বিএনপিতে বাড়ছে অভিমানী নেতার সংখ্যা
রাগ, ক্ষোভ আর অভিমানে বিএনপিতে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়া নেতাদের সংখ্যা বেড়েই চলছে। দলের শীর্ষ নেতাদের বিমাতাসুলভ আচরণ, আরাজনৈতিক সিদ্ধান্ত সর্বোপরি সিন্ডিকেট নির্ভর কর্মকাণ্ডে হতাশ হয়েই এসকল নেতৃবৃন্দ রাজনীতি থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখছেন। তাদের কেউ নিজের ব্যবসা কিংবা পরিবারকে সময় দিচ্ছেন। আবার অনেকে সুদিনের অপেক্ষায় সময় পার করছেন। বিএনপির নেতাকর্মরা জানান, ডাকসুর সাবেক ভিপি আর নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম নেতা, দলের সাবেক যুগ্ম মহাসচিব আমান উল্লাহ আমানকে চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা করা হয়েছে। নতুন পদে তিনি অসন্তুষ্ট হলেও সকল কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করছেন। খালেদা জিয়ার কাছে হারানো আস্থা ও বিশ্বাস পুনরুদ্ধারে আপ্রান চেষ্টা করছেন। নব্বই আন্দোলন থেকে শুরু করে প্রত্যেকটি রাজপথের আন্দোলন আর ওয়ান ইলেভেনের ত্যাগী নারী নেত্রী শিরীন সুলতানাকে এখন আর কোথাও দেখা যায় না। খালেদা জিয়ার বিশ্বস্ত এ নারী নেত্রীকে মহিলা দল থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। জুনিয়র আর মৌসুমী নেতাদের ভালো জায়গায় রাখা হয়েছে অনুযোগ করার অপরাধে খালেদা জিয়া তাকে এই শাস্তি দেন।
রাগে-দুঃখে অভিমানে দলের সকল পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন ছাত্র নেত্রী থেকে উঠে আসা অ্যাডভোকেট সৈয়দা আশিফা আশরাফি পাপিয়া। রাজশাহী বিভাগের প্রভাবশালী আর জনপ্রিয় নেতা সাবেক যুগ্ম মহাসচিব মিজানুর রহমান মিনুকেও দলের সিন্ডিকেটের রোষানলে পড়তে হয়েছে। দলের নতুন কমিটিতে তাকেও করা হয়েছে চেয়ারপাসনের উপদেষ্টা। তাকেও এখন আর তেমনটা দেখা যায় না। বিগত কমিটির ১ম সহ দফতর সম্পাদক আবদুল লতিফ জনি। মেধা আর সাংগঠনিক যোগ্যতাই নয়, জিয়া পরিবারের সাথেও তার ৩২ বছরের সম্পর্ক। কিন্তু তিনিও সিন্ডিকেটের রোষানলে পড়ে একধরনের স্বেচ্ছা অবসরে চলে গেছেন। আরেক মেধাবী ও সাংগঠনিক নেতা সাবেক সহ দফতর সম্পাদক শামীমুর রহমান শামীমও চলে গেছেন পর্দার অন্তরালে। খালেদা জিয়াকে রাজনীতির মাঠে নিয়ে আসার পিছনে অন্যতম ভূমিকায় থাকা দলের ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল নোমানকে সর্বশেষ কমিটিতেও কোনো পদোন্নতি দেয়া হয়নি। অথচ তারই হাত ধরে বিএনপির রাজনীতিতে প্রবেশ করা একজনকে স্থায়ী কমিটিতে বসানো হয়েছে। রাগে-ক্ষোভে নোমান রাজনীতি ছাড়ার ইচ্ছা পোষণ করলেও এখনো ঢিমেতালে দলের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধের আগে থেকে জিয়া পরিবারের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও অভিজ্ঞ রাজনীতিবীদ মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমেদ, বীর বিক্রমেরও ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয়নি। খালেদা জিয়ার সার্বক্ষনিক সঙ্গী, মেধাবী নেত্রী সেলিমা রহমানকেও কোন পদোন্নতি দেয়া হয়নি বলে আগের মতো তাকে আর দেখা যায় না। অভিমানের তালিকায় আরো রয়েছেন, ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকা, চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফসহ আরো অনেক নেতৃবৃন্দ। দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির নেতৃবৃন্দেও মধ্যেও রয়েছে ক্ষোভ আর অভিমান। নেতাকর্মীরা জানান, নামে নীতিনির্ধারনী ফোরাম হলেও খালেদা জিয়া কাউকে বিশ্বাস করেন না। তাই দলের নীতি নির্ধারণে তাদের কোনো পরামর্শও নেয়া হয় না। গুলশান কার্যালয় আর নয়াপল্টন কার্যালয়ের যৌথ সিন্ডিকেটের প্রভাবে প্রবীণ এসকল রাজনীতিবীদরাও দলের মধ্যে কোনঠাসা হয়ে পড়েছেন। দলের দুই