাই করা যায়। এরা ভুলেও ভাবে না যে তার এই আনাড়িপনা অন্যে দেখছে এবং তার সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা করছে। প্রচণ্ড জ্বর, মাথা তুলতে পারছে না, অথচ ফেসবুকে সেই অরুচিকর ছবি দিব্যি পোস্ট দিচ্ছে। হাসপাতালের বেডে শুয়ে মরণোন্মুখ ছবির পোস্টও দেখি মাঝে মাঝে। মনে হয় নির্ঘাত্ এদের মস্তিষ্কের তার ছেঁড়া। এসব দেখেটেখে বেচারা রকিবুল ফাইনাল পোস্ট দিল— ফেসবুক তোমায় দিলাম আজকে ছুটি। ছবি যত আছে, স্মৃতিগুলো সব ছিঁড়ে করি কুটিকুটি!
 লেখক : কথাসাহিত্যিক ও রম্যলেখক
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn