ভাব বিলাসী মুহাম্মদ আব্দুল হাই—সুখেন্দু সেন
সুখেন্দু সেন:-আব্দুল হাই, গোলাপ মিয়া, হাছন পছন্দ বিভিন্ন নামে পরিচিত তিনি। আমি যখন উনার কোন নামই জানতাম না তখন আমার কাছে উনি পরিচিত ছিলেন চন্দ্রগুপ্ত নামে। সুঠাম দেহ, অবয়বে ব্যক্তিত্বের প্রখর প্রতিভাস, দৃঢ় ঋজু এ মানুষটি সুপ্রাচীন মৌর্য সম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য রূপেই প্রতিভাত হয়েছিলেন কোনো এক কালে আমার সচেতন বা অবচেতন মনে এবং সে আসনে স্থায়ী ছিলেন দীর্ঘদিন। বিগত শতকের ষাটের দশকের গোড়ায় শহর প্রাথমিক বালিকা বিদ্যালয়ের শ্রেণী বিভাজনের বাঁশের বেড়া খুলে লম্বা হল ঘর তৈরী করে মঞ্চস্থ হয়েছিলো দ্বিজেন্দ্র লাল রায়ের সর্বশেষ রচিত ঐতিহাসিক নাটক চন্দ্রগুপ্ত। আমার মেজোকাকা ধীরেন্দ্র লাল সেনও সে নাটকের একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। সেই সুবাদে পরিবারের কয়েকজনের সাথে কনিষ্ঠ দর্শক হিসেবে অপার কৌতুহলে আমারও উপস্থিতি । হ্যাজাক বাতির চোখ ধাঁধানো আলোয় ততোধিক ঝলসানো স্বর্ন রৌপ্য খচিত পরিচ্ছদ, মস্তকে কারুকার্যময় মুকুট, কটিতে খাপ বন্দী তরবারি সহ মৌর্য সম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যকে মঞ্চে প্রত্যক্ষ করেছিলাম বিষ্ময় আবিভূত চক্ষে । সে ঘোর কাটতে অনেক দিন লেগেছিলো, যতদিন না জানতে পেরেছি তিনি গান্ধার থেকে বঙ্গ পর্যন্ত বিস্তৃত মৌর্য সম্রাজ্যের অধিপতি নন। কিন্ত ততদিনে জেনে গেছি তিনি সুরমা তীরের আরেক মুকুট হীন সম্রাট, যার বিশাল সেনাবাহিনী ছিলো না, ছিলো না বিপুল রত্নভান্ডার, ছিলো না অগুনতি হাতী ঘোড়ার বহর, তবে ছিলো বহুমুখি প্রতিভা। ছিলেন একজন মেধাবী ছাত্র, একজন সচেতন রাজনীতিক, একজন সাংস্কৃতিক সংগঠক, একজন সাহিত্য প্রেমী, একজন শিক্ষানুরাগী, আদর্শ শিক্ষক, একজন কবি, একজন সাংবাদিক -সম্পাদক -প্রকাশক। একজন শক্তিশালী অভিনেতা, একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিক, সর্বোপরী একজন ভাব বিলাসী উদার মনের মানুষ, তিনি মুহাম্মদ আব্দুল হাই।
আমার সেই বিস্ময়ের চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের মত বাস্তবের আব্দুল হাই এর সম্রাজ্যও ছিলো বিশাল বিস্তৃত। চিত্তের বিত্তে তিনি ছিলেন মহারাজা। প্রখর প্রতিভায় ছিলেন একজন দীপ্তিময় খাটি মানুষ। একজন সব্যসাচি পুরুষ যাঁর ৫৬ বছরের সংক্ষিপ্ত জীবনে ঘটেছিলো বিচিত্র গুণাবলী ও বহুমুখী প্রতিভার সমন্বয়, সেও বাস্তবিক অর্থে আরেক বিস্ময় বৈকি। ছাত্র জীবনের সূচনা থেকেই তাঁর প্রখর মেধা ও প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়। এগারো বছর বয়সে প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করে সমগ্র আসাম প্রদেশের মধ্যে মেধা তালিকায় প্রথম স্থান অধিকার করে অনন্য কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। ১৯৪৮ সালে জুবিলী উচ্ছ বিদ্যালয় থেকে মেট্রিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ন হন, তখনকার সময়ে যা ছিলো নিতান্তই দুর্লভ। সুনামগঞ্জ কলেজ থেকে উনিশো পঞ্চাশে আই এ পরীক্ষায় উত্তীর্ন হয়ে ভর্তি হন সিলেটের ঐতিহ্যবাহী এম,সি কলেজে। স্নাতক পরীক্ষায় স্বাভাবিক ভাবেই আরেকটি সাফল্যের খবর দিয়ে শেষ করা যেতো ছাত্র জীবনের সংক্ষিপ্তসার। মেধাবী হিসেবে তাঁর কৃতিত্বের আলাপ এতটুকুই যথেষ্ট ছিলো। কিন্তু তিনি যে আব্দুল হাই। ব্যতক্রমী জীবন ধর্মানুসারী।
ভালো ছাত্র হিসেবে সকাল সন্ধ্যা বইপত্রে মুখ গুজে থাকার পাত্রটি তিনি নন। বায়ান্নোর মাতৃভাষা আন্দোলের ডাক পৌঁছে গেছে। মনোজগতের আলোড়ন উপেক্ষা না করে সেই ভালো ছাত্রটি সক্রিয় হয়ে উঠেন ভাষা আন্দোলনে। এর আগে সিলেটে গঠিত অসাম্প্রদায়িক ছাত্র সংগঠন সিলেট ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি নির্বাচিত হয়ে গেছেন তিনি। স্বাভাবিক ভাবে এবং কার্যতই সিলেট জেলার ভাষা আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য নেতৃত্ব ও অবদান ছিলো আব্দুল হাই সাহেবের। চুয়ান্নো সালে বিএ পরীক্ষার পূর্বমুহূর্তে গ্রেফতার হয়ে হারাতে হয় ছাত্রত্ব। রহিত হয় পরীক্ষা দানের সুযোগ। কিন্ত তিনি যে অন্য ধাতুতে গড়া। দমে যাওয়ার নয়। পরবর্তী সময়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে পরীক্ষা দিয়েই ডিস্টিংশন সহ বি,এ পাস করেন। তবে সেসময়ে শুধু পড়াশুনা নয়, পরীক্ষা দেয়ার অধিকার আদায়ে লড়াই করতে হয়েছে অতিরিক্ত দুই বছর। পরে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্ত ছাপ্পানো সনে দেশজুড়ে যখন দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে আর্ত মানবতার সেবায় ছুঠে আসেন জন্মস্থান সুনামগঞ্জে। ক্ষুধার্ত মানুষের মুখে অন্ন তুলে দিতে খুলা হয় কয়েকটি লঙ্গরখানা। সুনামগঞ্জ ত্রাণ কমিটির সম্পাদক ছিলেন কমরেড বরুণ রায়। রাজনৈতিক কারনে তিনি গ্রেফতার হয়ে গেলে আব্দুল হাই সাহেব লঙ্গর খানা পরিচালনার দায়িত্ব পালন করে গেছেন নিরলস নিষ্ঠায়।
জীবনের পরতে পরতে এই মানুষটি রেখে গেছেন অধ্যবসায়, শ্রম, নিষ্ঠা, মেধার এক অমলিন স্বাক্ষর। সোনার চামুচ মুখে নিয়ে জন্ম নেন নি তিনি কিন্তু নিজেই ছিলেন এক পরশ পাথর। সুনামগঞ্জের রাজনীতি, সমাজনীতি, সাহিত্য সংস্কৃতি, সাংবাদিকতা তাঁর ছোঁয়ায় স্বর্নদ্যূতি ছড়িয়েছে। প্রত্যন্ত এ মহকুমা শহর আলোকিত করে রেখেছিলেন বিভিন্ন সাংস্কৃতিক উৎসব আয়োজনের সফল আয়োজনে। উৎসবকে কেন্দ্র করে দেশের বরণ্য জ্ঞানী গুনী দের আগমন ঘটেছে এই প্রান্তিক জল জ্যোছনার শহরে, কবিতা গানের ভাব নগরে। পত্রিকা প্রকাশনা শুরু করেন ১৯৫৬ সাল থেকে। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন এক গ্রাম্যশহর থেকে নিয়মিত পত্রিকা প্রকাশ ছিলো নিতান্ত দুরূহ। বিপুল জনপ্রিয়তা নিয়ে দেশের দাবী নামের সাপ্তাহিকীটি দু’বছর টিকেছিলো। আটান্নো সালে সামরিক আইন জারী হলে তা বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তী কালে সাপ্তাহিক সুরমা’র সম্পাদক এবং স্বাধীনতার পর দেশের কথা ও সূর্যের দেশ নামে দু’টি পত্রিকার সম্পাদক প্রকাশক ছিলেন তিনি। এ সাপ্তাহিকীগুলি সময়ের অভ্রান্ত দলিল এবং কালের সাক্ষী হয়ে আছে।
সুরমা পত্রিকার প্রথম বর্ষে আমার একটি কবিতা যখন প্রথম ছাপার অক্ষরে মুদ্রিত হয়ে গেছে তখনও উনার সঙ্গে আমার সাক্ষাত ঘটেনি। কঁচি কাঁচার মেলার এক অনুষ্ঠানে মনোজগতে আসীন চন্দ্রগুপ্তের সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের দিনটি ছিলো আরো দু’তিন বছর পর। বাস্তবের সম্রাটের সঙ্গে প্রথম দর্শনই বুঝিয়ে দিয়েছিলো মানুষটি সাধারন নন। পরবর্তী সময়ে এ ধারণাই আরো প্রতিষ্ঠা পেয়েছে যখন দেখেছি তিনি আড়ালে থেকে অন্যদেরকে আলোকিত করার চেষ্টা করছেন, নিজে পেছনে থেকে অন্যদেরকে সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করতেন। এমন বিরল গুন অনেক খ্যাতিমানদের মাঝেই খুঁজে পাওয়া যায় না। বাস্তবিক অর্থে নিজের সর্বস্ব দিয়ে তিনি সুনামগঞ্জকে, সুনামগঞ্জের গৌরবকে তুলে ধরার শ্রমনিষ্ঠ এবং একাগ্র প্রয়াস চালিয়ে গেছেন। আপনার মনে গন্ধবিধূর ধুপের মতই নিজেকে উজার করে বিলিয়ে দিয়েছেন। ছাত্রাবস্থা থেকেই রাজনীতি সচেতন মানুষটি পরিনত সময়ে রাজনীতির প্রতি তেমন আগ্রহী ছিলেন না। কিন্তু দেশের প্রতি দায় এড়িয়ে যাননি কোনো দিন। সম্ভবত শিক্ষকতা, সাংবাদিকতা ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে নিজেকে ব্যপৃত রাখতেই অধিক স্বাচ্ছ্যন্দ বোধ করতেন। প্রথমে পাকিস্তান আন্দোলনের কর্মী, ছাত্র ইউনিয়নের সিলেট জেলা সভাপতি, অতপর যুবলীগ এর সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে আওয়ামী লীগের রাজনীতি। সুনামগঞ্জ মহকুমা আওয়ামী লীগের তিনি ছিলেন প্রথম সম্পাদক। ৬৪তে বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে তিনি দ্বিতীয় বারের মত অাওয়ামী লীগের সম্পাদকের দায়িত্ব পান বলে জানা যায়। ছয়দফা আন্দোলন, উনসত্তরের গন আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁর রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের একজন নিবেদিত প্রাণ সংগঠক। প্রতিরোধ যুদ্ধের চুড়ান্ত প্রস্ততি লগ্নে একাত্তরের ২৪ মার্চ স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গঠন এবং মুক্তিযুদ্ধের আহ্বান জানিয়ে জনমত নামে একটি বুলেটিন প্রচার করেন যার প্রধান শিরোনাম ছিলো- বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাটি বুঝে নিক দুর্বৃত্ত।
মুক্তিযু্দ্ধ চলাকালে সংগ্রাম পরিষদের অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সংগে সীমান্ত পেরিয়ে তিনি বালাটে অবস্থান নেন। বালাট মইলামে তখন শরণার্থীর স্রোত। শরণার্থী জীবন কোথাও আয়েশী নয়। দুঃখ কষ্ট স্বীকার করেই মানুষ বাধ্য হয়ে নিজভূম ত্যাগ করে ভিন্ দেশে আশ্রয় নেয়। পশ্চিম বঙ্গ, ত্রিপুরাতেও বিপুল শরণার্থী সমাগম। তাদেরও দূর্গতির অন্ত নেই। মরছে রোগে শোকে। তবে কোলকাতা, আগরতলার প্রতি দৃষ্টি ছিলো বহির্বিশ্বের। বিদেশী সাংবাদিক, পর্যবেক্ষক, সাহায্য সংস্থা, সামাজিক সংগঠন, রাজনৈতিক দল, ভারতীয় মন্ত্রী, সাংসদ, মুজিব নগর সরকারের মন্ত্রী, প্রতিনিধিদের আনাগোনা ছিলো সর্বত্র। প্রচার মাধ্যমেও ঠাঁই পেয়েছে পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরার শিবিরগুলি। সে তুলনায় খাসিয়া জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত শিবিরগুলি ছিলো বিচ্ছিন্ন। মুজিবনগর,কোলকাতার সাথে যোগাযোগও ছিলো অনেক কষ্টসাধ্য সময় সাপেক্ষ। পাহাড়ের আড়ালেই পড়ে রয়েছিলো এই বিপন্ন জনগোষ্ঠি। শরণার্থী সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে বিপর্যস্থ মানুষের জীবন রক্ষায় সংগ্রাম পরিষদের নেতারা প্রথমে শরণার্থী শিবিরের দায়িত্ব নেন। আব্দুল হাই সাহেবের উপর ন্যস্ত হয় তথ্য ও প্রচারের দায়িত্ব। পরবর্তী সময়ে বালাট ,সেলা, টেকেরহাট সাব-সেক্টর গঠিত হলে মুক্তি বাহিনীর গুরুত্ব পূর্ন অভিযান ও সাফল্যের সংবাদ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র,আকাশবানী সহ বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রেরণ করার দুসাধ্য কর্মটি তিনি সাফল্যের সাথে সম্পাদন করে গেছেন। এছাড়াও তিনি যোগাযোগ রক্ষা করতেন ভারতীয় অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ও আধিকারিকদের সঙ্গে।
শরণার্থী শিবির পরিদর্শনে আসা ভারতের কেন্দ্রীয় ত্রাণ মন্ত্রী আর,কে খাদিলকারের সাথে সাক্ষাত করে শরণার্থীদের দুঃখ দুর্দশার কথা তুলে ধরেন তিনি। শরণার্থী কর্মসূচির কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী পি.