প্রায় সাত বছর ধরে সন্তান হারানোর যন্ত্রণা নিয়ে প্রতিনিয়ত দগ্ধ হচ্ছেন সিলেটের বিজ্ঞানবিষয়ক লেখক ও ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশের (৩২) মা পীযূষ রানী দাশ। বুধবার তার ছেলেকে হত্যার দায়ে চারজনের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত। বার্ধক্যের কারণে ও শারীরিক অসুস্থতা বিবেচনায় রায়ের বিষয়টি বুধবার বিকেল পর্যন্ত পীযূষ রানীকে (৬৫) জানানো হয়নি। অনন্তের বড় ভাই রত্নেশ্বর দাশ বলেন, ‘মায়ের বয়স হয়েছে। সারাক্ষণ অনন্তের চিন্তা করেন। তাই রায়ের পরপরই বিষয়টি তাকে জানাইনি। ধীরে ধীরে জানাব। আর ভাইকে হারিয়েছি, সেই ভাইয়ের শূন্যতা কোনোভাবেই পূরণ হবে না। গত সাত বছর ভাই হারানোর বেদনা নিয়ে কীভাবে বেঁচে আছি, তা শুধু আমরাই জানি।’ রায়ের প্রতিক্রিয়ায় রত্নেশ্বর দাশ বলেন, ‘আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে এ বিষয়ে আমরা পরবর্তী সিদ্ধান্ত জানাব।’
এদিকে অনন্তের বড় বোনের স্বামী ও সিলেট কর আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক সমর বিজয় সী শেখর বলেন, ছেলে খুন হওয়ার পর অনন্তের বাবা রবীন্দ্র কুমার দাশ অসুস্থ হয়ে পড়েন। ২০১৯ সালে তিনি মারা যান। আজ রায় ঘোষণা হয়েছে। এখন দ্রুত এই রায় কার্যকর হোক। এর আগে বুধবার বেলা পৌনে একটার দিকে সিলেটের সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালের বিচারক নুরুল আমীন বিপ্লব সিলেটের বিজ্ঞানবিষয়ক লেখক ও ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশ হত্যা মামলায় চার আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন। এ ছাড়া একজনকে আদালত খালাস দিয়েছেন। ছয় আসামির মধ্যে অপর এক আসামি মারা যাওয়ায় তাঁকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
মৃত্যুদণ্ড পাওয়া চার আসামি হলেন সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার আবুল হোসেন (২৫), খালপাড় তালবাড়ির ফয়সাল আহমদ (২৭), সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের বীরেন্দ্রনগরের (বাগলী) মামুনুর রশীদ (২৫) ও কানাইঘাটের ফালজুর গ্রামের আবুল খায়ের রশীদ আহমদ (২৫)। এ ছাড়া সিলেট নগরের রিকাবীবাজার এলাকায় বসবাসকারী সাফিউর রহমান ওরফে ফারাবী সাফিউর রহমান (৩০) নামের এক আসামি খালাস পেয়েছেন।
ছয় আসামির মধ্যে ২০১৭ সালের ২ নভেম্বর কানাইঘাটের পূর্ব ফালজুর গ্রামের মান্নান ইয়াইয়া ওরফে মান্নান রাহী ওরফে এ বি মান্নান ইয়াইয়া ওরফে ইবনে মঈন (২৪) কারাগারে থাকা অবস্থায় হঠাৎ অসুস্থ হয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। মারা যাওয়ায় তাকে মামলা থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন আদালত। তবে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া তিন আসামি আবুল হোসেন, ফয়সাল আহমদ ও মামুনুর রশীদ পলাতক। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের ২০ হাজার টাকা করে জরিমানাও করা হয়েছে। সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালের সরকারি কৌঁসুলি মুমিনুর রহমান চার আসামির মৃত্যুদণ্ড এবং একজনের খালাস পাওয়ার বিষয়টি গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছেন।
বাদীপক্ষের আইনজীবী মোহাম্মদ মনির উদ্দিন বলেন, নৃশংসভাবে অনন্তকে হত্যা করা হয়েছে। এ জন্য মৃত্যুদণ্ডই সর্বোচ্চ শাস্তি। তবে ফারাবীকে কেন আদালত খালাস দিয়েছেন, সেটা পূর্ণাঙ্গ রায় হাতে পাওয়ার পর বোঝা যাবে। পূর্ণাঙ্গ রায় হাতে পেয়ে অনন্তের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। অন্যদিকে, আসামিপক্ষের আইনজীবী হিসেবে দায়িত্ব পালন করা আবদুল আহাদ জানান, এ রায়ের বিরুদ্ধে তারা আপিল করবেন। ২০১৫ সালের ১২ মে সিলেট নগরের সুবিদবাজারে নূরানী আবাসিক এলাকার নিজ বাসার সামনে খুন হন অনন্ত। পেশায় ব্যাংকার অনন্ত বিজ্ঞান বিষয়ে লেখালেখির পাশাপাশি ‘যুক্তি’ নামে বিজ্ঞানবিষয়ক একটি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। এ ছাড়া বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন তিনি।
হত্যাকাণ্ডের পর অনন্তের বড় ভাই রত্নেশ্বর দাশ বাদী হয়ে সিলেট মহানগরের বিমানবন্দর থানায় অজ্ঞাতনামা চারজনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা করেন। এতে বিজ্ঞান বিষয়ে লেখালেখির কারণে অনন্তকে ‘উগ্র ধর্মান্ধ গোষ্ঠী’ পরিকল্পিতভাবে খুন করেছে বলে অভিযোগ করা হয়। যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে গণজাগরণ মঞ্চের উত্তাল আন্দোলনের মধ্যে ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দারকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ওই ঘটনার পর ধারাবাহিকভাবে জঙ্গি হামলার শিকার হতে থাকেন লেখক, ব্লগার, প্রকাশক, সমকামী অধিকারকর্মীরা।
মুক্তমনা ও সামওয়্যার ইন ব্লগে নিয়মিত লেখালেখি করতেন অনন্ত। পাশাপাশি তিনি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকেও সক্রিয় ছিলেন। গণজাগরণ মঞ্চ প্রতিষ্ঠার পর থেকেই তিনি সিলেটের গণজাগরণ মঞ্চের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন। অনন্ত শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে পূবালী ব্যাংকের জাউয়াবাজার শাখায় চাকরি করতেন। দুই ভাই ও দুই বোনের পরিবারে অনন্ত সবার ছোট ও অবিবাহিত ছিলেন। অভিজিৎ হত্যাকাণ্ড নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে অনন্ত একাধিক লেখা লিখেছিলেন। অভিজিতের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। তাদের মূল বাড়ি সুনামগঞ্জে হলেও অনন্তের জন্ম ও বেড়ে ওঠা সিলেট শহরেই। পরিবারের সদস্যরা সুবিদবাজার নূরানী এলাকায় বসবাস করেন।
সংবাদ টি পড়া হয়েছে :
১৫৭ বার