শহীদনূর আহমেদ :: সুনামগঞ্জ পৌর শহরের পানি নিষ্কাশনের প্রবাহে কয়েকযুগ আগেও যে খালগুলো দৃশ্যমান ছিল আজ তার অস্থিত্ব বিলীনের পথে। অবৈধভাবে খালের উপর স্থায়ী স্থাপনা গড়ে তোলায় পরিবেশবান্ধব খালগুলো অস্থিত্ব সংঙ্কটে ভূমিখেকোদের কালো থাবায়। শহরের জলবন্ধতা সমস্যা নিরসন আর সৌন্দর্য্যবর্ধনে বিভিন্ন মহল থেকে দখল হওয়া খালগুলো পুনরুদ্ধারে দাবি উঠলেও উচ্ছেদের কোনো কার্যকর প্রদক্ষেপ দৃশ্যমান হচ্ছে না। খালের উপর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে প্রশাসনের পক্ষ থেকে নানামূখী উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও দখলদারদের প্রভাবের কাছে রহস্যজনক কারনে শুরুতেই থেমে যায় যাত্রা। প্রভাবশালী ভূমিখেকোদের কাছে অসহায় শহরের খাল পুনরুদ্ধারের স্বপ্ন। তবে খালের উপর স্থাপনা উচ্ছেদের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা থাকায় চলতি মাসে বিহীত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আহাদ।
সুনামগঞ্জ সদর উপজেলা ভূমি অফিসের তথ্য অনুযায়ি জানা যায়, সুনামগঞ্জ পৌর শহরের দখলকৃত প্রধান প্রধান খালের দুই পারের দখলদারের তালিকা চূড়ান্ত করা হয়েছে। শহরের পানি প্রবাহ নিষ্কাশনের প্রধান খাল খামারখাল দখলদারের তালিকায় নাম রয়েছে ৫৭ জনের। প্রায় খালের উপর বসবাসের সংখ্যাই বেশি। স্থায়ি ভবন উচ্ছেদ নথি সৃষ্টি করে কার্যকরী প্রদক্ষেপ গ্রহণে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন সদর উপজেলা ভূমি অফিসার আরিফ আদনান।
বাকি খালের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের আওতায় নিয়ে আসা হবে বলে জানান তিনি। প্রবীণদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জনশ্রুতি রয়েছে এক সময় ঝাউয়ার হাওর খনন করেই সুনামগঞ্জ শহর প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এই ঝাউয়ার হাওরই শহরের পানি নিষ্কাশনের প্রধান জলাধার ছিল। সুরমা নদী থেকে প্রবাহিত ৫টি খাল শহরের ভেতর দিয়ে ঝাউয়ার হাওরে প্রবাহিত হতো। এই খালগুলোই ছিল শহরবাসীর পানি নিষ্কাশনের প্রধান মাধ্যম। প্রবীণদের মতে খালগুলো হলো- ধোপাখালি খাল, বলাইখালী (ষোলঘর), কামারখাল, তেঘরিয়া খাল ও বড়পাড়া খাল।
শহরের পূর্ব উত্তর এলাকায় ধোপাখালি খালটি অবস্থিত। এই খাল দিয়ে এক সময় মরাগাঙে পানি নামতো। পরে এই পানি মোহাম্মদপুর হয়ে সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজের পূর্বে অবস্থিত জলাশয়ে গিয়ে পতিত হতো। এই জলাশয় থেকে সোনাখালি খাল হয়ে ঝাউয়ার হাওরে নামতো পানি। বর্তমানে পানি নামলেও ধোপাখালিতে অপরিকল্পিত স্লুইসগেটের কারণে পর্যাপ্ত পানি চলাচলে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এছাড়াও বিভিন্ন স্থানে ভরাট ও দখল হয়েছে খালটি। ষোলঘরের পুরাতন কাস্টমস অফিস সংলগ্ন সুরমা নদী থেকে বলাই খালের উৎপত্তি। এখান দিয়ে প্রবাহিত হয়ে খালের পানি অ্যাডভোকেট আফতাব উদ্দিন আহমদের বাসভবনের পাশের ঝিলে গিয়ে পড়তো। পরে সরকারি কলেজের পেছনের খাল হয়ে হাওরে নামতো পানি। খালের আশপাশের সকল বাসাবাড়ির পানি প্রাকৃতিকভাবেই এই খালে নিষ্কাশন হতো। কামারখাল এক সময় খর স্রোতা ছিল। কলোনি আমলে শহরে আসতে এই খাল পাড়ি দিতে সমস্যা হতো নাগরিকদের। পশ্চিম বাজারের বর্তমান পৌর প্রাথমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন সুরমা নদী থেকে খালটির উৎপত্তি। এখানে পাকিস্তান আমলে বাঁশের সেতু দিয়ে জনগণ যাতায়াত করতেন। পরবর্তীতে পৌর চেয়ারম্যান দেওয়ান ওবায়দুর রেজা চৌধুরীর সময়ে পৌর কর্তৃপক্ষ এখানে আকর্ষণীয় ডিজাইনের পাকা সেতু নির্মাণ করে। পরে প্রয়াত মেজর ইকবাল হোসেন চৌধুরীর সময়ে সেতুটি ভেঙে দিয়ে খালটি বন্ধ করে রাস্তা তৈরি করা হয়। প্রয়াত পৌর চেয়ারম্যান মমিনুল মউজদীনের সময়ে উৎপত্তিমুখে পৌর প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্মাণ করা হয়। এভাবেই খালটির মৃত্যু ঘটে।
