বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তের জন্য পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ড. মোহাম্মদ আলী খান এনডিসি’র নেতৃত্বে ৪ সদস্যের উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত দল রোববার বিকালে সুনামগঞ্জে পৌঁছেছে। এই তদন্ত দল হাওরের বাঁধ এলাকায় সরেজমিনে ঘুরে কৃষকদের সঙ্গে কথা বলবেন। সুনামগঞ্জের সুধীজনদের সঙ্গেও কথা বলবেন। রোববার রাত ৮ টা থেকে ১০ টা পর্যন্ত শহরের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতি পাঠাগার মিলনায়তনে শহরের বিশিষ্টজন ও গণমাধ্যম কর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন তারা। প্রতিনিধি দলের অন্য সদস্যরা হচ্ছেন- যুগ্মসচিব খলিলুর রহমান, যুগ্মপ্রধান মন্টু কুমার বিশ্বাস এবং পাউবো’র সুপারেন্টেড চীফ মনিটরিং কাজী তোফায়েল আহমদ। পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ড. মোহাম্মদ আলী খান বলেছেন, ‘আমাদের উচিত ছিল আরো আগেই সজাগ হওয়া, হলে ক্ষয় ক্ষতির পরিমাণ কম হতো। এখন সবাই সজাগ হয়েছে, বিষয়টি তদন্ত করে দেখা   হচ্ছে। একাত্তরের পর হাওরে এতবড় দুর্যোগ দেখা দেয়নি। হাওরের ফসল নিয়ে জুয়াখেলা বন্ধ করতে হবে।
তিনি বলেন, কারো কোন অভিযোগ, অনুযোগ, পরামর্শ আমাদেরকে দিতে চাইলে লিখিত বা ই-মেইলে করতে পারেন।
একটি তদন্ত টিম নিয়ে আমি এখানে (সুনামগঞ্জে) এসেছি। সুনামগঞ্জসহ আগাম বন্যায় প্লাবিত অন্যান্য জেলার হাওর বাঁধের নির্মাণ ও সংস্কার কাজে যে অনিয়ম, দুর্নীতি, ধীরগতি ও অভিযোগের উপরই আমরা তদন্ত করব। তিনি বলেন, ‘তিনটি বিষয় মূলত আমরা নির্দিষ্ট করেছি। একটা হলো বাঁধ করতে গিয়ে যে অনিয়ম, দুর্নীতি, গাফিলতি বা ধীরগতি করুক না কেন সবাই আমরা দেখতে চাই প্রকৃতপক্ষে এটা কি পর্যায়ে ছিল। আসলে হয়েছে কি না, হলে কেন হলো, কি হলো এ জিনিসটা সুস্পষ্টভাবে আমরা তুলে ধরতে চাই। একই সাথে কারা এজন্য দায়ী ? অভিযোগ যদি তদন্তে প্রমাণিত হয় তাহলে সুনির্দিষ্টভাবে বের করতে হবে কারা এজন্য দায়ী।’
তিনি বলেন, ‘তবে এর চেয়েও বড় একটা দায়িত্ব আমাদের আছে। সেটা হলো এই ধরনের দুর্যোগের যেন পুনরাবৃত্তি না হয়। হাওরবাসীকে আমরা অনিশ্চয়তার ভিতরে রাখতে চাই না। পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় চাচ্ছে একটা টেকসই পদ্ধতি বা প্রযুক্তি বা কর্মসূচি নিয়ে যাতে এগুনো যায়। এই কারণে যারা ভূক্তভোগী ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক বলেন, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব বলেন, সুধী সমাজ বলেন, কর্মকর্তা বলেন তাদের কাছে মাঠ পর্যায়ে এসে আমরা জানতে চাই, তারা কি সাজেশন দেন। এটা হলো আমাদের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। আমরা জানতে চাই কি করণীয় হওয়া উচিত? কি করলে আমরা এ ধরনের দুর্যোগ থেকে রক্ষা পেতে পারি।
তিনি বলেন, ‘সুনামগঞ্জে যে বিষয়টি আমরা আগেও দেখেছি, এখনও দেখছি, সেটা হলো ফসল উৎপাদনে সুনামগঞ্জ স্বয়ং সম্পূর্ণ ও উদ্ধৃত্ব এলাকা। এখানকার ফসল দেশের শস্য ভান্ডারে জমা হয়। আর যখন এটা থাকে না, তখন দেশের শস্য ভান্ডারে তো জমাই হয় না, নিজের ঘরও শূন্য থাকে। সরকারকে শস্য ভান্ডার থেকে খাবার এনে সুনামগঞ্জে পৌঁছাতে হয়। এটি যাতে আর না হয়, সেইভাবেই সামনের দিনের পরিকল্পনা করতে হবে।’
