বাঁচানো গেল না সিলেটের ললি বেগমকে
ওয়েছ খছরু, সিলেট থেকে : বাঁচানো গেল না সিলেটের ললি বেগমকে। মাদক বিক্রেতাদের হামলায় গুরুতর আহত ললি বেগম রক্তের অভাবে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেন। অথচ তাকে রক্ত দিতে হাসপাতালে হাজির হয়েছিলেন দুই আত্মীয় ভাই রমজান ও ভাইপো আনোয়ার। কিন্তু অজানা কারণে হাসপাতাল থেকে তাদের পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। একদিন থানায় আটকে রাখে। অনেক দেন-দরবারের পর তাদের যখন ছাড়া হয় তখন ললি বেগম চলে গেছেন পরপারে। নির্মম নির্দয় এ কাহিনী শুনে স্তম্ভিত সবাই। স্বজনরা জানিয়েছেন, ললি বেগমকে বাঁচাতে ডাক্তার ৭ ব্যাগ রক্ত সংগ্রহের কথা বলেন। নিজেদের স্বজনদের মধ্যেই ৭ জনকে রক্ত দেয়ার জন্য তৈরি করা হয়। এর মধ্যে ললি বেগমের ভাই রমজান ও ভাইপো আনোয়ারও ছিল। রাত তখন দুইটা। সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রক্ত দিতে প্রস্তুত রমজান ও আনোয়ার। ঠিক এ সময় পুলিশ গিয়ে হাজির। রমজান ও আনোয়ারকে ধরে নিয়ে যায় থানায়। ওদিকে রাতের মধ্যে রক্ত না পাওয়ায় আইসিইউতে নেয়া হয় ললি বেগমকে। একদিন পর থানা থেকে ছাড়া পান রমজান ও আনোয়ার। কিন্তু তার আগেই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করলেন ললি বেগম।
ললি বেগমের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলায়। প্রায় ২৫ বছর আগে থেকে তিনি সিলেটের দক্ষিণ সুরমায় পিরোজপুরের তান্না মিয়ার বাসায় উঠেন। সেখানেই এখনো বসবাস করছেন তার পরিবার। স্বামী আকাশ মিয়া। ললির বয়স ৪৫ বছর। এক ছেলে ও চার মেয়ের জননী তিনি। সিলেট রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় রয়েছে ললি বেগমের মেয়ের জামাই রশিদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। লাউয়াই এলাকার তিতন মিয়া, উপশহরের মালেক মিয়া ও দক্ষিণ সুরমার কালাম মিয়া সহ কয়েকজন রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় মাদকের ব্যবসা করে। রশিদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সামনে দাঁড়িয়ে তারা মাদক বিক্রি করতো। এ নিয়ে রশিদের সঙ্গে তিতন ও সহযোগীদের বিরোধ চলছিল। এই বিরোধকে কেন্দ্র করে বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে তিতন, মালেক ও কালামের নেতৃত্বে কয়েক জন হামলা চালায় ললি বেগমের বাসায়। এ সময় ললি বেগম একা বাসায় ছিলেন। তিতন সহ কয়েকজন বাসার ভেতরে ঢুকে। ললির পেটে ও বুকে ছুরিকাঘাত করে। তার চিৎকারে পাশের বাসার কলেজছাত্র রেদওয়ান আহমদ রাসেল এগিয়ে আসেন। বাধা দেয়ার চেষ্টা করলে হামলাকারীরা তাকে ছুরিকাঘাত করে। পরে স্থানীয় লোকজন এগিয়ে এলে তিতনসহ অন্যরা পালিয়ে যায়। এদিকে আহত ললি বেগম ও ছাত্র রাসেলকে রাত সোয়া ১২টার