ব্রিটেনে নির্বাচন : জয়ের সম্ভাবনা উজ্জ্বল তিন বাঙালি কন্যার
রুশনারা আলী, টিউলিপ রেজওয়ান সিদ্দিক ও রূপা হক
জুয়েল রাজ-
আজ (বৃহস্পতিবার) অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ব্রিটেনের সাধারণ নির্বাচন। এই নির্বাচনে বাংলাদেশি ১৫ জন প্রার্থী বিভিন্ন দল থেকে অংশ নিচ্ছেন। এবার বিজয়ী হওয়ার বেশ উজ্জ্বল সম্ভাবনা আছে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা তিন বাঙালি কন্যা রুশনারা আলী, টিউলিপ রেজওয়ান সিদ্দিক ও রূপা হকের।
নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী বাঙালি প্রার্থীরা হলেন— রুশনারা আলী (লেবার, বেথনাল গ্রীন অ্যান্ড বো আসন), টিউলিপ রেজওয়ান সিদ্দিক (লেবার, হ্যাম্পস্টেট অ্যান্ড কিলবার্ন), রূপা হক (লেবার, ইলিং সেন্ট্রাল ও একটন), আনোয়ার বাবুল মিয়া (লেবার, ওয়েলউইন অ্যান্ড হ্যাটফিলড), মেরিনা আহমদ (লেবার, বেকেনহাম), রওশন আরা (লেবার, সাউথ থেনেট), ফয়সল চৌধুরী এমবিই (লেবার, স্কইল্যান্ডের এডিনবারা সাউথ ওয়েস্ট), আবদুল্লাহ রুমেল খান (লেবার, পোর্টসমাউথ নর্থ), জুয়েল মিয়া ( লেবার পার্টি , লাফবরা) সাজু মিয়া (লিবডেম, ওয়াইর ফরেস্ট), আজমল মাশরুর (স্বতন্ত্র, বেথনাল গ্রিন অ্যান্ড বো), ওলিউর রহমান (স্বতন্ত্র, পপলার এন্ড লাইম হাউজ), আবু নওশাদ (স্বতন্ত্র, ইয়ার্ডলি, বার্মিংহাম), ব্যারিস্টার মির্জা জিল্লুর (স্বতন্ত্র, ইস্টহাম) ও আফজল চৌধুরী (ফ্রেন্ডস পার্টি, ইস্টহ্যাম)। এর বাইরেও লুটন সাউথ এলাকা থেকে আশুক আহমেদ নামে আরেক বাংলাদেশিকে মনোনয়ন দিয়েছিল লিবারেল ডেমোক্রেটিক দল। তবে ইহুদি-বিদ্বেষী মন্তব্য করায় সম্প্রতি তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়।
এদের মধ্য থেকে হ্যাট্রিক বিজয়ের পথে প্রথম ব্রিটিশ বাংলাদেশি এমপি রুশনারা আলী। আর দ্বিতীয় বারের মতো বিজয়ী হতে পারেন টিউলিপ সিদ্দীক ও রূপা হক। এর বাইরেও স্কটল্যান্ড থেকে প্রথমবারের মত কোন বাঙালি প্রার্থী হিসাবে ফয়সল চৌধুরী এমবিই’র উজ্জ্বল সম্ভাবনা আছে বিজয়ী হওয়ার। আর লাফবরা থেকে জুয়েল মিয়ারও বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা উজ্জ্বল বলে জানিয়েছেন সেখানকার এক বাঙালি ভোটার মেসবাউর রহমান বাবলু।
মধ্যবর্তী নির্বাচন ঘোষনার সময় টোরি পার্টির সাথে লেবারের জনপ্রিয়তার ব্যবধান ছিলো ২৪ শতাংশ। গত এক মাসে নানা ঘটনা, প্রতিশ্রুতির মারপ্যাচে এই ব্যবধান কমে দাড়িয়েছে ১ শতাংশে! ঈর্ষনীয় জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে লেবার লিডার জেরেমি করবিনের! তরুন ভোটারদের একটি বড় অংশ জেরেমি করবিনের প্রতি তাদের সমর্থন জানিয়েছেন।
তাই নির্বাচন বিশ্লেষকদের ধারণা, মূলধারার জরিপে সব জায়গাই ঝুলন্ত সরকারের কথা বলা হচ্ছে। একই সাথে এই ঝুলন্ত সরকার লেবারকে সামনে রেখেই করা হবে বলেও বলছেন অনেকে। কার্যত ১ মাস আগে টেরিজা মে ড্রাইভিং সিটে বসে নির্বাচনের যে গাড়ি ছেড়েছিলেন নাম্বার ১০ ডাউনিং ষ্ট্রিটের দিকে, সময়ের ফেরে সেই গাড়ির চালকের আসনে এখন জেরেমি করবিন। তবে সকল জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটবে বৃহস্পতিবার ব্যালটের বাক্সে। শুক্রবার সকালেই আসলে বলা যাবে ব্রিটেনের আগামী দিনের কান্ডারী কে হবেন।
তিন মাস আগেও জরিপে অনেক বড় ধরনের ব্যবধান ছিল থেরেসা মে আর করবিনের মধ্যে। তবে সবশেষ প্রকাশিত এক জরিপের তথ্য বিশ্লেষণ করে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, ওই ব্যবধান কমিয়ে থেরেসার একেবারের কাছাকাছি চলে এসেছেন করবিন। গত মাসে লেবার পার্টির চেয়ে ১৬ পয়েন্টে এগিয়ে থাকার সুবিধা হারিয়েছে কনজারভেটিভরা। সারভশেনের একটি জরিপে দেখা যায়, এখন কনজারভেটিভদের রেটিং পয়েন্ট ৪১.৫ শতাংশ এবং লেবারের পয়েন্ট ৪০.৪ শতাংশ। লিবারেল ডেমোক্রেটদের পয়েন্ট ৬ এবং ইউকেআইপি এর পয়েন্ট ৩ শতাংশ।
এদিকে, ইউগভ পূর্বাভাস দিয়েছে, বৃহস্পতিবারের নির্বাচনে কনজারভেটিভরা ৩০৪টি সিট জয় করতে পারে, যা গতবারের চেয়ে ২৬টি কম। তাদের কনস্টিটিউন্সি বাই কনস্টিটিউন্সি মডেলে আরও দেখা যায়, লেবার পার্টির ২৬৬টি আসন জয়ের সম্ভাবনা আছে, যা গতবারের তুলনায় ৩৭টি বেশি। স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টি জিতবে ৩৬টি (৮টি কম) এবং লিবারেল ডেমোক্রেটদের সম্ভাবনা ১২টি আসন (৩টি বেশি)। এমন অবস্থায় কোনও দলই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না। কারণ, এজন্য প্রয়োজন ৩২৩টি আসন।
১২ দিনের ব্যবধানে দুইটি সন্ত্রাসী হামলার পর ব্রিটেনের রাজনৈতিক দলগুলো ‘জঙ্গিবাদ’ আর ‘নিরাপত্তা’ ইস্যুকে শেষ মুহূর্তের প্রচারণার অস্ত্র করেছে। আগামীকাল ৮ জুন দেশটিতে পার্লামেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। সবশেষ পরিচালিত এক জরিপের ফলাফল অনুযায়ী, কনজারভেটিভ প্রার্থী থেরেসা মে’র সঙ্গে লেবার নেতা জেরেমি করবিনের হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হতে যাচ্ছে নির্বাচনে। ওই জরিপ একটি ঝুলন্ত পার্লামেন্টের আভাস দিয়েছে।
৩ মাসে সংঘটিত ৩টি জঙ্গি হামলার প্রেক্ষাপটে শেষ মুহূর্তের প্রচারণায় প্রধান প্রধান দলগুলো জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে একে অন্যের দুর্বলতা খুঁজতে ব্যস্ত। মধ্যবর্তী এই নির্বাচনটি মূলত ছিল ব্রেক্সিট বাস্তবায়নে জনগনের ম্যান্ডেট অর্জনের নির্বাচন। কৌশলী ব্রেক্সিট বাস্তবায়নে থেরেসা মে’র কনজারভেটিভ পার্টিকেই এখনও শ্রেয়তর মনে করে বেশিরভাগ ব্রিটিশ। নির্বাচনেও শুরুতে দেশটির মূলধারার মিডিয়ায় কনজারভেটিভ সমর্থনের আধিপত্য দেখা গেছে। ধারাবাহিক জঙ্গি হামলার পর সেই সেই সমর্থন আরও জোরালো হতে শুরু করে।