আমরা চাচ্ছি এলাকাবাসী যারা সত্যিকারের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, অবশ্য ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় সবাই হয়েছেন। তাদের কাছ থেকে আমরা সঠিক তথ্য জানতে চাই, কিভাবে এই অবস্থার মোকাবেলা করা যায়।
তিনি বলেন, ‘আমরা কয়েকটা হাওর দেখব। যদিও আমরা জানি এখন সবই পানির তলায়। পিআইসিদেরও কিছু বক্তব্য আছে সেটাও শুনব আমরা, একতরফা কিছুই নিব না আমরা। আজ (মঙ্গলবার) বেলা ১১টার সময় জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে আমরা মতামত নেব, মতবিনিয় সভা শুধু নয়, আমরা সাজেশনও চাইব। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে একটা তদন্ত কমিটি করা হয়েছে, সেই কমিটির সাথেও আমরা বসব। পানি উন্নয়ন বোর্ডের অফিসে গিয়ে বিস্তারিত সব কাগজপত্র দেখব। কতগুলো পিআইসি হয়েছে, কতগুলো টেন্ডার হয়েছে, সেটা সুনির্দিষ্ট থাকা দরকার। কবে কমিটি গঠন করা হলো, কবে টেন্ডার দেয়া হলো, কবে ওয়ার্ক ওর্ডার দেয়া হলো, কি কারণে কোন বিল নিয়ে গেছে, সেখানে কতটুকু কাজ, এগুলো যাচাই-বাছাই করে দেখা দরকার। আমরা সিলেট অফিসেও যাব। আর পরশু দিন (মঙ্গলবার) বিশ্বম্ভরপুর উপজেলায় যাব। সেখানে খরচার হাওর, শনির হাওরের একটা অংশ দেখার সুযোগ থাকবে। কালকে  (সোমবার) আমাদের টিম হাওরের বিভিন্ন জায়গায় যাবে।
তিনি বলেন, যুগযুগ ধরে একটা সিস্টেম চলছে, হঠাৎ করে সব সমাধান হয়তো হবে না তবে আমাদের আন্তরিক চেষ্টা যদি থাকে তাহলে একটা উপায় বের হবেই। এই উপায় উদ্ভাবনের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো ক্ষতিগ্রস্ত সাধারণ জনগণ। এটার সাথে যাদের জীবনমরণ ভাগ্যে জড়িত। এ ব্যাপারে আপনাদের সহযোগিতাও চাই। আমরা কোন এ্যাকশনে যাওয়ার জন্য এখানে আসি নাই, আমরা প্রকৃত অবস্থা উৎঘাটন করার জন্য এসেছি। আশাকরি এখান থেকে আমরা যে সুপারিশ পাব ও বিশ্লেষণ হবে ভবিষ্যতে আমাদের পরিকল্পনা প্রণয়নে সহায়তা করবে।
জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নুরুল হুদা মুকুট বলেছেন, ‘হাওরের বাঁধের কাজে স্থানীয় কৃষকদের সম্পৃক্ত করতে হবে। ঠিকাদারকে সঠিক সময়ে কার্যাদেশ দিতে হবে। সকল ঠিকাদারকে চোর না বলে, ঢালাওভাবে অভিযোগ না করে যারা কাজ করেনি, তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হোক, যারা কাজ করেছে, তাদের বাহাবা দেওয়া হোক’।
জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাড. হুমায়ুন মঞ্জুর বলেন, ‘পত্রিকায় আমরা বাঁধ দুর্নীতির কথা দেখেছি। সুষ্ঠু তদন্ত করলে এটি বেরিয়ে আসবে। হাওরের মানুষকে বাঁচাতে শুনেছিলাম হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন বোর্ড মহাপরিকল্পনা তৈরি করেছিলেন। এখন পর্যন্ত এটি আলোর মুখ দেখিনি।’
হাওর বাঁচাও সুনামগঞ্জ বাঁচাও আন্দোলনের আহ্বায়ক অ্যাড. বজলুল মজিদ চৌধুরী খসরু বলেন, ‘হাওর রক্ষা বাঁধের দুর্নীতির বিষয়ে সঠিক তথ্য জানতে সরেজমিনে গিয়ে উপকারভোগীদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। ফসল হারানো বিপন্ন মানুষ মাইগ্রেট করা শুরু করেছে, মানুষকে বাঁচাতে ওয়ার্ড পর্যায়, এমনকি গ্রামের বাজার পর্যন্ত ওএমএস কেন্দ্র চালু করতে হবে। জলমহাল ও নদীগুলো যেগুলো সম্ভব এক বছরের জন্য উন্মুক্ত করে দিতে হবে।’