এই খালটি আরপিননগর হয়ে, ডা. তৃণাঙ্কুর রায়ের বাসার সামনে দিয়ে শামীমাবাদ-বুলচান্দ, মহিলা কলেজের সামনে দিয়ে, বাঁধনপাড়া হয়ে ঝাউয়ার হাওরে পতিত হয়। ওই খালের পার্শ্ববর্তী বাসিন্দাদের পানি নিষ্কাশন হতো এই খাল দিয়ে। এক সময় এই খালটিতে পৌর কর্তৃপক্ষ সংকোচিত ড্রেন নির্মাণ করে আরো সংকট তৈরি করেছে বলে মনে করেন নাগরিকরা। পশ্চিম তেঘরিয়ার ডা. আমিরুল ইসলামের বাসার পূর্বে তেঘরিয়া খালটির অবস্থান ছিল। এরও উৎপত্তি সুরমা নদী থেকে। এই খালটি তেঘরিয়াকে দুই অংশে ভাগ করে। এই খালটি লম্বাহাটি মসজিদ, বিদ্যুৎ অফিস, কোর্টের সম্মুখে সড়ক ও জনপথ বিভাগের খাল হয়ে মল্লিকপুর সেতু (বিজিবি অফিসের সামনের সেতু) হয়ে ঝাউয়ার হাওরে পতিত হতো। প্রয়াত পৌর চেয়ারম্যান মমিনুল মউজদীনের সময়ে সেতুর নিচ ভরাট করে স্থায়ীভাবে খালটির পানিপ্রবাহ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। পরবর্তীতে এই খালের অর্ধেক অংশে রাস্তা নির্মিত হয়। অনেকে খালটি দখলও করে নেন। বড়পাড়া খালটি ছমির উদ্দিনের বাড়ির সামন থেকে সুরমার একটি ধারা হিসেবে প্রবাহিত হতো। এই
খালটি সিএনবির রাস্তা সংলগ্ন খালে যুক্ত হয়ে মল্লিকপুরের সেতুর নিচ দিয়ে ঝাউয়ার হাওরে পানি নিষ্কাশন করতো। এই খালে বর্তমানে পৌরসভার রাস্তা নির্মিত হয়েছে। প্রবীণরা জানান, এই ৫টি খালই ছিল শহরবাসীর প্রাকৃতিক পানি নিষ্কাশনের প্রধানতম ধারা। এক সময় ড্রেন না থাকায় এই খালগুলোই নাগরিকদের পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থাকে সহজতর করেছিল। বিশেষ করে শহরের বিভিন্ন পাড়া-মহল্লর ড্রেনেজগুলো পতিত ছিল এসব খালে।
সুনামগঞ্জ হাওর বাঁচাও আন্দোলনের কার্যকরী সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ান বলেন, সুনামগঞ্জ পৌরবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি শহরের দখলকৃতখালগুলো দখলমুক্ত করা। সচেতন নাগরিকদের পক্ষ থেকে অনেক সভা সমাবেশ ও মানববন্ধন করা হয়েছে। কিন্তু খাল দখলমুক্ত করার কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান হচ্ছে না। শহরের একজন প্রবীণ নাগরিক হিসেবে মনে করে শহরের জলাবদ্ধার স্থায়ী সমাধান ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় খালগুলো দ্রুত সময়ের মধ্যে পুনরুদ্ধার করা জরুরী। এ ক্ষেত্রে পৌর মেয়র ও জেলা প্রশাসকের তৎপর হতে হবে। সরকার সারা দেশে নদী ও খালের উপর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। যা প্রশংসার দাবি রাখে।
শহরের খাল পুনরুদ্ধার করার পাশাপাশি খাল খননের উদ্যোগ নিতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি অনুরোধ জানান তিনি। জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আহাদ বলেন, নদী ও খালের উপর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের জন্য পানি সম্পদ মন্ত্রনালয়ের সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের কাজ এগিয়ে নিয়ে এসেছি। করোনার কারনে উচ্ছেদ অভিযান বন্ধ ছিল। শীঘ্রই শুরু করা হবে। শহরের খাল উদ্ধারের ব্যাপারে তিনি বলেন, শহরের খাল পুনরুদ্ধারের ব্যাপারে এমাসে একটি সভা রয়েছে। যেখানে মেয়র মহোদয়কে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। একটি কারিগরি টিমের মাধ্যমে অবৈধ দখলদারের তালিকা করা হয়েছে। পৌর মেয়রের সহযোগিতায় চলতি মাসেই খাল পুনরুদ্ধারের কাজ শুরু করা হবে বলে জানান তিনি।
সংবাদ টি পড়া হয়েছে :
৯৩ বার