ব্রিটেনের নির্বাচন ও রাজনীতিতে ‘অভিবাসন’ কিভাবে ইস্যু হয়ে উঠলো
ব্রিটেনে আর ক’দিন পরেই অনুষ্ঠিত হচ্ছে সাধারণ নির্বাচন। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসার ব্যাপারে ক্ষমতাসীন কনসারভেটিভ পার্টির অবস্থানকে আরো শক্ত করতে আগাম এই নির্বাচন দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে। ওই ব্রেক্সিট গণভোটে অন্যতম প্রধান একটি ইস্যু ছিলো অভিবাসন। এবারের নির্বাচনের প্রচারণাতেও প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোকে এবিষয়ে কথাবার্তা বলতে হচ্ছে। কিন্তু আগে দক্ষিণপন্থী ছাড়া বাকি রাজনীতিকরা বিষয়টি এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেছেন। বিশ্বের প্রাচীন গণতন্ত্রের এই দেশটির নির্বাচনে অভিবাসন কিভাবে ইস্যু হয়ে উঠলো? খোঁজ নিয়েছেন বিবিসির রুথ আলেকজান্ডার।
মাত্র ন’বছর বয়সে যুক্তরাষ্ট্রে চলে গিয়েছিলেন ক্যামিলা স্কোফিল্ড। মিজৌরির যে এলাকায় তিনি থাকতেন সেই এলাকা বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীতে বিভক্ত ছিলো। ফলে জাতিগত রাজনীতির কথা সবসময়েই তার মনে ছিলো। তারপর তোন একসময় তিনি ব্রিটেনে ফিরে আসেন। পেশা হিসেবে বেছে নেন গবেষণার। কারণ সেসময় এবিষয়টি নিয়ে খুব একটা লেখালেখি হয়নি। এখন তিনি ইস্ট এংলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ এক মুহূর্তের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, “১৯৪০-এর দশকের শেষ দিকে অভিবাসন নিয়ে কথাবার্তা শুরু হয়। তখনকার সবচেয়ে বিখ্যাত ঘটনা ছিলো – উইন্ডরাশ এম্পায়ার নামের একটি জাহাজে করে জ্যামাইকা থেকে পাঁচশোর মতো শ্রমিকের ব্রিটেনে আসা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিধ্বস্ত ব্রিটেনে তখন শ্রমিকের অভাব ছিলো। সেই শূন্যতা পূরণ করতে ব্রিটিশ সরকার তখন যেসব দেশে তাদের উপনিবেশ ছিলো, সেখান থেকে লোকজনকে আসার জন্যে আমন্ত্রণ জানালো। শুরু হয়েছিলো অল্পকিছু লোকজনের আসার মধ্য দিয়ে। কিন্তু ৫০ এর দশকের শেষ দিকে আসতে লাগলো হাজার হাজার শ্রমিক।
প্রথম এর বড়ো রকমের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ছিলো ১৯৫৮ সালের নটিং হিল দাঙ্গার ঘটনা। সেই দাঙ্গা থামাতে পুলিশ মোতায়েন করতে হয়েছিলো। তিনি জানান, ওই ঘটনা ছিলো এক শ্বেতাঙ্গ নারীকে কেন্দ্র করে। আফ্রো-ক্যারিবিয়ান এক পুরুষের সাথে তার সম্পর্ক ছিলো। তাদের উপর হামলা হলো একটি পানশালার বাইরে। সেখান থেকে কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর একের পর এক হামলার সূত্রপাত হলো।এই আক্রমণের জন্যে শ্বেতাঙ্গ গ্যাংগুলোকে তখন কঠোর সাজা দেওয়া হয়। সারা বিশ্বেই তখন যুক্তরাজ্যের উপনিবেশ ছিলো এরকম অনেক দেশ এক এক করে স্বাধীন হচ্ছিলো। আর ব্রিটেন তখন নিজেকে নবগঠিত কমনওয়েলথের প্রধান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছে।