দিকে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ঘটনার পর প্রচুর রক্তক্ষরণের কারণে ললি বেগমের রক্তের প্রয়োজন হয়। ডাক্তাররা ললি বেগমকে বাঁচাতে ৭ ব্যাগ রক্ত প্রয়োজন বলে জানান। রাতে ললি বেগমের ছেলে জালাল আহমদ, মেয়ের জামাই শহীদ আহমদ রক্তের জন্য আত্মীয়স্বজনকে নিয়ে আসেন। এর মধ্যে রক্ত দিতে আনা হয় ললি বেগমের ভাই রমজান ও ভাইপো আনোয়ারকে। তাদের রক্ত সংগ্রহ করার আগেই হাসপাতালে গিয়ে হাজির হন দক্ষিণ সুরমা থানার পুলিশ। পুলিশ কর্মকর্তা এ সময় রমজান ও আনোয়ারকে ডেকে নিয়ে আসেন হাসপাতালের বাইরে। এরপর জোরপূর্বক তাদের গাড়িতে তুলে থানায় নিয়ে যান। রমজান ও আনোয়ার জানিয়েছেন, পুলিশের পায়ে ধরে অনুনয় জানিয়েছি। কিন্তু পুলিশ তাতে কর্ণপাত করেনি। আমরা বলেছি ভাই রোগী মারা যাবে। এরপরও তাদের মন একটুও গলেনি। এদিকে ওই দুইজন বাদে রাতে ললি বেগমের জন্য ৪ ব্যাগ রক্তের যোগাড় হয়েছিল। কিন্তু শুক্রবার সকালের দিকে ললি বেগমের অবস্থার অবনতি ঘটে। দুপুরের দিকে ললি বেগমকে আইসিইউতে নিয়ে যাওয়া যায়। ললি বেগমের মেয়ের জামাই শহীদ আহমদ জানিয়েছেন, টাকার বিনিময়ে রাতে থানা থেকে আনোয়ার ও রমজানকে ছেড়ে দেয়া হয়। ততক্ষণে ললি বেগমের অবস্থার আরো অবনতি ঘটে। মধ্যরাতে ললি বেগম ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। শহীদ আহমদ জানান, ডাক্তার বলেছিল ৭ ব্যাগ রক্ত দিতে, কিন্তু দুইজনকে ধরে নিয়ে যাওয়ায় রক্ত মিলেনি। পুলিশের কারণেই তার শাশুড়ি মারা গেছেন বলে দাবি করেন শহীদ আহমদ। এদিকে মামলা গ্রহণেও পুলিশ নাটকীয়তার আশ্রয় নিয়েছে। ঘটনার দিন রাতেই ললি বেগমের ভাষ্য মতে তিতন, মালেক ও কালামকে আসামি করে থানায় অভিযোগ দায়ের করা হয়। ঘটনায় পরদিন থানায় মামলা রেকর্ড করে পুলিশ। ললির স্বজনরা জানিয়েছেন, এজাহারে প্রধান আসামি করা হয়েছিল তিতনকে। কিন্তু পুলিশ পুরো এজাহারটি পরিবর্তন করে তিতনকে আসামির তালিকা থেকে বাদ দেয়। তবে উপশহরের বাসিন্দা মালেককে আসামি করা হয়েছে। আর কালাম নামে যাকে আসামি করা হয়েছে তার নাম বদলিয়ে এজাহারে কামাল নাম ব্যবহার করা হয়। আর ওই কামালের ঠিকানা দেয়া হয়েছে কদমতলী। ললি বেগমের ছেলে জালাল জানিয়েছেন, ওই কামালকে তারা চেনেন না। কালামকে তারা চেনেন। কিন্তু পুলিশ নাম পরিবর্তন করেছে। তিনি বলেন, তিতন হচ্ছে পুলিশের সোর্স। সে দক্ষিণ সুরমা এলাকায় মাদক ব্যবসা করে। এদিকে গতকাল বিকালে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের এডিসি (মিডিয়া) জিদান আল মুছা জানিয়েছেন, রক্তদাতাদের ধরে এনে টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেয়ার বিষয়টি তিনি শুনেছেন। বিষয়টি নিয়ে পুলিশ তদন্ত করছে। মামলার এজাহার পরিবর্তন হলে সেজন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানান তিনি।