বাবার বাড়ানো হাত-হাসান হামিদ
এই পৃথিবীতে আমরা না চাইলেও একটি হাত আমাদের দিকে সবসময় বাড়ানো থাকে; যার অর্থ এই, আমি আছি, কোন ভয় নেই। সে হাতটি বাবার। বাবা যদিও একজন পুরুষ অভিভাবক হিসেবে, সন্তানের জনক হিসেবে সংজ্ঞায়িত হয়ে থাকেন; তথাপি বাবা এর চেয়ে আরও বেশি কিছু। বাবার বাড়ানো সেই হাতটি আমি পাইনি। আমি যখন ধরেছি পৃথিবীর আঙুল, আমার বাবা তখন নক্ষত্র। আমরা মা-কে বাবার ভূমিকায় দেখেছি ছোটবেলায়। আমাদের এতোগুলো ভাই-বোন; বাবার না থাকায় আমার মা কেমন করে পাড়ি দিয়েছেন সেই পথ, ভাবতে পারি না! আর একজন বাবা আসলে কেমন হয়, কীভাবে সন্তানের গালে চুমু খায়, সন্তানের সাফল্যে বাবার চোখ কতোটা ভিজে যায় আনন্দে; আমি এসবের কিছুই জানি না। আমি জানি না, একজন বাবা আসলেই কেমন হয়!
আমি হাওরের এক পাড়া গায়ে জন্মেছি। আমি বড় হয়েছি আকাশ দেখতে দেখতে, গাছের লতার মতো মাটিতে পা ফেলতে ফেলতে। আমি যেদিন জন্মেছি, বৈশাখের কড়া যে দুপুরে আমি নেমেছি পৃথিবীতে; আমার বাবা সেদিন কী করেছিলেনআমি জানি না, আমি কথা বলতে যখন শিখেছি, বাবা কতোটা উচ্ছল ছিলেন অথবা কী স্বপ্ন ছিলো তাঁর আমাকে নিয়ে এসবের কিছুই জানি না আমি। আমার তিন বছর বয়সেই আমি বাবাকে হারিয়েছি। বাবাকে নিয়ে কোনো স্মৃতি আমার নেই। আমার কোনো বিকেল নেই বাবার আঙুল ধরে হাঁটার, আমার কোনো দুপুর নেই বাবার লোমশ বুকে চিত হয়ে শুয়ে থাকার, আমার কেবল বাবার জন্য হাহাকারের সহস্র রাত্রি আছে; আমার কেবল বাবাহীন একটা মৃত্যুর মতো জীবন আছে।
আমার বাবা ছিলেন আমাদের গ্রামের স্কুলের হেডমাস্টার। বাবা সিলেবাসের বাইরে বই তৈরি করে পড়াতেন। তাঁর নিজের লেখা অসংখ্য ছড়া কবিতা, গান তাঁর স্কুলে পড়ানো হতো। আমি যখন একটু পড়তে শিখেছি, বাবা যদিও নেই; বাবার সেইসব খাতাপত্র, বই হাতড়িয়ে আমি বেড়ে উঠেছি। আমার বাবা ছবি আঁকতেন। ভয়াবহ সুন্দর ছবি। তিনি লিখতেন। পত্রিকায় কয়েকটি লেখা ছাপাও হয়েছিল তাঁর। তবে জীবনের সব স্বপ্ন অপূর্ণ রেখে আকস্মিক তিনি চলে গিয়েছেন। তাঁর লেখা খাতাগুলো দেখলে আমি বুঝতে পারি, আমার বাবার স্বপ্ন আসলে কী ছিলো।
মা-কে আমরা আম্মা বলি। বাবা যদি থাকতেন, বাবা-কে নিশ্চয়ই আব্বা ডাকতাম। ছোটবেলায় বেড়ে উঠার সে সময়টাতে বাবার প্রয়োজনটা আমি তেমন করে বুঝিনি। আজ বুঝতে পারি, বাবার বাড়ানো হাতটি কতোটা প্রয়োজন!
হাসান হামিদ-
(লেখক- গবেষক ও সদস্য, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র)