ক্যামিলা স্কোফিল্ড বলেন, সদ্য স্বাধীন নতুন এই দেশগুলোর সাথে ব্রিটেনের যে টানাপোড়েনের সম্পর্ক তার সঙ্গে জড়িত ছিলো দেশটির অভিবাসন নীতি। কমনওয়েলথ দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক ভালো রাখার একটা আকাঙ্ক্ষাও ছিলো তাদের। ফলে বিদেশিরাও তখন প্রচুর সংখ্যায় আসতে থাকলো। ১৯৬৮ সালের ২০শে এপ্রিল। প্রখ্যাত এক ব্রিটিশ রাজনীতিক বার্মিংহামে কনসারভেটিভ পার্টি এসোসিয়েশনে ভাষণ দেন। তিনি ইনোক পাওয়েল। তিনি জানতেন তার বক্তব্য উত্তেজনার সৃষ্টি করবে। সেদিন তিনি বলেন, বছরে ৫০ হাজারের মতো মানুষ যারা অন্যের ওপর নির্ভরশীল তাদেরকে আসার অনুমতি দেওয়া হলে দেশ হিসেবে আমরা তো পাগল, আক্ষরিকভাবেই উন্মাদ হয়ে যাবো। মনে হচ্ছে, দেশটি তার নিজের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জন্যে চিতা সাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।”
মি. পাওয়েল এস্টাবলিশমেন্ট বা ক্ষমতা-কাঠামোর অংশ ছিলেন। তার এই ভাষণকে দেখা হলো এমন এক মুহূর্ত হিসেবে, যখন ক্ষমতাধরদের একজন এরকম সস্তা জনপ্রিয়তার ভাষায় কথা বললেন।। ব্রিটিশ রাজনীতিতে এর বড় রকমের এবং দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব পড়লো। তখন অভিবাসনের মতো ইস্যুর সাথে সরাসরি যুক্ত হলো জাতিগোষ্ঠীর মতো বিষয়। অর্থাৎ – অভিবাসনের বিষয়ে কথা বলা বর্ণবাদী বক্তব্যের মতো শোনাতে লাগলো। ক্যামিলা স্কোফিল্ড বলেন, তখন অভিবাসী বলতে বোঝাতো শুধু সংখ্যালঘু কৃষ্ণাঙ্গদের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দীর্ঘ এক ছায়া পড়লো এর উপর। জাতিগোষ্ঠীর প্রতি বৈষম্য, শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদ এর সবই ফ্যাসিবাদের সাথে সম্পর্কিত। তখন এমন এক ক্ষমতা-কাঠামো ছিলো যারা এ ধরনের রাজনীতি থেকে দূরে থাকতে চাইতো।
ইনোক পাওয়েলকে বর্ণবাদী বক্তব্য দেওয়ার একদিন পরেই তার পদ থেকে বরখাস্ত করা হয়। কিছু পরিবর্তন আনা হয় আইনে। লোকজন যাতে অবাধে আসতে না পারেন সেজন্যে আরোপ করা হয় বিধি নিষেধ। কিন্তু মূলধারার রাজনীতিকরা তখনও অভিবাসনকে রাজনীতির ইস্যু করেননি। কারণ তারা ভয়ে ছিলেন। কারণ তারা মনে করতে অভিবাসন নিয়ে রাজনীতি করা হলে খারাপ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে এবং তারা নিজেরাও বর্ণবাদী হিসেবে চিহ্নিত হতে পারেন। ইনোক পাওয়েল যা চেয়েছিলেন তার বক্তব্যের প্রভাব হলো ঠিক উল্টো। মি. পাওয়েল চেয়েছিলেন এটা নিয়ে কথাবার্তা হোক। ঠেকানো হোক অভিবাসীদের। কিন্তু তার বক্তব্যের পর অভিবাসন ইস্যু চলে গেলো রাজনৈতিক এজেন্ডার বাইরে।
লন্ডনে কুইন মেরি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক টিম বেইল রাজনীতি ও অভিবাসন বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, “আপনি যখন রাজনীতিবিদদের সাথে কথা বলবেন, তখন বুঝতে পারবেন যে এটি খুব স্পর্শকাতর বিষয়। দেখবেন অনেকেই এই বিষয়ে কথা বলতে গেলে খুব সতর্ক থাকেন। নিজেদের বাঁচিয়ে কথা বলেন।” ১৯৭০ এর দশকে রাজনীতিবিদরা অভিবাসনের মতো বিষয় এড়িয়ে চলতে লাগলেন। ইনোক পাওয়েলের ভাষণের ১০ বছর পর আরো একজন প্রখ্যাত রাজনীতিক এই বিষয়ে আবার মুখ খুললেন। তিনি কনসারভেটিভ পার্টির নতুন নেতা মার্গারেট থেচার।