শিক্ষাবিদ পরিমল কান্তি দে বলেন, ‘হাওরে বাঁধ নির্মাণ শুরু’র আগেই স্থানীয় পত্রিকাগুলো লিখেছে পিআইসি গঠন হয়নি, কাজ শুরু হয়নি, ঠিকাদার কাজ করছে না। বাঁধের কাজ ২০ শতাংশ হয়েছে। হাওর তলিয়ে নেবার আশংকার কথাও লিখা হয়েছে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ আমলে নেয়নি।’ তিনি বলেন, ‘ভবিষ্যতে এমন দুর্যোগ যাতে না হয়, সেজন্য বাঁধের কাজে স্বচ্ছতা এবং মনিটরিং জোরদার করতে হবে।’
সভায় এছাড়াও বক্তব্য রাখেন- জেলা সিপিবি’র সভাপতি চিত্ত রঞ্জন তালুকদার, আওয়ামী লীগ নেতা জসিম উদ্দিন দিলীপ, কবি ইকবাল কাগজী, তাহিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অমল কর, সাইফুর রহমান সমসু, ইউপি চেয়ারম্যান বোরহান উদ্দিন, সুনামগঞ্জের খবরের বার্তা সম্পাদক বিন্দু তালুকদার, বাংলাদেশ প্রতিদিনের জেলা প্রতিনিধি মাসুম আল হেলাল, মাছরাঙা টিভি’র জেলা প্রতিনিধি এমরানুল হক চৌধুরী, আলোকিত বাংলাদেশ’র জেলা প্রতিনিধি আল হেলাল, সময় টিভি’র জেলা প্রতিনিধি হিমাদ্রি শেখর ভদ্র মিঠু প্রমুখ।
মতবিনিময় সভার শুরুকে মুক্তিযোদ্ধা শহীদ জগৎজ্যোতি পাঠাগারের সাধারণ সম্পাদক অ্যাড. সালেহ আহমদ সুনামগঞ্জের লেখকদের ১৪টি বই লেখক ড. মোহাম্মদ আলী খাঁনের হাতে তুলে দেন।
ঠিকাদার পার্থ বাঁধের কোন কাজই করেনি
শনির হাওর কমিটির সাধারণ সম্পাদক তাহিরপুর উপজেলার সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বুরহান উদ্দিন বলেন, ‘আমরা পিআইসিরা শনির হাওরের বাঁধ রক্ষায় শতভাগ কাজ করেছি। আমাদের বাঁধ ভেঙে হাওরের ফসল তলিয়ে যায়নি। শনির হাওরের আফর বাঁধে সিলেটের ঠিকাদার হান্নান অনেক কাজ করেছে। কিন্তু সুনামগঞ্জের ঠিকাদার পার্থ বাঁধের কোন কাজই করেনি। ঠিকাদার পার্থ হাওরের বাঁধে একদিন যায়ই নি।’
রবিবার পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ড. মোহাম্মদ আলী খান সুনামগঞ্জ শহরের শহীদ জগৎজ্যোতি পাঠাগারে সুধিজনদের সাথে মতবিনিময় সভায় উপস্থিত হয়ে শনির হাওর রক্ষা বাঁধের কাজের বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে বুরহান উদ্দিন এভাবেই বলেন, ঠিকাদার পার্থ সারথী পূরকায়স্থ বাঁধের কোন কাজ করেনি।’
সাফাই গাইতে ঠিকাদার ও পিআইসিদের ভীড়
পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ড. মোহাম্মদ আলী খান সুনামগঞ্জ শহরের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতি পাঠাগারে সুধিজনদের সাথে মতবিনিময় করবেন এই খবরে আগ থেকেই ভীড় করেন ঠিকাদার-পিআইসি ও তাদের অনুগতরা।
বেশ কয়েকজন ঠিকাদার ও পিআইসির সভাপতি ওই সভায় উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া ঠিকাদার ও পিআইসি সভাপতির পক্ষের অনেক লোক ওই সভায় উপস্থিত ছিলেন। সভায় চেয়ার না পেয়ে অনেকেই দাঁিড়য়ে থাকতে হয়েছিল। কয়েকজন সভায় আগ বাড়িয়ে নিজেদের পক্ষে সাফাই বক্তব্য দেন। যারা কাজ করেছেন তারা ছিলেন, আবার যারা কাজ করেন নি তারাও উপস্থিত হয়েছিলেন।  ঠিকাদারদের পক্ষে যখনই কেউ কথা বলছিলেন তখন ঐক্যব্ধভাবে জোরে হাততালি দেন উপস্থিত ঠিকাদারও তাদের অনুগতরা। এছাড়াও দুই একজন পিআইসির সভাপতি উপস্থিত হয়ে নিজেদের পক্ষে সাফাই বক্তব্য দেন। সূত্র-‘সুনামগঞ্জের খবর’

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn