বঙ্গবন্ধু হঠাৎ করে জাতির পিতা হননি
রামেন্দু মজুমদার-
মাঝে মাঝে অবাক হয়ে ভাবি মাত্র ৫৫ বছরের জীবনে এতটা অর্জন কী করে সম্ভব হলো? একটা জাতিকে ধীরে ধীরে আত্মমর্যাদা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের জন্যে সচেতন করে বছরের পর বছর জেল-জুলুম সহ্য করে গণতান্ত্রিক পথে স্বাধীনতার লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার ডাক দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। তারপর তাঁর নামে নয় মাস ধরে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। পাকিস্তানিদের ফাঁসির মঞ্চ থেকে তিনি বিজয়ী বীরের বেশে মাতৃভূমিতে ফিরে এসেছেন। কৃতজ্ঞ জাতি তাঁকে জাতির পিতার মর্যাদা দিল।
পৃথিবীতে খুব কম নেতাই আছেন যারা তাঁদের জীবদ্দশায় তাঁদের আন্দোলনের সাফল্য দেখে যেতে পেরেছেন। বঙ্গবন্ধু সেই সৌভাগ্যবানদের একজন যিনি একটা জাতিকে স্বাধীনতার আন্দোলনে একতাবদ্ধ করতে পেরেছিলেন এবং চূড়ান্ত বিজয় এনে দিয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধু কিন্তু হঠাৎ করে জাতির পিতা হয়ে যাননি। আমরা যদি তাঁর আত্মস্মৃতিমূলক গ্রন্থ দুটি ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’ পাঠ করি, তবে দেখব সারা জীবন ধরে কত সংগ্রাম ও নির্যাতনের মধ্য দিয়ে তাঁকে চলতে হয়েছে। পারিবারিক বন্ধনকে উপেক্ষা করে দেশের জন্যে, দেশের গরিব-দুঃখী মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের জন্যে কাজ করে গেছেন তিনি।
বাঙালির চরম দুর্ভাগ্য, বঙ্গবন্ধু স্বাধীন দেশকে গড়ে তোলার জন্যে মাত্র সাড়ে তিন বছর সময় পেয়েছিলেন। একটা যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশে শূন্য থেকে যাত্রা শুরু করতে হয়েছিল। তবু আজ যখন আমরা যেকোনো উন্নয়ন পরিকল্পনা হাতে নিই, কোনো নতুন কিছু করার উদ্যোগ নিই, তখন দেখতে পাই বঙ্গবন্ধু ওই অল্প সময়েই এসব বিষয়ে ভেবেছিলেন এবং কাজেরও সূচনা করেছিলেন কোনো না কোনো ভাবে। তাঁর দূরদর্শিতার প্রতি বার বার অবনত হতে হয়।
১৯৭৫ পরবর্তী সময়ে দীর্ঘদিন বঙ্গবন্ধুকে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের বিকৃত ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে পাঠ্যপুস্তকে ও গণমাধ্যমে। কিন্তু সত্যকে তো দীর্ঘদিন আড়াল করে রাখা যায় না। ইতিহাসের মহানায়ককে তো ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা যায় না। বাংলাদেশ আবার সঠিক পথে ফিরে এসেছে, মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস নতুন প্রজন্ম জানতে পারছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে সামনে রেখে বাংলাদেশ আজ এগিয়ে চলেছে দুর্বার গতিতে বঙ্গবন্ধুরই রক্তের উত্তরাধিকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে।
যাত্রাপথে কত বাধা-বিপত্তি। বিশ্বের বুকে অভিশাপ হয়ে জেগে উঠেছে জঙ্গিবাদ, ধর্মান্ধতা। বাংলাদেশও তা থেকে মুক্ত নয়। আজ আমাদের দেশে সকল প্রগতির পথে প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদ। রাজনীতিতে ধর্মের অপব্যবহার সকল অনিষ্টের মূল কারণ। সাম্প্রদায়িকতার হাত ধরে এদেশে জন্ম নিয়েছে জঙ্গিবাদ। সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলগুলো মানুষের মনকে বিষিয়ে তুলছে নিরন্তর। বাঙালির অসাম্প্রদায়িক ঐতিহ্য আজ হারিয়ে যেতে বসেছে।
বঙ্গবন্ধু ব্যক্তিগত জীবনে ধার্মিক ছিলেন, কিন্তু জীবনাচরণে ও আদর্শগতভাবে ছিলেন পুরোপুরি অসাম্প্রদায়িক। কিন্তু আজ তাঁর দলের লোকেরা কি বুকে হাত রেখে বলতে পারবেন তারা পুরোপুরি অসাম্প্রদায়িক? ধর্মান্ধ ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর সঙ্গে নানাভাবে আপস করে চলতে হচ্ছে তাদেরকে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে যদি আমরা আমাদের জীবনের ধ্রুবতারা হিসেবে মানি, তবে আদর্শকে সমুন্নত রেখে এগিয়ে যাবার সাহস কেন তাঁর জীবন থেকে নিতে পারি না? বঙ্গবন্ধু কখনো আদর্শের সঙ্গে আপস করেননি। বঙ্গবন্ধুর শাহাদাত দিবসে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন তখনই যথার্থ হবে যখন তাঁর আদর্শকে আমরা বুকে ধারণ করব, তাঁর নির্দেশিত পথে আমরা চলব। তা না হলে আমাদের শ্রদ্ধা নিবেদন কেবল আনুষ্ঠানিকতাই হবে।
জয় বাংলা। জয় বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি চির অমলিন।
লেখক: সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব।
সূত্র: ইত্তেফাক