বাঙালি জাতির জনক ও সোনামিয়া-লালমিয়া
আখতারুজ্জামান আজাদ ( ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে)।।
‘বাঙালি জাতির জনক’ তত্ত্বটি নিয়ে অনেক বাঙালির মনোজগতেই অনিচ্ছাকৃত বা ইচ্ছাকৃত দোটানা-দোনোমনা-দোলাচল আছে। এই দ্বিধাগ্রস্ত সম্প্রদায়টিকে আরো বিভ্রান্ত-বিভক্ত করে দেয়ার উদ্দেশ্যে অনেক মর্দে মোজাহিদ আবার পরিকল্পিতভাবে ‘মুসলিম জাতির জনক’-এর সাথে ‘বাঙালি জাতির জনক’-এর একটি সুচতুর সংঘর্ষ বাধিয়ে দিয়ে থাকেন। ‘বাঙালি জাতির জনক’ ও ‘মুসলিম জাতির জনক’ সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটো ধারণা, এর একটির সাথে আরেকটির কোনো সংঘাত-সংঘর্ষ নেই; যেটুকু বিভ্রান্তি আছে, সেটুকু সুপরিকল্পিতভাবে ছড়িয়েছে রাজাকারচক্র।
হজরত ইবরাহিম (আ.) গোটা মুসলিম জাতির পিতা। তিনি আরবিভাষী-ফারসিভাষী মুসলিমদেরও পিতা, আবার ইংরেজি-তুর্কি-গ্রিক-উর্দু-পর্তুগিজ-বাংলা-চাকমা-মান্দি-হিন্দিভাষী মুসলিমদেরও পিতা। একটি ধর্মে কেবল একটি ভাষার লোকজনই অন্তর্ভুক্ত নন, বরং বহু ভাষার ও বহু দেশের লোকজন অন্তর্ভুক্ত। মুসলিম জাতির যেমন একজন পিতা আছে, তেমনি একটি দেশের জনগণের কিংবা একটি ভাষার ব্যবহারকারীদেরও আলাদা-আলাদা পিতা থাকতে পারে; যেমন : সৌদি আরবের পিতা ইবনে সৌদ, তুরস্কের ও তুর্কি জাতির পিতা কামাল পাশা, ভারতীয়দের পিতা মহাত্মা গান্ধী, পাকিস্তানিদের পিতা মুহাম্মদ আলি জিন্নাহ, বলিভিয়ানদের পিতা সাইমন বলিভার, বাংলাদেশের ও বাঙালি জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান।
অনেকে আছেন; যারা মুসলিম জাতির জনক, তুর্কি-আরব-ইরানি জাতির জনক থেকে শুরু করে রাষ্ট্রবিজ্ঞান-জীববিজ্ঞান-চিকিৎসাবিজ্ঞান-রসায়নশাস্ত্রসহ সব কিছুর জনককে মেনে নিতে রাজি; কেবল ‘বাঙালি জাতির জনক’-কে মানতেই তারা নারাজ, কেবল এই একটি ইশুতেই ‘মডারেট মুসলিম’ থেকে তারা কট্টর মুসলিম হয়ে যান! মারদাঙ্গা মোজাহিদরা আবার বলে থাকেন— ‘যারা মুজিবকে জাতির জনক বলে, তাদের মায়েরা মুজিবের সাথে শুয়েছে নাকি?’ অবশ্য এই মর্দে মোজাহিদদের মগজে শোয়াশুয়ি ছাড়া আর কোনো চিন্তাভাবনা নেই। শত-শত গিগাবাইট পর্নো-লব্ধ বিদ্যা যাদের মগজে, ময়না-টিয়া-কলিজুদের সাথে টেলিসঙ্গম ও টেবিলসঙ্গম-লব্ধ এলেম যাদের শিশ্নাগ্রে; তাদের কাছ থেকে এই শোয়াশুয়ি ছাড়া আর কী বা আশা করা যেতে পারে!
ইবনে সৌদ সৌদি আরবের, কামাল পাশা তুর্কি জাতির, অ্যারিস্টটল রাষ্ট্রবিজ্ঞানের, ইবনে সিনা চিকিৎসাশাস্ত্রের জনক; এর মানে এই না— সকল সৌদির মা ইবনে সৌদের সাথে শুয়েছেন, সকল তুর্কির মা কামাল পাশার শয্যাসঙ্গী হয়েছেন, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সকল শিক্ষার্থীর মা অ্যারিস্টটলের সাথে কিংবা সকল চিকিৎসকের মা ইবনে সিনার সাথে শুয়েছেন! এই পিতৃত্ব আদর্শিক-রাজনৈতিক-ঐতিহাসিক, এই পিতৃত্ব বিমূর্ত ও প্রতীকী। জৈবিক পিতার সাথে এই পিতাদের সংঘর্ষ নেই। এই পিতারা সন্তানদেরও পিতা, সন্তানদের জৈবিক পিতাদেরও পিতা। বিয়েবহির্ভূত শোয়াশুয়ির অভ্যেস ছিল অবশ্য জিন্নাহর, শুয়ে থাকলে কতিপয় পাকিস্তানির কিংবা কতিপয় বাংলাদেশী ছুপা পাকির মা-নানি-দাদি উনার সাথে শুয়ে থাকতে পারেন; তাও ঐ শরীর নিয়ে জিন্নাহ সকল পাকিস্তানির মায়ের সাথে শুয়েছেন বা শুতে পেরেছেন বলে মনে হয় না!
