ভালো নেই হবিগঞ্জের ৫ নারী মু্ক্তিযোদ্ধা
হবিগঞ্জ :ভালো নেই হবিগঞ্জের ৫ নারী মুক্তিযোদ্ধা। অসুখ-বিসুখ আর অভাবের তাড়নায় চলছে তাদের সংসার। একটি সূত্র জানায়, হবিগঞ্জের মুক্তিবাহিনীর অগ্রসৈনিক বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড্যান্ট মানিক চৌধুরীর কন্যা ‘চেতনায়-৭১’ এর হবিগঞ্জের সদস্য সচিব (বর্তমানে সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংসদ সদস্য) কেয়া চৌধুরী বীরাঙ্গনাদের খুঁজে বের করে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন। তার চেষ্টায় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর হবিগঞ্জের ছয় নারীকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে। তারা পান মুক্তিযোদ্ধা সম্মানী ভাতা। বানিয়াচং উপজেলার ছয় নারী মুক্তিযোদ্ধা হলেন হলদারপুর গ্রামের পঙ্গু ফারিজা খাতুন, শায়েস্তাগঞ্জের বীরাঙ্গনা রাজিয়া খাতুন, চুনারুঘাটের চাঁন্দপুর চা বাগানের বীরাঙ্গনা হীরামনি সাঁওতাল, বীরাঙ্গনা সাবিত্রী নায়েক, একই উপজেলার গোছাপাড়া গ্রামের বীরাঙ্গনা পুষ্প রানী শুক্লবৈদ্য ও মালতি রানী শুক্লবৈদ্য। তাদের মধ্যে হীরামনি সাঁওতাল মারা গেছেন। বাকি পাঁচজনের শারীরিক অবস্থা দিন দিন অবনতির দিকে যাচ্ছে। তাদের আরও সাহায্য-সহযোগিতা প্রয়োজন বলে মনে করেন এমপি কেয়া চৌধুরী।
ফারিজা খাতুন : স্বীকৃতিপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা পঙ্গু ফারিজা খাতুন বানিয়াচং উপজেলার হলদারপুর গ্রামের মৃত আবদুল হেকিমের মেয়ে। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বানিয়াচং উপজেলার হলদারপুর গ্রামে বিমান থেকে শেল নিক্ষেপ করে। ওই সময় শেলের আঘাতে ১০ জন নিহত হন, আহত অসংখ্য নারী-পুরুষের মধ্যে ফারিজা খাতুন একটি পা হারান। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে হঠাৎ করেই তার ভাতা বন্ধ হয়ে যায়। প্রায় ৮ মাস পর ভাতা ফের চালু হয়। অবিবাহিত ফারিজা খাতুন জানান, শরীর ভালো যাচ্ছে না। উন্নত চিকিৎসা প্রয়োজন।
সাবিত্রী নায়েক : ১৯৭১ সালের বৈশাখ মাসে পাকিস্তানি বাহিনী চুনারুঘাট উপজেলার চাঁন্দপুর বাগানের ফ্যাক্টরিতে ক্যাম্প স্থাপন করে। কয়েক দিন পরই সাবিত্রী নায়েকের বাড়িতে হানা দেয় তারা। মায়ের পাশে ঘুমিয়েছিলেন সাবিত্রী। এ সময় তাকে টেনেহিঁচড়ে চা বাগানের ৬নং বাংলোয় নিয়ে আটকে রাখা হয়। বাগানের ক্যাম্পে ২ সপ্তাহ ছিলেন তিনি। প্রতিদিনই পালাক্রমে পাকিস্তানি সেনারা তাকে ধর্ষণ করত। পরে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় পাশের মাধবপুর থানার সুরমা চা বাগানের বাংলোয়। ওই এলাকা স্বাধীন হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তার ওপর চলে বর্বরতা। দেশ স্বাধীন হলে সাবিত্রী বিয়ে নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় পড়েন। অবশেষে চাঁন্দপুর বাগানের মুক্তিযোদ্ধা কেরামত আলী তাকে বিয়ে করেন। কিন্তু বিয়ের ১৩ বছরের মাথায় সাবিত্রীকে দুই ছেলেসন্তানসহ ঘর থেকে বের করে দেন তিনি। একপর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধার খেতাব পান সাবিত্রী। এখন তার শারীরিক অবস্থা ভালো নেই।
রাজিয়া খাতুন : ১৯৭১ সালে তার বয়স ছিল ১৮ বছর। যুদ্ধের সময় তিনি তার বাবার বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আখাউড়ায় থাকতেন। তখনও তার বিয়ে হয়নি। বৈশাখ মাসের ১২ তারিখ দুপুরে বাড়ির পুরুষরা পালিয়ে গেলেন, তখন পাকিস্তানি বাহিনী বাড়িতে হামলা চালায় এবং পালাক্রমে তাকে নির্যাতন করে। যখন জ্ঞান ফেরে, তখন তিনি নিজেকে পাকিস্তানি ক্যাম্পে দেখেন। ৩ দিন নির্যাতন ভোগের পর সেখান থেকে পালিয়া ভারতে আশ্রয় নেন তিনি। ৩নং সেক্টরে মেজর শফি উল্লাহর অধীনে সম্মুখ-সমরে অংশগ্রহণ করেন তিনি। রাজিয়া বলেন, ইজ্জতের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন করেছি। এমপি কেয়া চৌধুরীর চেষ্টায় মুক্তিযোদ্ধা খেতাব পেলাম। মাসে ১০ হাজার টাকা ভাতা পাচ্ছি। একমাত্র ছেলে সাহেদুল পঙ্গু হয়ে আমার ওপর নির্ভরশীল। অনেক চেষ্টা করছি, একটি নাতিকে চাকরি জোগাড় করে দিতে। আমার শারীরিক অবস্থা দিন দিন অবনতির দিকে যাচ্ছে। এজন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের কাছে সহযোগিতা কামনা করেন তিনি।
মালতি রানী শুক্লবৈদ্য : একাত্তরের ১৩ জ্যৈষ্ঠ হানাদার বাহিনী তার বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে স্বামী যতীন্দ্র শুক্লবৈদ্য, ভাসুর অক্ষয় শুক্লবৈদ্যকে পাল বাড়ির কাছে নিয়ে হত্যা করে। দেবর রাখাল শুক্লবৈদ্যকে গাড়িতে করে নিয়ে যায় এবং রাখালের স্ত্রী পুষ্প রানী শুক্লবৈদ্য ও তাকে সুখদেবপুর গ্রামের রশিদ মিয়ার বাড়িতে জিম্মায় রাখে। পরের দিন ভোরে সেখান থেকে তাদের দুইজনকে দুর্গাপুর গ্রামের রজব আলীর বাড়িতে নিয়ে যায় এবং ১ মাস আটকে রেখে নির্যাতন চালানো হয়। সদর উপজেলার বাহুলা গ্রামের তৎকালীন চেয়ারম্যান-মেম্বারসহ আত্মীয়স্বজন তাদের উদ্ধার করেন। মালতি রানী শুক্লবৈদ্য বলেন, কেউ খোঁজ নেয়নি। স্বাধীনতার ৪২ বছর পর মুক্তিযোদ্ধার খেতাব এনে দিয়ে ইচ্ছা পূরণ করেছেন মা এমপি কেয়া চৌধুরী।
পুষ্প রানী শুক্লবৈদ্য : পাকিস্তানি সেনাদের নির্যাতনের শিকার হয়েছি। দেশ স্বাধীন হয়। কেউ খবর নেয়নি। দুই সন্তান নিয়ে আর্থিক দৈন্যতায় দিনাতিপাত করছিলাম। অবশেষে এমপি কেয়া চৌধুরীর চেষ্টায় মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেলাম। তিনি একের পর এক সহায়তা করছেন। সর্বশেষ বধ্যভূমিতে প্রাচীর নির্মাণসহ আমাদের সোলার বরাদ্দ দিয়েছেন। আমার ছেলেরা এখন রোজগার করে। আমি এমপি কেয়া চৌধুরীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। ইদানীং শরীর ভালো যাচ্ছে না তার। এমপি কেয়া চৌধুরী বলেন, ২০০৬ সালে হবিগঞ্জ থেকে রাজিয়া খাতুন, হিরামনি সাঁওতাল, সাবিত্রী নায়েক, মালতি রানী, পুষ্প রানী, ফারিজা খাতুন এ ছয়জন নারী মুক্তিযোদ্ধাকে খুঁজে বের করি। তাদের গেজেটভুক্ত করার জন্য আবেদন করি। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ছয় নির্যাতিতা নারীকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গেজেটে অন্তর্ভুক্ত করেন। এদের মধ্যে হিরামনি মারা গেছেন। আমার মনে হয়, তাদের আরও অনেক কিছু পাওয়ার আছে।