কিবরিয়া চৌধুরী-

নবীগঞ্জের লন্ডন প্রবাসী সামিউন। এক সময়ে মদের নেশায় সার্বক্ষণিক বুদ হয়ে থাকা সামিউন কিভাবে জঙ্গি সম্পৃক্ততার সাথে জড়িয়ে পড়ে, এনিয়ে জনমনে নানা আলোচনা। নবীগঞ্জ উপজেলার দেবপাড়া ইউনিয়নের ফুটারচর গ্রামের মৃত হামদু মিয়ার ছেলে সামিউন সম্পর্কে তার এলাকাবাসী ও আত্মীয়-স্বজনদের কাছে থেকে নানা তথ্য পাওয়া গেছে। ভারতের রাজধানী দিল্লিতে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়ার পর তার নিজ এলাকায় নানা আলোচনা চলছে। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সামিউন হামদু মিয়ার ২য় ছেলে। ২ ভাই ৪ বোনের মধ্যে সামিউন রহমান ৪র্থ। সামিউনের বড় ভাই সেলিম আহমেদসহ ৪ বোন ও মা লন্ডনে বসবাস করছেন। সামিউন রহমান বাংলাদেশে ৪ বার এসেছেন। ১৯৯৫ সালের দিকে প্রথমবারের মতো তার পরিবারের সাথে বাংলাদেশে আসে সামিউন। পরবর্তীতে লন্ডনে মদ, গাজা, হেরোইন সেবন করার কারণে তাকে ভালো করার জন্য সামিউনের মা ২০০৭ সালে ২য় বারের মতো বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। দেশে আসার পর সে নবীগঞ্জ উপজেলার দেবপাড়া ইউনিয়নের গোপলার বাজারে জনতা ব্যাংকের নিকটস্থ তার চাচা লন্ডন প্রবাসী হাজী আব্দুল মন্নানের বাসায় উঠে। দেশে তার চলাফেরা ছিল মারাত্মক খারাপ।

প্রকাশ্যে মদ, গাজা, হেরোইন সেবনসহ সামিউনের আচার-আচরণ ছিল অস্বাভাবিক ও অসংলগ্ন। দেশে প্রায় ১ বছর থাকার পর সামিউন লন্ডন চলে যায়। পরে সেখানে সামিউন রহমান কে ২০১১ সালে ইংল্যান্ডের পুলিশ মাতাল অবস্থায় গাড়ি চালানোর অপরাধে ১ম বারের মতো গ্রেফতার করে। পরে ওই অপরাধে ইংল্যান্ড আদালত তাকে দেড় বছরের সাজা প্রদান করে। লন্ডন জেল হাজতে ৬মাস কারাবাস করার পর সামিউন জামিনে বের হয়ে আসে। পরবর্তীতে ৩য় দফায় ২০১২ সালের শেষের দিকে বাংলাদেশে আসে সামিউন। দেশে থাকাকালীন তার চাচা লন্ডন প্রবাসী হাজী আব্দুল মন্নানের বাসায় উঠে। এ সময় অন্যরুপের সামিউনকে দেখে স্থানীয় লোকজন। মদ, গাজা, হেরোইন সেবনকারী সামিউনকে ইসলাম প্রচার, সব সময় পড়নে পাঞ্জাবি মাথায় টুপি পরিধান করে ৫ ওয়াক্ত নামাজ আদায় দেখে স্থানীয় লোকজন হতবাক হয়ে যান। মনে মনে অনেক মানুষ খুশি হয় বলে জানায় স্থানীয় লোকজন। দেশে অবস্থান করাকালীন তার বড় ভাই সেলিম মিয়ার বিয়ে অনুষ্ঠান এ অংশগ্রহণ করে সামিউন।

প্রায় ১ মাস বাংলাদেশে থাকার পর আবার ও সে লন্ডন চলে যায়। সর্বশেষ ২০১৪ সালে বাংলাদেশে আসে সামিউন। এসময় সে তার চাচা আব্দুর মান্নানের পূর্বে থাকা কালিন বাসায় না উঠলে ও আব্দুল মন্নানের স্ত্রী’র অনুরোধে আব্দুল মন্নানের অন্য একটি বিল্ডিং এ এস,এন ডেফ মিনি স্টোর নামে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পিছনে থাকতে দেন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক ফয়জুর রহমান। এ সময় সে ৫ ওয়াক্ত নামাজ জামাত এর সাথে আদায় করতো। বাড়ির নিকটে মসজিদ থাকা সত্ত্বেও তার বাসস্থান থেকে ২কিলোমিটার দুরত্বের দেবপাড়া ইউনিয়নের বৈঠাখাল কওমী পন্থী মসজিদে নামাজ আদায় করতো সামিউন। এসময় সে তাবলীগ জামায়েতে ও অংশগ্রহণ করতো। সব সময় স্থানীয় লোকজনদের ইসলামের দাওয়াত নামাজ, কোরআন তিলাওয়াত করার জন্য দিক নির্দেশনা দিতেন। এমনকি সব সময় মিনি কোরআন শরিফ সঙ্গে রাখতেন এবং সুযোগ পেলেই পড়তে শুরু করতেন সামিউন।

ওই বছরের রমজান মাসে হযরত শাহ জালাল (র.) মাজার নিকটস্থ মসজিদে ১মাস এতেকাফ পালন করে। সব সময় একা, নিরিবিলি চলাফেরা করতো ব্রিটিশ নাগরিক জঙ্গি সামিউন রহমান। নিজেদের জায়গার উপর একটি মসজিদ, একটি এতিমখানা ও একটি মাদ্রাসা স্থাপনের জন্য টাকা জমাচ্ছেন বলে তার নিকটতম এক আত্মীয়কে জানান সামিউন। এমনকি মসজিদ তৈরী করার জন্য ৫শতক জায়গা ও ক্রয় করেন তিনি। ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর গভীর রাতে নবীগঞ্জ উপজেলার দেবপাড়া ইউনিয়নের গোপলার বাজার সামিউনের চাচা লন্ডন হাজী আব্দুল মন্নান এর বিল্ডিং এ এস.এন.ডেফ.মিনি স্টোর নামে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পেছনের রুম থেকে সাদা পোশাকদারী একদল পুলিশ তাকে তুলে নিয়ে যায়। এ সময় শয়ন কক্ষ থেকে বিভিন্ন ইসলামীক জিহাদী বই, বিভিন্ন দেশের সিম কার্ড, কয়েকটি মোবাইল উদ্ধার করে।

পরে ২৪সেপ্টেম্বর জঙ্গি আসিফ আদনান ও ফজলে এলাহীর বিরুদ্ধে রাজধানীর শাহবাগ থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে যে মামলা (নং ৫২, তারিখ ২৪/০৯/২০১৪) দায়ের করা হয়, ওই মামলাতেই গ্রেফতার দেখানো হয় সামিউনকে। মাস কয়েক আগে ওই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আসলাম আলী শেখ তিন জনকেই অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট প্রদান করেন। সে সময় পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, ব্রিটিশ নাগরিক সামিউন রহমান সিরিয়া ফ্রন্টে সশস্ত্র জিহাদি কার্যক্রম পরিচালনা করতে আইএস ও নুসরা ব্রিগেডের জন্য মুজাহিদ সংগ্রহ করতে বাংলাদেশ এসেছিল। আল-কায়েদা নেতা আইমান আল জাওয়াহারী ঘোষিত একিউআইএস বা আল-কায়েদা অব ইন্ডিয়ান সাব কন্টিনেন্ট এর বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে জঙ্গি নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যও ছিল তার। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এখন বলছে, দেশে কোন আইএস জঙ্গি বা তাদের কোন নেটওয়ার্ক নেই। গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে সামিউন পুলিশকে জানিয়েছিল, সে ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সিরিয়ায় গিয়ে নুসরা ফ্রন্টের হয়ে জিহাদে অংশ নিয়েছিল।

জিহাদে অংশ নিতে এক ব্রিটিশ বন্ধুসহ সেসময় তুরস্ক হয়ে সিরিয়ায় যায় সামিউন। পরবর্তীতে পিস টিভির উপস্থাপক অ্যানথনির ফেসবুক ফ্যান পেইজের সূত্র ধরে বাংলাদেশ থেকে জিহাদে অংশ নিতে ইচ্ছুক তরুণদের সঙ্গে তার যোগাযোগ হয় বলে তৎকালিন সময় জানায় পুলিশ। জানা যায়, গ্রেফতার হওয়ার কিছুদিন পর উচ্চ আদালত থেকে একে একে জামিনে ছাড়া পায় আসিফ আদনান ও ফজলে এলাহী। কিন্তু চলতি বছরের এপ্রিল মাসে উচ্চ আদালত থেকেই জামিনে ছাড়া পায় সামিউন রহমান। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, জামিনে বের হয়ে সে নবীগঞ্জ উপজেলার আউশকান্দি ইউয়িনের মিঠাপুর গ্রামের সামিউনের মামা কুরশ মিয়ার বাড়িতে উঠে। এ বছরের রমজান মাসে পুরো ১মাস মিঠাপুর জামে মসজিদের কোণায় একটু জায়গার মধ্যে সে একা এতেকাফ পালন করে। ভারত পুলিশের সূত্র জানায়, এবছরের জুলাই মাসে সিলেটের সীমান্ত পথে অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশ করে সামিউন। এরপর ভারতের মনিপুরে চলে যায়।

সেখানে কিছুদিন অবস্থান করার পর বিহারের কিশানগঞ্জে গিয়ে ভারতীয় নাগরিক হিসেবে পরিচয়পত্র সংগ্রহ করে সামিউন রহমান। দেশে সামিউনের গ্রামের বাড়ি ফুটারচর গ্রামে তাদের পরিত্যক্ত বাড়ির কেয়ারটেকার মহিলা বিদ্যা বেগম জানান, আমি বিগত ১৫বছর যাবত আমার সন্তানদের নিয়ে এ বাড়িতে বসবাস করে আসছি। ২০১৪ সালে একদিন সামিউন বাড়িতে আসে এবং বাড়ির ভেতরের গাছপালা বিক্রি করা নিয়ে তার চাচাতো ভাইদের সাথে বাকবিতন্ডা হয়। ওই সময়ই সামিউন চলে যায়। আর কখনো এ বাড়িতে সে আসেনি। পরে লোকজনের মুখে শুনেছি তাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। এব্যাপারে এস.এন.ডেফ.মিনি স্টোর নামে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক সামিউনের চাচাতো ভাইয়ের ছেলে ফয়জুর রহমান বলেন, সামিউন প্রথমত ছোটবেলায় তার পরিবারের সাথে দেশে আসে। পরবর্তীতে ২য় বার আসে এসময় তার চলাফেরা ছিল খুব খারাপ, মদ-গাজা সেবন করতো। তার পরিবার তাকে ভালো করার উদ্দেশ্যে প্রায় এক বছর দেশে রাখেন। কিন্তু সে নেশার জগত ছাড়তে পারেনি। পরবর্তীতে সে ২০১২ সালের শেষ দিকে আবার বাংলাদেশে আসে। সেসময় তার চলাফেরায় সম্পূর্ণ পরিবর্তন ছিল।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn