বিদায় এরশাদ : বাংলাদেশে জেনারেল-রাজনীতির অবসান
জেনারেল এরশাদ ক্ষমতা দখল করেন বিচারপতি আব্দুস সাত্তারের কাছ থেকে। জেনারেল জিয়াউর রহমানকে ততোদিনে হত্যা করেছে তারই সহকর্মীরা। জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা দখল ছিল জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা এবং জেলের ভেতর জাতীয় চার নেতাকে হত্যার মধ্য দিয়ে। ক্ষমতা দখল করে রাজনৈতিক দল সৃষ্টি এবং রাষ্ট্র ক্ষমতা ও রাষ্ট্রীয় কোষাগারকে ব্যবহার করে বিভিন্ন দল থেকে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে ভাগিয়ে আনার যে নীতি জেনারেল জিয়া গ্রহণ করেছিলেন এরশাদও ক্ষমতায় বসার মাত্র বছরখানেকের মাথায় এই প্রক্রিয়া শুরু করেন। মজার ব্যাপার হলো, যারা জিয়াউর রহমানের দল গঠনে মৌলিক ভূমিকা রেখেছিলেন তাদের কেউ কেউ এসে এরশাদের গঠিত দলেও জায়গা করে নিয়েছিলেন। জেনারেল জিয়া ও জেনারেল এরশাদের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য যদি কেউ খোঁজেন তাহলে দেখতে পাবেন যে, জিয়াউর রহমান ছিলেন অত্যন্ত তুখোড়বুদ্ধির ও নিষ্ঠুর এক সামরিক কর্মকর্তা যার ছিল অত্যন্ত ভয়ঙ্কর রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ আর এরশাদ এক্ষেত্রে নিজেকে কখনও কবি, কখনও প্রেমিক, কখনও পল্লীবন্ধু সেজে নিজের ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখার জন্য কাউকে হত্যায় পিছপা না হওয়া একজন সামরিক শাসক। জিয়া ও এরশাদ, এই দুই সামরিক শাসকের মধ্যে পার্থক্য নেই, আবার পার্থক্য আছেও, সেটা হলো, জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের রাজনীতিকে কলুষিত করেছেন আর এরশাদ কেবল তার পূর্বসূরি জিয়াকে অনুসরণ করেছেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন কোনো “ভয়ঙ্কর”-কে যোগ করতে পারেননি।
জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক দল গঠনের প্রক্রিয়ায় আমরা যেমন দেখেছি যে, দেশের নামি-দামি রাজনীতিবিদদের বিক্রি হয়ে যেতে, তেমনই এরশাদের সময়ও দেখতে পাই রাজনীতিতে নামতে গিয়ে তিনিও একাধিক সাবেক রাজনীতিবিদদের কিনেছেন। দেশের অনেক বুদ্ধিজীবী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, প্রকৌশলী, শিল্পী, লেখক-কবি যেমন জিয়াউর রহমানের পাশে গিয়ে ভিড় জমিয়েছিলেন নিজেদের আখের গোছানো (কিংবা হতে পারে জীবনের ভয়েও) তেমনই এরশাদের পাশেও আমরা দেখতে পাই দেশের বরেণ্য ব্যক্তিদের- সুতরাং বাংলাদেশে স্বৈরশাসনের বৈধতাদান বলি কিংবা সেনা-রাজনীতিকে প্রতিষ্ঠা বলি, এতে বাংলাদেশের সুশীল সমাজ, শিল্পী-কবি-লেখক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ভূমিকাও উল্লেখ করার মতো। আজকেও যখন আওয়ামী লীগের সমালোচনা করতে গিয়ে এই সমালোচকবৃন্দ রাষ্ট্রের দু’দু’টি সামরিক সরকার ও সামরিক আমলে সৃষ্ট রাজনৈতিক দলগুলোর অবদানকে ইচ্ছাকৃতভাবে এড়িয়ে যান তখন মনে হয়, এই বিশিষ্ট শ্রেণিটিই এদেশের মানুষকে সামরিক শাসন আর গণতান্ত্রিক রাজনীতির পার্থক্য সঠিকভাবে অনুধাবন করতে দেয়নি। এখনও যেমন কথায় কথায় পাকিস্তান আমলকে স্বাধীন বাংলাদেশের সঙ্গে তুলনায় আনা হয়, এবং ঢালাও ভাবে বলা হয় যে, পাকিস্তান আমলে এটা ভালো ছিল, ওটা ভালো ছিল, তেমনই এদেশে এখনও আইয়ুব খানের “ডান্ডার শাসনকেই” এদেশের জন্য প্রযোজ্য বলে মনে করেন কেউ কেউ।
বহুদিন পর ২০০০ সালের দিকে জেল থেকে মুক্ত সাবেক স্বৈরাচার জেনারেল এরশাদ এই লেখককে দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে দাবি করেন যে, তাকে বাংলাদেশের মানুষ আসলে ভালোবাসে, নাহলে তিনি কেন জেলে বসেই পাঁচটি আসনে নির্বাচিত হবেন? কেনই বা তার দল তৃতীয় প্রধান রাজনৈতিক দল হিসেবে বড় বড় দলগুলির সরকার গঠনে দরকারী হয়ে উঠবেন? তিনি একথা জোর দিয়েই বলেছেন যে, তাকে স্বৈরাচারী বলা হলে কেন জিয়াউর রহমানকে স্বৈরশাসক বলা হবে না? তিনি দাবি করেন যে, তাকেও যদি জেলের ভয়ে ভীত না রেখে মুক্তভাবে রাজনীতি করতে দেওয়া হয় তাহলে তার দল বিএনপি’কে সরিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে চলে আসবে দ্রুত। মজার ব্যাপার হলো, এরশাদ নিজেকে বাংলাদেশের বড় দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র মধ্যে ক্ষমতার টানাটানিতে নিজেকে প্রয়োজনীয় করে তুলতে কোনো ভাবেই পিছপা হননি। দর কষাকষি করেছেন, কখনও গোপনে কখনও প্রকাশ্যেই গিয়ে একেক মঞ্চে উঠেছেন।