এন লুথারা এসেছিলেন শরণার্থী শিবির পরিদর্শনে। মইলামে তখন খুব খারাপ অবস্থা। কলেরা, রক্ত আমাশয়, অপুষ্টিতে প্রতিদিন মরছে শত শত মানুষ। ভয়াবহ এক মানবিক দুর্যোগ। সেনা বাহিনীর এই সাবেক কর্মকর্তা পি,এন,লুথারা বাস্তবিক অর্থেই এই বিশাল দায়িত্ব নিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। তার নিজের ভাষায়- দশ দিনের জন্য ত্রান কর্মসূচি প্রনয়ন করা হয়, তিন দিন যেতে না যেতেই শরণার্থীর সংখ্যা দ্বিগুন হয়ে যায়। মাথা ঠিক থাকে কি করে। মহামারীতে প্রতিদিন শতশত মানুষ মারা যাচ্ছে, বাঁচানোর কোনো উপায় নেই। ঔষধপত্র খাদ্য সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, অবস্থা নিয়ন্ত্রনের বাইরে, এমন খবর পেয়ে সরেজমিনে দেখতেই মাথা গরম মানুষটির এখানে আসা। বালাটে এসে তিনি খুব খারাপ অবস্থা দেখলেন না। চোখের সামনে ভালো কাপড় চোপড় পরিহিত লোকজনদেরও দেখতে পেলেন। প্রকৃত অর্থে বালাটে সুনামগঞ্জ শহরের লোকজনই বেশী আর মইলামের চেয়ে তুলনামূলক ভালো অবস্থা । এমন অবস্থায় বিভ্রান্তিকর রিপোর্ট প্রেরণের জন্য কর্মকর্তাদের উপর চড়াও হলেন । তাঁকে থামায় কে। এগিয়ে এলেন আব্দুল হাই। বুঝাবার চেষ্টা করলেন।
কাগজে কলমে বালাট ক্যাম্প প্রথমে প্রতিষ্টিত হলেও এর বর্ধিত অংশ মাইলাম পাহাড়ি নদীর পশ্চিম পাড়ে বিস্তৃত হয়ে বালাটের চেয়ে কয়েকগুন বড় হয়ে গেছে। চারলক্ষের মত শরণার্থী। মাইলামসহ বালাট শরণার্থী শিবির অনেক ক্ষেত্রে কেবল বালাট নামেই পরিচিত ছিলো। বালাট- মইলাম পরিচয় বিভ্রাটের অবসান ঘটলো। আব্দুল হাই সহ অন্যান্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়ে মাইলাম ঘুরে পরিস্থিতির ভয়াবহতা আঁচ করতে পেরেছিলেন লুথারা। কপালে ভাঁজও পড়েছিলো। বিমানে খাদ্য প্রেরণের ব্যবস্থা হলো। দিন কতক ১৫-২০ বার বিমান এসে খাদ্য ফেলে যেতো। সঙ্গে ওষুধপত্র, স্যালাইন। কয়েকটি মেডিকেল টিমও আসে। পাহাড়ি রাস্তা বর্ষায় ধস নেমে বন্ধ হয়ে গেছে। রাস্তা সারিয়ে ট্রাক চলাচলের উপযোগী করার অপেক্ষা করলে না খেয়ে মরতো আরো কয়েক হাজার মানুষ। আব্দুল হাই সাহেবের বহুমুখী প্রতিভা ও কর্মযোগী মহৎপ্রাণ মানুষটির কর্মযজ্ঞের পরিচয় স্বল্প পরিসরে উপস্থাপন করা সম্ভব নয় এবং অলোকসাধারণ মানুষটির মূল্যায়ন করাও এ অকৃতির কর্ম নয়। যা কিছুই লিখি,তার সব কিছু আড়াল করে জেগে ওঠেন প্রাগঐতিহাসিক সম্রাটের মত প্রস্তর দৃঢ় এক প্রাজ্ঞ পুরুষ যার এক হাতে আলোর মশাল আরেক হাতে খাপখোলা তলোয়ারের মত শানিত লেখনি, দাড়িয়ে আছেন সুরমা তীরে , এক সুউচ্ছ স্থানে। সেখান থেকে উত্তরের উতলা বাতাসে ভেসে আসে মরমী মনের সুগভীর আকুলতা “কি দিয়ে সাজাবো বলো বাসর সাজ জীর্ন আমার ঘরে ছিন্ন এ শয্যায় কেমনে বসাবো,কোথা লুকাবো লাজ তোমারে যে দেবো মালা অবকাশ কোথা তার।” হাওরের উত্তাল তরঙ্গে প্রতিফলিত হচ্ছে সহস্র মশালের আলো। শানিত লেখনি হতে বিদ্যুৎ রেখায় ক্রমাগত লেখা হয়ে যাচ্ছে – বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাটি..।
সুখেন্দু সেন। সাহিত্যিক,কলামিস্ট অবসরপ্রাপ্র ব্যাংক কর্মকর্তা।