১৯৭৯ সালে, নির্বাচনের আগে টেলিভিশনে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “লোকজন ভীত হয়ে পড়েছে যে এই দেশটি ভিন্ন সংস্কৃতির লোকজনে প্লাবিত হয়ে যেতে পারে। ফলে আপনি যদি বিভিন্ন জাতির মধ্যে সুসম্পর্ক চান তাহলে এধরনের লোকের সংখ্যার ব্যাপারে লোকজনের ভয় কমাতে হবে।” যেসব ভোটার অতি দক্ষিণপন্থী রাজনীতির দিকে তাকিয়ে ছিলেন, এই বক্তব্য দিয়ে মার্গারেট থেচার তাদের মন জয় করার চেষ্টা করলেন। তিনি চেষ্টা করেছিলেন ইনোক পাওয়েলের বিদ্বেষপূর্ণ সুর এড়াতে। কিন্তু তিনিও বিভাজনের সৃষ্টি করেন এবং সমালোচিত হন। কেউ বললেন যে মার্গারেট থেচারের বক্তব্য বর্ণবাদী। কেউ কেউ তার কথার সাথে একমত হলেন। আবার কেউ বললেন যে, তিনি বর্ণবাদী ভাষায় কথা বলছেন। সমালোচনার মুখে পড়ে মার্গারেট থেচার তখন এই অভিবাসন ইস্যুটি ত্যাগ করেন। তখন রাজনীতি থেকেও বিষয়টি উধাও হয়ে যায়। তারপর ১৯৯৭ সালে সরকারের পরিবর্তন ঘটলো। তখনও রাজনীতিকদেরকে অভিবাসন বিষয়ে খুব কিছু বলতে শোনা যায়নি।
ইতোমধ্যে অনেক কিছুর পরিবর্তন ঘটলো। প্রথমত, যুদ্ধ-কবলিত বিভিন্ন দেশ থেকে ব্রিটেনে আসা আশ্রয়প্রার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেলো। ঠিক তারপরই ঘটলো বড় একটা ঘটনা। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে যোগ দিলো আরো ১০টি দেশ। তারাও পেলো ইউনিয়নের যেকোনো দেশে বসবাস ও কাজ করার অধিকার। সরকার থেকে বলা হলো হয়তো সামান্য কয়েক হাজার লোক যুক্তরাজ্যে চলে আসতে পারে। কিন্তু মাত্র এক বছরেই পোল্যান্ড থেকে এলো ১৭ হাজার, লিথুয়ানিয়া থেকে ১০ হাজার, ৭ হাজার এলো স্লোভাকিয়া থেকে। সব মিলিয়ে ৫০ হাজার। এবং তারা আসতেই থাকলো। সরকার তখন সত্যি সত্যি বুঝতে পারলো লোকজনের কাছে যুক্তরাজ্য কতো জনপ্রিয় এক গন্তব্য হতে পারে।
বিরোধী কনসারভেটিভ পার্টির নেতা মাইকেল হাওয়ার্ড অভিবাসনকে ইস্যু করার সিদ্ধান্ত ছিলেন। তারা মনে করলেন, এবিষয়ে তাদের দল আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় জোরে কথা বলতে পারে। ২০০৫ সালের নির্বাচনে একটি পোস্টার ছাড়া হলো যার মূল বক্তব্য ছিলো – অভিবাসন নিয়ে কথা বলা বর্ণবাদী কিছু নয়। আমরা যা ভাবছি আপনিও কি সেটা ভাবছেন? বামপন্থী রাজনীতিকরা এই পোস্টারের তীব্র সমালোচনা করলেন। নির্বাচনে কনসারভেটিভ পার্টি জিততে পারলো না ঠিকই কিন্তু তাদের ভোট বাড়লো। তারা পরীক্ষা করে দেখলো যে, বিষয়টি আগের মতো আর ততোটা বিষাক্ত নয়। “প্রচুর সংখ্যায় শ্বেতাঙ্গ ইউরোপিয়ান ব্রিটেনে চলে এলো। এর ফলে রাজনীতিবিদদের জন্যে এবিষয়ে কথা বলা অনেক সহজ হয়ে পড়লো। কারণ তারা তখন অভিবাসনের ব্যাপারে উদ্বেগের মতো বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে পারছিলো। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে বর্ণবাদী আচরণের অভিযোগ উঠলো না।” কনসারভেটিভ দলের নতুন নেতা নির্বাচিত হলেন ডেভিড ক্যামেরন। তিনি বুঝতে পারলেন, অভিবাসন বিষয়ে কথা বলার ক্ষেত্রে দ্বিধা ঝেড়ে ফেলার এখনই সময়।
মার্গারেট থেচারের বক্তব্যের সাথে তিনিও একমত কীনা জানতে চাইলে মি. ক্যামেরন বললেন, “আমি ঠিক ওই ভাষা ব্যবহার করবো না। তবে আমি মনে করি, যে মাত্রায় অভিবাসীরা আসছে তাতে লোকজনের মধ্যে উদ্বেগ রয়েছে। ভিন্ন সংস্কৃতি বা ভিন্ন গাত্রবর্ণের লোকেরা আসছে বলে এই উদ্বেগ নয়। আমি মনে করি, লোকজনের উদ্বেগ হচ্ছে তারা যেসব সেবা পাচ্ছে সেটা নিয়ে। এর ফলে স্কুল, হাসপাতাল এবং আবাসনের উপর চাপ বাড়ছে।”
ডেভিড ক্যামেরন শেষ পর্যন্ত অভিবাসনের বিষয়ে রাজনীতিকদের নীরবতা ভেঙে দিলেন। উদারপন্থী সংবাদ মাধ্যমগুলোও তাকে প্রশংসা করলো। বিরোধীরা রইলো চুপ করে। বরং তারাও একই সুরে কথা বললো। প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের বাইরের দেশগুলো থেকে আসা অভিবাসন নীতিমালা আরো কড়া করলেন। তখন তার মুখে নতুন শ্লোগান শোনা গেলো- ব্রিটিশ লোকজনের জন্যেই ব্রিটিশ চাকরি। অভিবাসন প্রসঙ্গ উঠে এলো রাজনীতির এজেন্ডায়। সঙ্কোচ কেটে গেলো। মুখ খুলে গেলো ব্রিটিশ রাজনীতিকদের। জনগণের দিক থেকে চাপের মুখে পড়লো তারা। ডেভিড ক্যামেরন ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে বিবিসিকে বলেছিলেন, “নেট অভিবাসীর সংখ্যা আমরা কয়েক হাজারে দেখতে চাই, কয়েক লাখে নয়। তাদের সংখ্যা কতো হবে সেটার ওপর আমরা প্রত্যেক বছরেই একটা সীমা বেধে দেই।”
ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক রবার্ট ফোর্ড অভিবাসনের রাজনীতি নিয়ে গবেষণা করেছেন। বলছিলেন, গত ২০ বছরের অভিবাসন বিতর্কে এটাই ছিলো সম্ভবত সবচে তাৎপর্যপূর্ণ মুহূর্ত। কারণ ডেভিড ক্যামেরন বললেন, অভিবাসীর সংখ্যা এক লাখের নিচে নামিয়ে আনতে হবে। নেট মাইগ্রেশনের অর্থ হচ্ছে কতো লোক আসছে এবং কতো লোক চলে যাচ্ছে সেটার হিসেবে করে বের করা যে কতো লোক শেষ পর্যন্ত থেকে গেছে। রবার্ট ফোর্ড বলেন, “আমরা ঠিক জানি না গ্রস মাইগ্রেশনের কথা না বলে তারা কেনো নেট মাইগ্রেশনের কথা বললেন। কতো লোক ব্রিটেনে ছেড়ে চলে যাচ্ছে সেটা কিন্তু ভোটাররা দেখতে পায় না। কতো লোক আসছে সেটাই শুধু তারা দেখতে পারে।”
“অভিবাসনের বিষয়ে বলতে গিয়ে তখন নানা ধরনের পরিসংখ্যান তুলে ধরা হলো। বলা হলো কি এর অর্থনৈতিক লাভ ও ক্ষতি। পুরো বিতর্কটাই যেনো হয়ে উঠলো অ্যাকাউন্টিং এর একটা হিসেবের মতো। এর ভেতর থেকে আবেগের মতো বিষয় ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করা হলো।” সমস্যা হলো অভিবাসীদের ঠেকানোর জন্যে সরকারের হাতে কোনো উপায় ছিলো না। ইতোমধ্যে ই ইউর সদস্য সংখ্যা আরো বেড়ে গেলো। তখন রোমানিয়া এবং বুলগেরিয়া থেকে লোকজনের আসার ওপর সাময়িক নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হলো। কিন্তু সেটাও তুলে নেওয়া হলো ২০১৪ সালে। মি. ফোর্ড বলেন, সেসময় এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিলো যাতে নতুন একটা রাজনৈতিক দলের জন্যে সুযোগ সৃষ্টি হলো। ওই দলটির নাম ইউনাইটেড কিংডম ইন্ডিপেন্ডেন্স পার্টি, সংক্ষেপে ইউকিপ। এই দলটি নব্বইয়ের দশক থেকেই ব্রিটেনকে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে বের করে আনার পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছে। তখনও তারা জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেনি।
তিনি বলেন, “ইউকিপের ওপর আমি যখন বই লিখছিলাম তখন ওই দলের প্রধানের সাক্ষাতকার নিয়েছিলাম। তিনি বলেছিলেন, গত ১৫ বছর ধরে আমি ভোটারদের বোঝাতে চেষ্টা করছি যে ই ইউ থেকে বেরিয়ে আসা ছাড়া তারা অভিবাসন সমস্যার সমাধান দিতে পারবে না। তবে ক্যামেরনের প্রতিশ্রুতির পর এবিষয়ে ভোটারদের বোঝাতে আমাকে আর চেষ্টা করতে হয়নি। তারাই এর উপসংহার টেনে নিয়েছে।”
তারপরই তাদের প্রতি সমর্থন বাড়তে লাগলো। ব্রিটেনের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলো ইউকিপ। ইতোমধ্যে অভিবাসনও হয়ে উঠলো রাজনীতির কেন্দ্রীয় ইস্যুগুলোর অন্যতম। আর তখনই ব্রেক্সিট গণভোটে ভোটাররা ই ইউ থেকে বেরিয়ে আসার পক্ষে রায় দিলো। ৫২ শতাংশ ভোটার ভোট দিলেন ত্যাগের পক্ষে আর থেকে যাওয়ার পক্ষে ৪৮ শতাংশ। বলা হলো, এ এক ব্যতিক্রমী মুহূর্ত। এই সিদ্ধান্তের ফলে এখন সবকিছুই বদলে যেতে শুরু করবে।
ভোটারদের এই সিদ্ধান্তের পেছনে বড়ো ভূমিকা ছিলো অভিবাসন নীতি, যার পক্ষে জোর প্রচারণা চালিয়েছে ইউকিপ। রবার্ট ফোর্ড বলেন, “এটা হলো বাঘের পিঠের ওপর বসে থাকার মতো। আপনি বাঘটিকে একদিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন যে দিকটা অনেক বেশি যৌক্তিক, কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে বাঘটি সেদিকেই যেতে চাইবে।” যুক্তরাজ্যে এরকমই একজন অভিবাসী হলেন এরিক কাউফমান। তিনি বড় হয়েছেন ক্যানাডায়। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের বারবেক কলেজের একজন শিক্ষক। গবেষণা করেছেন অভিবাসনের বিষয়ে জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। তার মতে, ইস্যুটি ব্রিটিশ রাজনীতির কেন্দ্রে উঠে এলেও, এনিয়ে এখনও কিছু ট্যাবু রয়ে গেছে। তিনি মনে করেন, অভিবাসনের বিষয়ে লোকেরা যখন কথা বলে তখন তারা নিজেদের মতো অনেক কিছু ঠিক করে নেয়। তার মনে করে, নতুন যারা আসছেন তারা ঠিক আমাদের মতো নয়।
তিনি বলেন, “আমার মনে আছে, আমি একবার এক মহিলার সাক্ষাৎকার নিচ্ছিলাম। তিনি বলছিলেন, আমি ট্রামে করে যাচ্ছিলাম। দেখলাম কেউ ইংরেজি বলছে না। মনে হলো, আমি বিদেশে এসেছি। তখন একজন তার কথার প্রতিবাদ করলো। এবং তিনি তখনই তার কথা ঘুরিয়ে ফেললেন। বললেন, ওহ আমার নাতি নাতনিরা তো চাকরি পাবে না। ”রাজনীতিবিদরাও সংঘাত এড়ানোর জন্যে একই কৌশলে কথা বলতে লাগলেন। এটা যে শুধু ব্রিটেনেই তা কিন্তু নয়। বেশিরভাগ পশ্চিমা দেশেই এটা বড় ধরনের এক রাজনৈতিক সমস্যায় পরিণত হয়েছে। রাজনৈতিক বিতর্কে এই অভিবাসন নিয়ে এখনও রাজনীতিবিদরা খোলামেলা আলোচনা করেন না। তারা এর অর্থনৈতিক দিক নিয়ে কথা বলেন ঠিকই কিন্তু এর সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক মতপার্থক্যের মতো বিষয়ে কিছু বলেন না। বলেন না কারণ তারা এনিয়ে কথা বলতে ভয় পান।