যখন বলা হয় ‘মুসলমান-মুসলমান ভাই-ভাই’, তখন এই ভ্রাতৃত্ব জৈবিক নয়, বরং আদর্শিক। করিম মুসলমান, করিমের বাবা বা শ্বশুরও মুসলমান; এর মানে কি মুসলমান হবার কারণে ঐ বাবা ও শ্বশুরও করিমের ভাই? হাসপাতালের নার্সদেরকে লোকে ‘সিস্টার’ ডাকে; রহিম নার্সকে ‘সিস্টার’ ডাকলে রহিমের বাবা কি নার্সকে ‘ডটার’ ডাকবেন? পাদরিদেরকে লোকে ‘ফাদার’ ডাকে; এখন কি আলবার্ট পাদরিকে ‘ফাদার’ ডাকলে আলবার্টের মা ঐ পাদরিকে ‘হাজব্যান্ড’ ডাকবেন? যেসব মর্দে মোজাহিদ ‘বাঙালি জাতির জনক’-তত্ত্বে বিশ্বাসী না, তাদের অনেকেই আবার বিভিন্ন পিরের মুরিদ; ঐ পিরদেরকে তারা ‘পির বাবা’, ‘দয়াল বাবা’ ইত্যাদি বলে ডাকেন; এর মানে কি ঐ মর্দে মোজাহিদদের মায়েরা ঐ পিরবাবা বা দয়াল বাবার সাথে শুয়েছেন? তাদের মায়েরা কি ঐ পিরদেরকে ‘পির স্বামী’ কিংবা ‘দয়াল স্বামী’ বলে ডাকেন?
এসব প্রশ্নের জবাব নেই। এসব প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলে কিছু নান্দনিক নুরানি গালি ছাড়া আর কিছু জোটে না। মর্দে মোজাহিদরা সব জনক-এ বিশ্বাসী, কেবল ‘বাঙালি জাতির জনক’-এ অবিশ্বাসী। চুলকানিটা জনকেও নয়, বাঙালি জাতির জনকেও নয়; চুলকানিটা শেখ মুজিবে! যদি শেখ মুজিবের জন্ম না হতো কিংবা ‘বাঙালি জাতির জনক’ হিশেবে যদি নাম আসত ফজলুল কাদের চৌধুরী কিংবা গোলাম আজমদের; তাহলে ঐ মর্দে মোজাহিদরা ‘বাঙালি জাতির জনক’ তত্ত্বকে কেবল মেনেই নিত না, বরং তারা দলে-দলে নোটারি কিংবা অ্যাফিডেভিট করে জন্মদাতা বাপের নাম কেটে দিয়ে সার্টিফিকেটে-পাসপোর্টে-পরিচয়পত্রে ঐ ফজলুল-গোলামদের নাম বসিয়ে নিত!
পরিচয়পত্রে জনৈক লাল মিয়ার নাম ভুলক্রমে সোনা মিয়া এসেছে, কর্তৃপক্ষের কাছে গিয়ে লাল মিয়া বললেন— ‘ভাই, আমার সোনাটা কেটে একটু লাল করে দেন না!’ বাঙালি জাতির জনক হিশেবে শেখ মুজিবের পরিবর্তে এই ফজলুল-গোলামদের নাম এলে কত বাঙালি যে সোনা কেটে লাল করার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে যেত, এর ইয়ত্তা নেই।
শেখ মুজিব বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা, বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের অবিসংবাদিত ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা। স্বাধীনতার পক্ষের কারো তাকে বাঙালি জাতির জনক বলে ডাকতে আপত্তি থাকার কথা নয়, তাকে বাঙালি জাতির জনক বলে ডাকার বিপরীতে হাজারও ছুতা তুলতে পারে কেবল স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকারচক্র ও ছুপা রাজাকারচক্র। শেখ মুজিবকে বাঙালি জাতির জনক বলে ডাকতে যদি নিতান্তই আপত্তি থেকে থাকে, তবে তা থাকতে পারে বাংলাদেশের বাইরের কিছু-কিছু বাঙালির। বাঙালি কেবল বাংলাদেশে নেই, বাংলাদেশের বাইরেও আছেন। তাদের কাছে মুজিবের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বাঙালি থেকে থাকতে পারেন। বাংলাদেশের বাইরের বাঙালিদের কাছে শেখ মুজিব জাতির জনক কি না, সেটি অবশ্য দীর্ঘ অ্যাকাডেমিক আলোচনার বিষয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বাঙালি জাতির জনক হিশেবে স্বীকৃতি দিতে অন্তত বাংলাদেশের কোনো বাঙালির দ্বিধা থাকার কথা নয়। যদি কারো থেকেই থাকে, তবে সে নিশ্চয়ই স্বাধীনতাবিরোধী কিংবা কোনো স্বাধীনতাবিরোধীর ঔরসজাত বেওয়ারিশ উত্তরসূরি ।।