কার্যালয়ের দুই দুষ্টচক্র খালেদা জিয়াকে প্রভাবিত করে প্রতিষ্ঠিত করেছেন- দলে তারা ছাড়া আর কেউ বিশ্বস্ত নাই। আর এ কারণে দলের জন্য আজীবন নিবেদিত ড. খন্দকার মোশাররফ, প্রবীণ রাজনীতিবীদ ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ, সাবেক সেনা প্রধান লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান, ড. মঈন খানদের মতো নেতৃবৃন্দ এখন আর আগের মতো সক্রিয় হয়ে উঠতে পারছেন না। তবে স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস আর গয়েশ্বর চন্দ্র রায় রয়েছেন ফুরফুরে মেজাজে।
নেতাকর্মীরা জানান, খালেদা জিয়া তিনবারের প্রধানমন্ত্রী। তার একটি বিবৃতি প্রচারের জন্য রাত ২টা কিংবা আরো গভীর রাতে সংবাদ মাধ্যমে প্রেরণ করে দলের দফতর শাখা কি করতে চাচ্ছেন তা কেউ জানেন না। আবার নয়াপল্টনে কারণে-অকারণে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদের সংবাদ সম্মেলন আর রাত ৯টায় খালেদা জিয়া গুলশান কার্যালয়ে গেলে ঘুরেফিরে একই মুখের আনাগোনার মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে বিএনপির যাবতীয় রাজনীতি। বিএনপিতে সেনাবাহিনী প্রত্যাগত কর্মকর্তাদের এর আগে মূল্যায়ন করা হলেও সর্বশেষ কমিটিতে করা হয়নি বলে অনেক সাবেক সেনা কর্মকর্তা নিষ্ক্রিয় হয়ে রয়েছেন। এ বিষয়ে সাবেক সেনা কর্মকর্তা মেজর (অব.) ব্যারিস্টার সারোয়ার হোসেন বলেন, আমি রাজনীতি করতে গিয়ে জেল-জুলুম, মামলা-হামলার শিকার হয়েছি। আমার মতো আরো অনেককেই এরকম ত্যাগ করতে হয়েছে। কিন্তু দলের সর্বশেষ কমিটিতে আমাদের অনেকের কোনো স্থান হয়নি। অথচ ৫০৩ সদস্যের ওই নির্বাহী কমিটিতে অনেক অপরিচিত-আনকোরাদের স্থান দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ওই কমিটি গঠনে যারা সম্পৃক্ত ছিলেন, ম্যাডামকে তথ্য দিয়েছেন তারা তাদের দক্ষতা প্রমাণ করতে পারেননি। তারা নেতৃত্ব ও সাংগঠনিক কিংবা ত্যাগের বিবেচনায় কমিটি গঠন করেননি, অন্য কোনো বিবেচনায় করা হয়েছে বলেই আমার মনে হয়। তিনি আরো বলেন, দলের প্রতিষ্ঠাতা শহীদ জিয়াউর রহমানের গড়া এই দলে সৎ, আদর্শ আর ত্যাগীদের স্থান থাকার কথা থাকলেও অনফরচুনেটলি আমাদের হয়নি। এদিকে দলের নেতাকর্মীদের পাশাপাশি রাগে, ক্ষোভে আর অভিমানে অনেকটাই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন বিএনপি ঘরানার বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী নেতৃবৃন্দ। বিএনপির অবহেলা-অবমূল্যায়ন এবং পরামর্শ-মতামত গ্রহণে অনীহাসহ নানা কারণে দিন দিন নিজেদের গুটিয়ে রাখছেন এসকল ব্যক্তিরা। খালেদা জিয়ার কাছ থেকে উৎসাহ না পাওয়ায় দলীয় কর্মসূচি থেকেও বিরত থাকছেন তারা।
সূত্র জানায়, দলটিকে নানা সময় পরামর্শ দিতেন কয়েকজন আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ, পরিবেশবাদী, আইনজীবী, অধ্যাপক, ও আইনবিদ। নানা সময়ে খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করে বা ভিন্ন কোনও উপায়ে দলের বিষয়ে পরামর্শ ও সুপারিশ তার হাতে তুলে দিতেন লিখিতভাবে। এই প্রক্রিয়াটিও বিএনপি প্রধানের পরামর্শেই তারা শুরু করেছিলেন। যদিও গুলশান কার্যালয় আর পল্টন কার্যালয়ের অদৃশ্য শক্তির হস্তক্ষেপে তাদের প্রস্তাবগুলো হয় হারিয়ে গেছে, নয়তো স্থগিত করা হয়েছে। ক্ষেত্র বিশেষে প্রস্তাবগুলোকে সুকৌশলে দলীয় প্রধানের কার্যালয় থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। বুদ্ধিজীবীদের দেওয়া পরামর্শ ও মতামত গ্রহণে বিএনপির ধারাবাহিক নেতিবাচক আচরণ ও উপেক্ষার কারণে দলটির সিনিয়র বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, শফিক রেহমান, ফরহাদ মজহারসহ কয়েকজন নিষ্ক্রিয় রয়েছেন। আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান মুক্তি পেলেও কোনও কর্মকাণ্ডে নেই।