স্মরণ করতে পারি তারেক রহমানের সঙ্গে গিয়ে চার দলীয় জোট গঠনে প্রায় রাজি হয়ে যাওয়া কিংবা তারপর ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের পাশ থেকে প্রায় সরে যাওয়ার চেষ্টা করা এবং শেখ হাসিনার সরকারকে চরম বিপদে ফেলে যুদ্ধাপরাধের বিচারসহ দেশকে চরম এক অস্থিরতায় ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করা। এসব সবই সম্ভব হয়েছে কেবল ভোটের রাজনীতিতে এরশাদ ও তার দলের একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভোট পাওয়ার কারণে। এর অর্থ হচ্ছে, জেনারেল জিয়া এবং জেনারেল এরশাদ, দু’জনই এবং দু’জনের দলই এদেশে রাজনৈতিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কেবল এদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক চেতনায় বেশ খানিকটা অসচেতনতা থাকা, একই কারণ দিয়ে আমরা ব্যাখ্যা করতে পারি বঙ্গবন্ধুর সরকারকে বিচারে আরও একটু সময় না দেয়া, সদ্য স্বাধীন দেশে ক্রমাগত অপপ্রচারে বিশ্বাস করে বঙ্গবন্ধুর সরকারকে উৎখাতে দেশী-বিদেশি চক্রান্তকে না বোঝা কিংবা জেনেশুনে চক্রান্তকারীদের হাতকে শক্তিশালী করা।
আজকে এরশাদ এ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন। তার আত্মার মুক্তি কামনা করে একথা বলাই যায় যে, তিনি এবং তার পূর্বসূরি জেনারেল জিয়াউর রহমান, দু’জনেই বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য সমান ক্ষতিকারক সামরিক শাসক, যারা বাংলাদেশকে দীর্ঘদিনের জন্য কেবল পিছিয়ে দিয়েছেন তাই-ই নয়, বাংলাদেশকে বিদেশি শক্তির হাতের পুতুল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতেও তারা ‘পাইওনিয়ার’। রাজনীতি আজকে যে নোংরা, পশ্চাৎপদ, সুবিধাবাদী, কালোবাজারী, ব্যবসায়ী, আমলা ও সেনা-নির্ভর হয়েছে তার মূল রূপকার এই দুই সেনা শাসক। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে, তাঁর রাজনৈতিক ধারাবাহিকতা বেঁচে থাকলে, তার দ্বিতীয় বিপ্লব সফল হলে দেশের আজকের রাজনীতি ও গতি ভিন্ন হতো তাতে কোনোই সন্দেহ নেই। সবচেয়ে বড় কথা, এই দুই সেনা শাসকই এদেশের রাজনীতিতে ধর্মকে যুক্ত করে একই সঙ্গে রাজনীতিকে কলুষিত করেছেন এবং দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের ধর্মকেও বিতর্কিত করেছেন- এর দায় সম্পূর্ণভাবে তাদের।
পরবর্তীতে তাদের সৃষ্ট দুই দল যাতে একত্রিত না হয়ে যায়, ভোটের রাজনীতিতে তারা যাতে নিজেদের ভোট মিলিয়ে ফেলতে না পারে সে জন্য আওয়ামী লীগের মতো রাজনৈতিক দলকে বহুবিধ কৌশল অবলম্বন করতে হয়েছে, যাকে কৌশল না বলে অপকৌশল বলাটাই ঠিক হবে। রাজনীতি যখন একবার কঠিন হয়ে পড়ে ও রাজনীতিবিদদের হাত থেকে বেরিয়ে যায় তখন তাকে আবার সহজ ও সাধারণ মানুষের হাতে ফিরিয়ে আনাটা যে কতোটা কঠিন হয়ে পড়ে তা আজকের বাংলাদেশ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। তবে স্বস্তির বিষয়টিও পাঠককে জানিয়ে রাখতে চাই। জেনারেল জিয়ার সৃষ্ট রাজনৈতিক দল বিএনপি তার স্ত্রী ও পুত্রের হাতে পড়ে এখন মৃতপ্রায়, জেনারেল এরশাদের মৃত্যুর পর তার দলটির কী অবস্থা হয় তা এখনই নিশ্চিত করে বলা না গেলেও এই দলটির রাজনীতিও অতি দ্রুত শেষ হবে তাতে কোনোই সন্দেহ নেই। এই জেনারেল-সৃষ্ট রাজনীতি যদি দুর্বল হয় তবে সাধারণ মানুষের রাজনীতি এদেশে নতুন ধারার রাজনীতি নিয়ে এলেও আসতে পারে- এরকমটি ভাবাটা দিবাস্বপ্ন দেখা হবে না মোটেও। এরশাদের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতি ঠিক এরকম একটি মাহেন্দ্রক্ষণে এসে দাঁড়ালো- দেখাই যাক এরপর কোথাকার জল কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়। লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।