ম্যানচেষ্টারে বোমা হামলার ঘটনা আজীবন যুদ্ধবিরোধী করবিনের ভোটে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে ধারণা ছিল। ওই হামলার কারণে তিনদিন বন্ধ ছিল নির্বাচনী প্রচার। কিন্তু শুক্রবার জাতীয় নিরাপত্তা প্রশ্নে নিজের অবস্থান তুলে ধরেই প্রচারে নামেন করবিন। বিদেশে যুদ্ধে জড়ানোর কারণে যুক্তরাজ্যে সন্ত্রাসী হামলার ঝুঁকি বেড়েছে জানিয়ে তিনি পররাষ্ট্রনীতি বদলের ঘোষণা দেন। এতে ক্ষমতাসীনরা হামলে পড়ে করবিনের সমালোচনায়। প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে বলেন, ম্যানচেস্টারে হামলার দায় করবিন যুক্তরাজ্যের কর্মের ফল বলতে চাইছেন।
এদিকে, টেলিগ্রাফের সঙ্গের সাক্ষাৎকারে মে জঙ্গিবাদের ব্যাপারে জিরো টলারেন্স নীতি নেওয়ার পরিকল্পনা জানিয়েছেন। আর প্রচারণার শেষ মুহূর্তে থেরেসা মে একধাপ এগিয়ে সবকিছুকে ছাপিয়ে ইসলামী জঙ্গিবাদকে উপজীব্য করেন। প্রয়োজনে মানবাধিকার আইনে পরিবর্তন এনে জঙ্গিদের শায়েস্তা করবেন বলে প্রচারণার শেষ মুহূর্তে প্রতিশ্রুতি দেন তিনি। অপরদিকে লেবার লিডার করবিন বলছেন, ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসকে বাঁচাতে আর মাত্র ২৪ ঘন্টা সময় আছে। তিনি বৃহস্পতিবার লেবারকে ভোট দিয়ে সরকারে নিয়ে আসার জন্য সবাইকে অনুরোধ জানাচ্ছেন।
সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে মোকাবিলায় প্রয়োজনে মানবাধিকার আইন পরিবর্তনের ঘোষণা দিয়েছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে। মঙ্গলবার নির্বাচনী প্রচারণায় দেওয়া এক ভাষণে তিনি এ ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, যদি কোনও সন্দেহভাজনকে আমাদের হুমকি মনে হয় কিন্তু বিচারের জন্য যথেষ্ট প্রমাণ না থাকে, তবে অবশ্যই তিনি আমাদের নজরদারিতে থাকবেন। এক্ষেত্রে মানবাধিকার আইন বাধা হয়ে দাঁড়ালে প্রয়োজনে আইন পরিবর্তনেরও কথা বলেন মে। লন্ডন ব্রিজের হামলার ধাক্কা সামলিয়ে শেষ মুহুর্তের প্রচারণায় ব্যস্ত ব্রিটেনের রাজনৈতিক দলগুলো। শেষ মূহুর্তের প্রচারণায় টোরি পার্টির প্রধান টেরিজা মে বলেছেন, ব্রেক্সিট ব্রিটেনের জন্য প্রচুর চাকুরী, বাড়ি ও ভালো পরিবহন সুবিধা তৈরি করে দিবে। এজন্য বৃহস্পতিবার কনজারভেটিভকে আবারো ভোট দিয়ে নির্বাচিত করা প্রয়োজন।
এছাড়া সন্ত্রাসবাদে অভিযুক্তদের সাজার মেয়াদ বাড়ানোর পক্ষেও নিজের অবস্থনের কথা ব্যক্ত করেন তিনি। তিনি বলেন, হুমকি মোকাবেলায় আমরা চাই, পুলিশ ও গোয়েন্দারা তাদের সর্বোচ্চ ক্ষমতা প্রয়োগ করতে সক্ষম হোক। আমি নতুন কোনও নীতির ঘোষণা করবো না। তবে বিদেশি সন্দেহভাজন সন্ত্রাসীদের আমরা অবশ্যই দেশে ফেরত পাঠাবো। তিনি বলেন, আমি যদি বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হই, তবে শুক্রবারই অনেক পরিবর্তন আসতে শুরু করবে। বৃহস্পতিবারের নির্বাচনে জয়ী কোনও দলের এককভাবে সরকার গঠন করতে হলে অন্তত ৩২৬টি আসন পেতে হবে। ৬৫০ আসনের ব্রিটিশ পার্লামেন্টে গত নির্বাচনে কনজারভেটিভরা পেয়েছিল ৩৩০ আসন। লেবার পার্টি জিতেছিল২২৯ টি।